আমাদের মস্তিষ্ক গোটা দেহের চালিকাশক্তি। যাবতীয় চালচলন বা কাজকর্মের সামগ্রিক নির্দেশ আসে মস্তিষ্ক থেকেই। মাথার খুলির মধ্যে থাকা প্রায় চোদ্দশো গ্রাম ওজনবিশিষ্ট মস্তিষ্ক নামের এই অঙ্গের মধ্যে রয়েছে সতেরো হাজার কোটি কোষ! এবং তারও অনেক বেশি নিউরোনীয়-সংযোগ। সুতরাং ওইটুকু একটা জায়গার মধ্যে কী জটিল প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে, সেটা ভাবলে অবাক না হয়ে উপায় থাকে না। আর ওইসব প্রক্রিয়ারই বাহ্যিক রূপ আমাদের চিন্তাভাবনা বা মানবিক আবেগের নানাবিধ প্রকাশ। এবং আমাদের স্মৃতিও।
এই মস্তিষ্কের অত বিপুল সংখ্যক কোষের মতোই কয়েকটা কোষ সম্প্রতি গবেষণাগারে তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা। শুনলে ব্যাপারটা সহজ মনে হলেও কাজটা মোটেই সহজ নয়। কারণ অত্যন্ত ক্ষুদ্র এই কোষগুলো (এক-একটার দৈর্ঘ্য ০.০২ সেন্টিমিটার, মানে ওরকম পঞ্চাশটা কোষ পাশাপাশি রাখলে দৈর্ঘ্য হবে এক সেন্টিমিটার) জীবিত এবং আসল মস্তিষ্কের মতোই এরাও সম্পূর্ণ কর্মক্ষম। এই কাজে যে প্রযুক্তি কাজে লেগেছে, সেটাকে বলে ‘থ্রি-ডি প্রিন্টিং’। এমনিতে আমরা জানি যে কাগজে বা কোনও পর্দার গায়ে প্রিন্ট করে যে কোনও ছবির অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করা যায়। আর এই থ্রি-ডি প্রিন্টিং (3d print) এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে প্রিন্ট হওয়া ত্রিমাত্রিক বস্তুটা অবিকল মূল বস্তুর প্রতিরূপ হিসেবেই বেরিয়ে আসে। ধরা যাক আমি যদি আমার ল্যাপটপের থ্রি-ডি প্রিন্ট (3d print) কপি বের করতে পারি সেটা দেখতে হবে অবিকল আমার এই ল্যাপটপটার মতোই, এমনকী ওর ভেতরকার পার্টসগুলো একেবারে মূল ল্যাপটপের ভেতরটার মতোই হবে। তবে থ্রি-ডি প্রিন্টিং পদ্ধতিতে তৈরি বস্তুর সঙ্গে এখনও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খুব একটা পরিচয় ঘটেনি। কারখানায় সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি তৈরির কাজে এই পদ্ধতি পশ্চিমি দেশগুলোয় বেশ ভালভাবেই কাজে লাগছে গত কয়েক বছর ধরেই। বিশেষ করে গাড়ি বা উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ তৈরির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি খুবই কাজের।
এই পদ্ধতিতে মস্তিষ্কের কোষের মতোই কয়েকটা কোষ তৈরি করেছেন যাঁরা, সেই বিজ্ঞানীরা কাজ করেন ‘ইউনিভারসিটি অভ উইসকনসিন-ম্যাডিসন’-এ। ওঁরা এই কোষ তৈরির জন্য ব্যবহার করেছেন স্টেম সেল। আমরা জানি যে এই স্টেম সেল হল দেহের বিশেষ কিছু কোষ, যেগুলো থেকে অন্য নানা ধরনের কোষ তৈরি করা যেতে পারে। আর এখানে পার্থক্য এটাই যে প্রথাগত থ্রি-ডি প্রিন্টিং ব্যবস্থায় প্রিন্ট হওয়া বস্তুটি তৈরি হয় নিচ থেকে ওপরের দিকে একের পর এক স্তর বা লেয়ার পরপর সজ্জিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে, অনেকটা যেমনভাবে ইট গেঁথে-গেঁথে বাড়ির দেওয়াল তৈরি হয়। আর ওঁরা এই কোষগুলো তৈরি করেছেন পাশের দিকে স্তরের পর স্তর সাজিয়ে, যাকে ইংরেজিতে বলে সাজানো হয়েছে ‘হরাইজন্টালি’।
আরও পড়ুন- একই পরিবারের ৫ জনের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার বিজেপি রাজ্যে
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, ওঁদের তৈরি ওই কোষগুলোর মধ্যে নিউরন সংযোগও স্থাপিত হয়েছে সফলভাবে। মস্তিষ্কের দুটো কোষের মধ্যে এই সংযোগ স্থাপিত হওয়ার মধ্যে দিয়েই আমাদের দেহে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বার্তা প্রেরিত হয়। ওই বিজ্ঞানীদলের তৈরি এই কোষগুলো শুধু বার্তাই নয়, একত্রিত হয়ে কোনও কাজও যেমন করতে পারছে তেমনই পাশাপাশি যুক্ত থাকা অন্য কোনও কোষকে কাজের জন্য নির্দেশও দিতে পারছে। এই বিজ্ঞানীদের এখন আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। ওঁরা বলছেন যে খুব শিগগিরি ওঁরা মস্তিষ্কের যে কোনও অংশের কোষ ইচ্ছে করলেই তৈরি করতে পারবেন। শুধু কোষ নয়, ওঁরা পারবেন নিউরনও তৈরি করতে। এতে সুবিধে হবে এটাই যে বিভিন্ন মানসিক অসুখে আক্রান্ত মানুষের মস্তিষ্কের কোষে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে যায়, সেগুলো জানা গেলে ওঁরাও সেইরকম পরিবর্তিত কোষ তৈরি করতে পারবেন এবং তখন সেই অসুখের চিকিৎসা কীভাবে আরও ভাল উপায়ে করা যায়, সে ব্যাপারে গবেষণা চালানো সহজ হবে। ওঁরা আরও জানাচ্ছেন যে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা হারিয়ে যায় বা কমে যায় এমন যেসব রোগ, যেমন অ্যালঝাইমার্স বা পারকিনসন্স ডিজিজ, সেগুলোর চিকিৎসায় এই কৃত্রিম কোষ কাজে লাগবে।
শেষে এটাই বলার যে, আগামী দিনে মানব-মস্তিষ্কের থ্রি-ডি (3d print) প্রতিরূপ বা মস্তিষ্কের অবিকল যান্ত্রিক প্রতিরূপ তৈরির কাজে এই গবেষণা এক ধাপ এগিয়ে যাওয়াই বলে ধারণা ওই বিজ্ঞানী-দলের। আর সেরকম ঘটলে আমাদের মৃত্যুর পরেও আলাদা জায়গায় (সে কম্পিউটার প্রোগ্রাম হিসেবে হোক বা কাচের জারে কৃত্রিমভাবে জিইয়ে রেখেই হোক) আমাদের মস্তিষ্ককে টিকিয়ে রাখা যাবে, যার মধ্যে রয়ে যাবে এই গোটা জীবন ধরে সঞ্চিত হওয়া যাবতীয় আবেগ আর স্মৃতির ভাণ্ডার। সেই মস্তিষ্কের সঙ্গে ইচ্ছেমতো যোগাযোগ করা যাবে, আর আগামী প্রজন্মের কেউ এসে সেই মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে অতীতের কথা জেনেও নিতে পারবে।
দেহহীন, প্রাণহীন একটা কাচের জারে শুধু মাথার মস্তিষ্কটুকুকে টিকিয়ে রাখবার সেই অনাগত দিন কি সত্যিই সুখকর হবে?