নির্বাচন কমিশনের প্রতিশ্রুতিই সার! বিহারের প্রায় ১৬ শতাংশ কেন্দ্রে মিলল ডুপ্লিকেট ভােটার। সংখ্যাটা প্রায় ২ লক্ষ। কমিশন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তিনমাসের মধ্যে বাদ দেওয়া হবে সব নাম, কিন্তু তা হয়নি। সাংবাদিক বৈঠকে তথ্য তুলে ধরে কমিশনকে তোপ দাগল তৃণমূল।
বিহারে আমাদের গণতন্ত্রের অস্তিত্ব সংকটের মুখে। একটি সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ৩৯টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে, রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো ১,৮৭,৬৪৩টি (১.৮৮ লাখ) ঘটনা চিহ্নিত হয়েছে যেখানে একই নাম এবং একই আত্মীয়ের নাম-সহ ব্যক্তিদের একই বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে দু’বার নিবন্ধিত করা হয়েছে।
১.০২ লক্ষ কেসে এমন নকল নাম খুঁজে পাওয়া গেছে, যেখানে নাম ও পিতামাতার নাম একই, এবং বয়সের পার্থক্য মাত্র ০ থেকে ৫ বছরের মধ্যে। যার ফলে নির্বাচন কর্মীদের পক্ষে এই এন্ট্রিগুলির মধ্যে পার্থক্য করা প্রায় অসম্ভব। এছাড়া ২৫,৮৬২টি ক্ষেত্রে, নাম, আত্মীয়ের নাম এবং বয়স সব তথ্যই পুরোপুরি মিলছে, তবুও ওই ব্যক্তিরা ভোটার তালিকায় দু’বার করে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
আরও পড়ুন-বাংলার শ্রমিককে আটক হরিয়ানায়
এই সন্দেহজনক কেসগুলির মোট ভোট সংখ্যা ৩.৭৬ লক্ষ, যা ৩৯টি বিধানসভা কেন্দ্রে ছড়িয়ে রয়েছে। এটি কোনও ছোটখাটো প্রশাসনিক ভুল নয়। এই ভোটগুলির একটি ক্ষুদ্র অংশও যদি ভুয়ো প্রমাণিত হয়, তাহলে তা নির্বাচনের ফলাফলকে সরাসরি প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে।
এই অনিয়মগুলি প্রকাশ্যে আসে ভারতের নির্বাচন কমিশনের বিতর্কিত ৩০ দিনের এসআইআর অভিযানের পরে, যা বিহারে পরিচালিত হয়েছিল। সেই সময় কমিশন দাবি করেছিল যে তারা ৭ লক্ষেরও বেশি নকল নাম মুছে ফেলেছে, যা মোট ভোটারের ০.৮৯ শতাংশ। কিন্তু এই ধরনের দাবি সত্ত্বেও, এই সন্দেহজনক ভোটাররা এখনও খসড়া ভোটার তালিকায় থেকে গেছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হল সেই ১৬,৩৭৫টি ঘটনা, যেখানে নকল ভোটাররা যেন একে অপরের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি— নাম, আত্মীয়ের নাম, বয়স এমনকী ঠিকানাও হুবহু মিলে যায়, অথবা ঠিকানাগুলি একে অপরের থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। এই ধরনের ঘটনা নির্বাচন কমিশনের জন্য সবচেয়ে সহজে চিহ্নিত করার মতো ছিল, তবুও তারা এখনও খসড়া ভোটার তালিকায় রয়ে গেছে।
এই ধরনের সমস্যা প্রথম প্রকাশ্যে আসে একটি সংবাদ প্রতিবেদন মারফত, যেখানে ১৫টি বিধানসভা কেন্দ্রে এই অনিয়মের তথ্য উঠে আসে। ৩১ অগাস্ট, নির্বাচন কমিশন বা ইসিআই এই বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানায়, কিন্তু লক্ষণীয়ভাবে তারা কোনও তথ্য, পরিসংখ্যান বা দাবি অস্বীকার করেনি। বরং, মিডিয়া সংস্থার এই অনুসন্ধানকে ‘ডেটা মাইনিং’ বলে খারিজ করে দেয় —যদিও এই তদন্তের পদ্ধতিটিই ঠিক সেই রকম, যেটির জন্য নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব ইআরওনেট ২.০ সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-বিধানসভায় হাজিরার ‘মার্কশিট’, প্রকাশ্যে আসছে রিপোর্ট
নির্বাচন কমিশন জনসাধারণের নজরদারিকে বাধা দেওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বিহারের ভোটার তালিকা এমন এক ফরম্যাটে প্রকাশ করে, যা মেশিন-রিডেবল নয়। স্বাধীন বিশ্লেষকদের এই বাধা ভেঙে তবেই নকল নাম শনাক্ত করতে হয়েছে। অথচ বাস্তবে এই নকল এন্ট্রিগুলিকে যাচাই করার ক্ষমতা ও উপায় কেবল নির্বাচন কমিশনেরই রয়েছে তবুও তারা তা করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
এটাই প্রথম নয়, এর আগেও এমন গাফিলতির ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। পূর্ববর্তী একাধিক তদন্তে দেখা গেছে, বিহার ও উত্তরপ্রদেশ এই দুই রাজ্যে একসঙ্গে নিবন্ধিত রয়েছেন ৫,০০০-র বেশি ভোটার। শুধু তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রেই প্রায় ৮০,০০০ ভোটার ভুয়ো বা ভুল ঠিকানায় নিবন্ধিত ছিলেন। এই সমস্ত তথ্যে নির্বাচন কমিশন এখনও পর্যন্ত কোনও যথাযথ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেনি।
নির্বাচন কমিশনের দাবি, নকল ভোটারদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য ভোটারদের নিজেদেরই ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অভিযোগ এবং দাবি জানাতে হবে। এটি আসলে দায় এড়ানোর এক রূপ মাত্র। নকল ভোটার শনাক্তকরণ (ডিডুপ্লিকেশন) হল নির্বাচন কমিশনের আইনি দায়িত্ব, যা তারা খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের আগে সম্পন্ন করার কথা বলে। তবুও এখন তারা এই দায়িত্ব সাধারণ ভোটারদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে, অথচ ৭ লক্ষ নকল ভোটার বাদ দেওয়ার যে প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে তার কোনও ব্যাখ্যা দিচ্ছে না।
এটি শুধু প্রশাসনিক অবহেলা নয়, বরং ইচ্ছাকৃত যোগসাজশকেও প্রকাশ করছে। শুধুমাত্র বিহারে প্রায় ১.৮৮ লক্ষ সন্দেহজনক ভোটারকে খসড়া ভোটার তালিকায় রেখে, নির্বাচন কমিশন বিশাল পরিসরের নির্বাচনী জালিয়াতিকে সহায়তা করছে। এই নকল ভোটারদের উপস্থিতি বিজেপির পক্ষে কৃত্রিম ভোটসংস্করণে সুযোগ তৈরি করছে এবং এটি নির্বাচন কমিশনের সাথে তাদের আঁতাত মাত্র।
সুপ্রিম কোর্ট এখন বিহারের খসড়া ভোটার তালিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর সময়সীমা বাড়ানোর আবেদনগুলি বিবেচনা করে দেখতে চলেছে। এই বিষয়টি একটা জিনিস স্পষ্ট করে দেয় যে, নাগরিক, বিরোধী দলগুলি এবং স্বতন্ত্র সংস্থাগুলোকে গণতন্ত্র রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে, কারণ যে প্রতিষ্ঠান স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল, তারা তাদের কর্তব্য ত্যাগ করেছে।
৭ মার্চ ২০২৫ সালে নির্বাচন কমিশন প্রকাশ্যে অঙ্গীকার করেছিল যে, বিগত দশকের পুরনো ডুপ্লিকেট এপিক নম্বরের সমস্যা তিন মাসের মধ্যে, অর্থাৎ ৭ জুন ২০২৫-এর মধ্যে সমাধান করা হবে। কিন্তু ২৭ জুলাই ২০২৫ তারিখের এক প্রেস নোটে সেই কমিশনই স্বীকার করে যে, বিহারে এসআইআর-এর মাধ্যমে তারা ৭ লক্ষ ভোটারের নাম একাধিক স্থানে নিবন্ধিত পেয়েছে। এই স্বীকারোক্তির পরেও, চমকপ্রদভাবে দেখা যাচ্ছে যে শুধুমাত্র বিহারের ৩৯টি বিধানসভা কেন্দ্রে ১.৮৮ লক্ষ নকল ভোটারের ঘটনা এখনও রয়ে গেছে।
এই ঘটনা কিছু গুরুতর প্রশ্ন তোলে: যদি এত বিশাল পরিমাণে নকল ভোটার এখনও থেকে থাকে, তাহলে এসআইআর-এর উদ্দেশ্য কী ছিল? বিহার এবং গোটা ভারত জুড়ে আরও কতগুলি এমন ঘটনা রয়েছে? এবং শেষ পর্যন্ত এই ভুয়ো ভোটারদের উপস্থিতি থেকে সত্যিকারের লাভবান কারা হবে?
যদি কমিশন তার নিজের প্রতিশ্রুতি পালন করতে ব্যর্থ হয় এবং এই অনিয়ম চলতে দেয়, তাহলে কি তারা এই বিষয় জবাবদিহি দিতে বাধ্য নয়? এবং দায়িত্বে অবহেলার জন্য প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে কি এফআইআর দায়ের করা উচিত নয়?
এটা শুধু বিহারের বিষয় নয়। যদি একটি রাজ্যের পরিস্থিতি এমন হয়, তাহলে সারা ভারতজুড়ে নির্বাচনী কারচুপির মাত্রা কেমন হতে পারে, তা সহজেই কল্পনা করা যায়। বিজেপি, এক দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাচন কমিশনের সহায়তায়, আমাদের গণতন্ত্রের সবচেয়ে মৌলিক স্তম্ভ স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করার চক্রান্তে লিপ্ত।
বিহারে এই নকল ভোটারদের অন্তর্ভুক্তি প্রমাণ করে যে এসআইআর প্রক্রিয়া অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে এবং অবৈজ্ঞানিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে এর উদ্দেশ্য ভোটার তালিকা পরিষ্কার করা নয়, বরং কারচুপির জায়গা তৈরি করা। এই কারণেই আমরা বাংলায় একই ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া চালানোর তীব্র বিরোধিতা করছি।
নির্বাচন কমিশন নিজস্ব আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, ভুল ও অসঙ্গতিতে ভরা খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে। এই গাফিলতিপূর্ণ ও দায়সারা মনোভাব জনগণের আস্থা নষ্ট করছে এবং স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে এই পুরো প্রক্রিয়াটি তড়িঘড়ি করা হয়েছে শুধুমাত্র বিজেপির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য। যদি তথাকথিত সংশোধনের পরেও শুধুমাত্র বিহারে প্রায় ১.৮৮ লক্ষ সন্দেহজনক ভোটার তালিকাভুক্ত থাকতে পারে, তাহলে বাংলায় একই প্রক্রিয়ার অপব্যবহারের মাধ্যমে জনমতের বিকৃতি ঘটানোর বিপদ কতটা গুরুতর, তা সহজেই বোঝা যায়।
ভূতুড়ে ভোটারের বিষয়টি প্রথম যে ক’জন সামনে আনেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তাঁর ভাষণে তিনি এই ইস্যু তুলে ধরেছিলেন। এমনকী সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং দেখিয়ে দেন কীভাবে মহারাষ্ট্র ও দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে ভুয়ো ভোটারদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।
সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস ভুয়ো ভোটারদের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার পরেই নির্বাচন কমিশন বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে বাধ্য হয় এবং একটি নতুন ফিচার তাদের সফটওয়্যারে যুক্ত করে, যা ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসারদের (ইআরও) সহায়তা করবে একক এপিক নম্বরের অধীনে একাধিক নাম নিবন্ধিত আছে কি না তা শনাক্ত করতে। কমিশন ইতিমধ্যেই এই নতুন পদক্ষেপ সম্পর্কে দেশের সব রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকদের (সিইও) অবহিত করেছে। যদি পুরনো ব্যবস্থায় কোনও ত্রুটি না-ই থাকত, তাহলে নতুন এই ব্যবস্থা চালু করার প্রয়োজনই বা হত কেন?
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপি এই একই ভোটার তালিকার ভিত্তিতে লড়েছে এবং জয়লাভ করেছে। তখন তো রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশিদের নিয়ে কোনও উদ্বেগ ছিল না! তাহলে এখন, রাজ্যের নির্বাচন আসার ঠিক আগে কেন এই ইস্যু তোলা হচ্ছে? যদি এই ভোটার তালিকা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয়ে থাকে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য, তাহলে এখন কেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে? এটা কি দ্বিচারিতা নয়?
এমনকী বিজেপি সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদারের স্ত্রী, কোয়েল মজুমদারও বালুরঘাট ও জলপাইগুড়ি—দুই জায়গাতেই ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছেন। তিনি নতুনভাবে নাম তোলার জন্য ফর্ম ৬ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু পূর্বের ভোটার আইডি ফর্ম ৮-এর মাধ্যমে বাতিল করেননি। যদি তাদের সত্যিই কোনও গোপনীয়তা বা অনিয়ম না থাকত, তাহলে তারা সঙ্গে সঙ্গেই এই ভুল সংশোধন করেননি কেন?
গণতন্ত্র রক্ষার এই সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করতে, সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব ইউসুফ পাঠান এবং ললিতেশপতি ত্রিপাঠী, ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’-র শেষপর্যায়ে দলের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য পাটনায় পৌঁছেছেন। আমাদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সঙ্গীদের সঙ্গে, আমরা স্পষ্ট ভোটপদ্ধতি ধ্বংসের চেষ্টার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর তুলব।