অমর একুশে, ভুলিনি ভুলব না

একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির আবেগ ও রক্ত, লড়াই ও স্বপ্ন। বাংলা ভাষার জন্য এই সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত খুলে দেয় সব দেশের সম-ভাষাভাষীদের মুক্তির বাতায়ন। লিখছেন পৌলমী ভট্টাচার্য

Must read

‘‘প্রভাত ফেরি প্রভাত ফেরি আমায় নেবে সঙ্গে বাংলা আমার বচন আমি জন্মেছি এই বঙ্গে”…
— আল মাহমুদ
সবুজ গালিচা বিছানো ঘাসের দিকে মুখ তুলে চেয়ে আছে, একটা মস্ত বড় আকাশ। এই আমার বাংলাদেশ। এই আমার সাড়ে তিন হাত ভূমি। এই আমার মুঠো মুঠো শৈশব। আধো বোলের প্রথম মা ডাক৷ বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে, সারা পৃথিবীর বাংলাভাষী মানুষের মনের নিকানো উঠোনে তাই সকালের রোদ, আর বারান্দায় জ্যোত্স্নার চন্দন। অথচ, ১৯৪৭ সালের পরে সে ছবিতেই বাধ সাধলো আগ্রাসী ঘোষণা। দেশ ভাগের ফলস্বরূপ ততদিনে, বাংলা বিভক্ত। পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান মিলে নতুন রাষ্ট্র। যদিও, ভৌগোলিক ব্যাপ্তি আর সাংস্কৃতিক পরিসরের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। কিন্তু, সে আবেগে, সরাসরি ছুরিকাঘাত, ১৯৪৮ সালে মহম্মদ আলি জিন্নাহর ঘোষণা। ‘‘উর্দু, কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।” বাঙালি সত্তার মৌলিক অবস্থানের উপর স্পষ্টতই এমন আঘাত কাঙ্ক্ষিত ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই দানা বাঁধা আন্দোলনের ধিকি ধিকি ফুলকি সদ্য গঠিত রাষ্ট্রের এদিক-ওদিক। ১৯৫২ সাল। সে সময় নবগঠিত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ছিল বাঙালি, যারা মোট নাগরিকের প্রায় ৫৪%। দিনটা ছিল, ২১ ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুন (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ)। শুধুমাত্র উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রতিবাদে বাঙালি ছাত্ররা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সকাল নয়টা।
সেদিন, ছিল শাসকের জারি করা ১৪৪ ধারা। সে ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হতে শুরু করে অগণিত বাঙালি ছাত্র। সশস্ত্র পুলিশ বেষ্টিত ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সওয়া এগারোটার দিকে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভাঙার চেষ্টা শুরু করলে ছাত্রদের একটি দল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে দৌড়ে যায় এবং বাকিরা পুলিশ পরিবেষ্টিত ক্যাম্পাসে মিছিল করে। উপাচার্য পুলিশকে গুলি চালানো বন্ধ করতে এবং ছাত্রদেরকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দেন। ছাত্ররা সাময়িক ভাবে মেনেও নেয়। কিন্তু চলে যাবার সময়ই পুলিশ ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের অপরাধে গ্রেফতার করে কিছু ছাত্রকে। গ্রেফতারের সংবাদ পেয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা পূর্ব বাংলা গণপরিষদ অবরোধ করে সেখানে তাদের প্রস্তাব উপস্থাপনের দাবি জানায়। ছাত্রদের একটি দল বিল্ডিঙের মধ্যে দ্রুত ঢোকার চেষ্টা করলেই পুলিশ গুলি চালায় এবং তাতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার- সহ  নিহত হন আরও অনেকে। হত্যাকাণ্ডের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সারা শহর জুড়ে বিক্ষোভ তীব্র হয়। সে বিক্ষোভ রোখার মতো শক্তি শাসকের কোথায়! ষদিও দমন পীড়নের মাত্রা এরপর বেড়েছে বই কমেনি। ভাষার অধিকার যে স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিকে ধূমায়িত করেছে, তা কতটা বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় শাসকের চোখে ধরা পড়েছিল, সে বিতর্কে না গেলেও বলাই যায়, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন একটু একটু করে তৈরি হতে শুরু করে, মাতৃভাষার অধিকারকে সামনে রেখে সে সময় থেকেই। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে গাঁথা হয়ে যায় এক অনিবার্য মাইলস্টোন। মুখের ভাষার দাবি নিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ। বাহান্নর আন্দোলন, বস্তুতই  গোটা বাঙালি জাতিকে দাঁড় করিয়ে দেয়, একই মঞ্চে। এ যেন, অধিকার সচেতন এবং একই সঙ্গে আত্মসচেতনতারও পাঠ। একের পর এক দাবি আদায়ের অনুপ্রেরণা উঠে আসে। এ আন্দোলনের পথ ধরেই ছাত্রদের ১১ দফা, শেখ মুজিবের ছয় দফা ও ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সূত্রপাত। সে পর্যায়ের পথ ধরেই ৭১-এ স্বাধীনতা। একটি স্বাধীনতাকামী জাতির গণ জাগরণের ইতিহাসের সঙ্গে একুশের প্রেক্ষাপট তাই কেবল আবেগী উচ্চারণ নয়। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির একাঙ্গীভূত অধিকারের একটি শক্ত অবয়ব। যেখানে, আন্দোলনের গভীরতা ও আত্মত্যাগের মহত্ত্ব ছড়িয়ে আছে সাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশে।
২১ ফেব্রুয়ারির এই চেতনা এতটাই প্রবল ও ব্যাপক যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শহিদ মিনারের উপস্থিতি। দেশ ভাগের কাঁটাতার পেরিয়ে এপার বাংলায়ও মাঠে ময়দানে রাজপথ পাশে, ভাষা শহিদের স্মরণ। মধ্যরাত কিংবা ভোর থেকে ফুলহাতে মানুষ শহিদ মিনারের দিকে। সবার কণ্ঠে বাংলা ভাষা। ভাষা আন্দোলন আর বাঙালির ইতিহাসে অমর হয়ে যাওয়া সেই সুর—‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি…।’
প্রতি বছর ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এই প্রক্রিয়াটিকে নিছক আনুষ্ঠানিকতা আর বলাই যায় না। কারণ গত সাত দশকে একুশের ভাবাদর্শ গোটা জাতির মননে মিশে তা রীতির রূপ ধারণ করেছে; ইংরেজিতে যাকে বলে রিচুয়াল। যাকে কোনও মৌলবাদী আস্ফালন ভাঙতে পারে না কিছুতেই। বরং শিল্পীর উচ্চারণ প্রাণ পায়। ১৯৯৬ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে শিল্পী কবীর সুমন গানে গানে বলেন, ‘পুবের ওই উদ্বোধনে পশ্চিমেরও বোধন হোক/একুশে ফেব্রুয়ারি আমার আলো, আমার চোখ।’
 শিশু নারী বৃদ্ধ অশক্ত মানুষের এমন চাকবাঁধা লড়াইয়ের উদাহরণ বিশ্বে বিরল বলেই মাতৃভাষা উচ্চারণের মৌলিক অধিকারের উদ্ যাপন  বাংলাদেশের  সীমানা ছাড়িয়ে সত্যিই এখন  গোটা পৃথিবীর সম্পদ।
১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপিত হলে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানায়।  একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষা উচ্চারণের লালিত স্বপ্নে একজন পূর্ণ মানুষের জয়যাত্রার পথটি বিঘোষিত বলেই একুশের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে থাকে আজকের বিশ্ব। প্রভাতফেরির মিছিল আর কেবলমাত্র মামুলি জমায়েত থাকে না। হয়ে ওঠে, সব ক’টা জানালা খোলা মুক্তি আশ্বাসের টাটকা বাতাস। আগামী প্রাণ ভরে বেঁচে থাকে সেখানে।

Latest article