১টি নির্বাচন ও ৩টি চরিত্র

সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে জগাই-মাধাই ও গদাইদের মধ্যে এমন তিনজনকে বাস্তবে পাওয়া গেল যাঁদের সঙ্গে সপ্তদশ শতাব্দীর জাপানে উদ্ভূত এবং মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও সেই সূত্রে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা লাঙুলিত্রয়ীর প্রভূত সাদৃশ্য। আলোচনায় সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

গান্ধীজির সেই রূপকধর্মী বাঁদরত্রয়ীর কথা মনে আছে? ১৭শ শতকে জাপানে এরা অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তবে সেই জনপ্রিয়তা বিশ্বজনীন হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর সুবাদে। এই লাঙুলিত্রয়ীর একজনের চােখে হাত রাখা, সে খারাপ কিছু দেখতে চায় না। দ্বিতীয়জন হাত দিয়ে মুখ ঢেকেছে। সে কুকথা বলতে চায় না। আর তৃতীয় জনের কানে আঙুল। সে অকথা কুকথা শুনতে চায় না। শান্তি আর সহিষ্ণুতার প্রতীক এই বাঁদর তিনটি। এরা রূপকার্থে বোঝাচ্ছে, যদি কেউ অন্যায় বা অপরাধমূলক কোনও কিছু দেখতে না চায়, যদি কেউ পরনিন্দা বা অপরের প্রতি বিদ্বেষমূলক কোনও কিছু শ্রবণে অনাগ্রহী হয় এবং যদি কেউ কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষমূলক কিছু বলতে না চায়, তবে সেই ব্যক্তি ঔপনিবেশিক শাসন-নির্যাতন-অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। সেই সামর্থ্য তার আছে। কিন্তু যদি কেউ বাস্তবকে স্বীকার করবে না বলে চোখে হাত চাপা দেয়, যদি কেউ তথ্য-উপাত্ত দ্বারা সমর্থিত কোনও সত্যকে স্বীকার করতে না চায়, আর তাই কানে আঙুল দেয়, কিংবা যদি কেউ বেফাঁস সত্যি বলে ফেলার ভয়ে মুখে হাত চাপা দেয়, তাহলে কী হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না। উত্তরটা ঠিক কী হবে, সেটা বোঝা গেল এবারের লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর।
সেক্ষেত্রে অবস্থাটা হবে মোদি, সেলিম আর অধীর চৌধুরীদের মতো। অনিবার্য সত্যকে প্রাণপণে অস্বীকার করে গিয়েছেন শ্রবণে, দর্শনে, বচনে। আর তারই পরিণতিতে পর্যুদস্ত হওয়ার কলঙ্ক চিহ্ন আজ তাঁদের ললাটে।
মোদিজি সারাক্ষণ বলে গিয়েছেন, ‘আব কি বার ৪০০ পার’। সগর্বে উচ্চারণ করেছেন, এবার বাংলায় বিজেপি আশাতীত সাফল্য পেতে চলেছে। বারবার ঢাক পিটিয়েছেন। ফাঁকা জাতীয়তাবাদ আর ভুয়ো হিন্দু অস্মিতার। শুনতে চাননি বেকারের কান্না, দেখতে চাননি কৃষকের দুর্দশা, উচ্চারণ করতে চাননি কোনও জনকল্যাণকর প্রতিশ্রুতি। তার ফলে ৫৬ ইঞ্চি ছাতি চুপসে এখন ৩২ ইঞ্চির গেঞ্জিতে ঢুকে গেছে। ক’দিন আগে পরমাত্মার প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে প্রচার করা মোদি এখন নেহাতই ‘বায়োলজিক্যাল’। গোমড়া মুখে হাসির ঝলক টেনে সন্ধ্যারাতে দিল্লিতে দলের সদর দফতরে জয়ের কৃত্রিম আস্ফালন করতে তাঁকে শোনা গেছে বটে, তবে বুধবার তাঁর বাড়িতে এনডিএ বৈঠকের শেষে তিনি হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন, আর ইচ্ছে হলেই রাত ৮টায় ‘মিত্রোঁ’ বলে টিভি ভাষণ দিয়ে নোটবন্দির কথা ঘোষণা করা যাবে না, আর ইচ্ছে হলেই মধ্যপ্রদেশে দল ভাঙিয়ে সরকার গড়ে গোটা দেশে লকডাউন ঘোষণা করা যাবে না, আর সাংবাদিক বৈঠকে অনাগ্রহ প্রকাশ করে ‘গোদি মিডিয়া’কে ৮০-৮৫টা স্ক্রিপ্টেড ইন্টারভিউ গেলানো যাবে না। তাঁর হাতে কিংবা অমিত শাহর হাতে আর রাশটা নেই। সেটা চলে গিয়েছে পাটনায় আর হায়দরাবাদে। বিরোধী তো দূর অস্ত, নিজের দলের নেতাদেরই বিশেষ একটা পাত্তা দিতেন না যে মোদি, তাঁকেই এবার রোজ সকালে, ‘কী নীতীশজি, কী খবর? কী নাইডুজি, কেমন আছেন?’ বলে খেজুড়ে আলাপ জুড়তে হবে। কারণ, ভোটের আগে তিনি সত্যি কথা শুনতে চাননি, সত্যি কথা বলতে চাননি, সত্যিকার অবস্থাটা দেখতে চাননি।
একই হাল ‘গণশক্তি’র ভুয়ো গ্যাস খাওয়া মহম্মদ সেলিমের। দলের সংগঠনের হাল দেখতে চাননি। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে সুবিধা পেয়ে মা-বোনেদের হাসির কলতান শুনতে চাননি। বিজেপি-তৃণমূলকে এক বন্ধনীতে রেখে বাচনিক বিদ্বেষ ছড়ানো যে অনুচিত, তাতে যে সাম্প্রদায়িক শক্তিই মদত পায়, এই সহজ সত্যটা বোঝার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। তৃণমূল কংগ্রেস যে সত্যিকার ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি, এই সত্যিটা বলতে পারেননি। তাই মহাশূন্যের ওপার থেকে ভেসে আসা গণসংগীত শুনতে হচ্ছে এখন। বঙ্গে বামের ভোট রামের কোল থেকে ফেরেনি। শূন্য শূন্যই রয়ে গিয়েছে। অবস্থান্তর হয়নি।

আরও পড়ুন- শেয়ার কেলেঙ্কারি : নেত্রীর ইস্যু নিয়ে সরব ইন্ডিয়া জোট

এবং তৃতীয় চরিত্র অবশ্যই অধীর চৌধুরী। একেবারে গ্রিক ট্রাজেডির প্রমিথিউস। বঙ্গ কংগ্রেসকে আলো দেখানোর নাটক করতে গিয়ে নিজেও অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছেন। তিনি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা কান পেতে শুনতে চাননি। সিপিএম ও সেলিমের হাত ধরার বিরূপ প্রভাব তাঁর দলের অভ্যন্তরে কী হচ্ছে, সেটা দেখতে পাননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জননেত্রী হিসেবে জনকল্যাণী ভূমিকার প্রতি সদর্থক সমর্থন দিতে অনাগ্রহী হয়েছেন। গ্রিক পুরাণের প্রমিথিউস যেমন জিউসকে নস্যাৎ করে নিজের পতন অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলেন, সেভাবেই দিল্লির হাইকমান্ডকে অযৌক্তিকভাবে অগ্রাহ্য করে এরাজ্যে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা না করতে চেয়ে নির্বাচনী বিপর্যয়কে অনিবার্য করে তুলেছেন এবং এখন কাঁদুনি গাইছেন।
৬ জুন, ২০২৪-এর দলীয় মুখপাত্রের উত্তর সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘ঘরে আগুন লাগলে আগে লক্ষ্য থাকে ঘর রক্ষা করা। ঘর বাঁচলে তবেই না নতুন করে ঘর সাজানোর পরিকল্পনা করা সম্ভব।’ এই সহজ সত্যিটা বোধ হয় জগাই-মাধাইদের মনে নেই।
সেখানেই লেখা হয়েছে, ‘একটা হিটলার সমগ্র জার্মানির মানুষকে একভাবে পরিচালিত করতে পারেনি দীর্ঘদিন। ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে জায়গা হয়েছে তার।’ এবারের লোকসভা নির্বাচন এই কথাটাই গেরুয়া গদাই বাবুদের মনে করিয়ে দিল।

Latest article