ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি। সোজা কথায় বিভাজনের রাজনীতি। সেটাই বিজেপি সরকারের ইউএসপি। এই নীতিতে হেঁটেই বিজেপি বছরের পর বছর দেশের বুকে রাজত্ব চালাচ্ছে। শুনলে অবাক হবেন, দেশের মাত্র এক পঞ্চমাংশ রাজ্যে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ। অর্থাৎ পাঁচ ভাগের চার ভাগ রাজ্যেই বিজেপি সংখ্যালঘু বা বিজেপি নেই। তা সত্ত্বেও ১৮টি রাজ্যে তারা ক্ষমতায়। সারাদেশে তারা রাজ করছে শুধু ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি অ্যাপ্লাই করে। ভোটে গোহারা হেরেও ক্ষমতার অলিন্দে বিরাজ করছে সেই হেরোরাই।
আরও পড়ুন-তুঘলকি আচরণ কমিশনের! ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিযুক্ত সহায়কে সরিয়ে ডিজিপি করা হল সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে
কিন্তু এভাবে আর কতদিন! আর কতদিন অপরকে ভাঙিয়ে নির্লজ্জভাবে সরকার চালিয়ে যাবে বিজেপি! এবার শেষ হোক গণতন্ত্র বিনাশকারী বিভাজনের এই রাজনীতি। বিজেপির এই অপারেশন লোটাসে দেশের গণতন্ত্র আজ বিপন্ন, বিপন্ন সংবিধান। এই অবস্থায় নতুন করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে। সময় এসেছে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসিকে দুরমুশ করে নতুনভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার, সংবিধান রক্ষা করার।
এবার আপনাদের সামনে তুলে ধরছি ছোট্ট একটা পরিসংখ্যান। ৩১টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র ৬টিতে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে বিজেপির। এই ছোট্ট পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, দেশের জনমত বিজেপির পক্ষে নেই। গত পাঁচ বছরে ৩১টি বিধানসভার ভোটে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতেছে মাত্র ছ’টিতে। কিন্তু সরকারে আছে ১৮ রাজ্যে। কী করে তা সম্ভব হল, অবাক হচ্ছেন তো? সেটাই একবার ভেবে দেখুন! আসলে দল ভাঙিয়ে সরকার গড়ার খেলায় বিজেপি নিজেদেরকে একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে চলে গিয়েছে। ফলে ভোটে না জিতেও তারা সারা দেশে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। অর্ধেকেরও বেশি রাজ্যে ক্ষমতার অলিন্দে বিরাজ করছে।
আরও পড়ুন-বাংলা-বিরোধী বিজেপির মেরুদণ্ড দিয়ে বইছে ভয়ের স্রোত, কালই বসিরহাটে সভা অভিষেকের
এটা ঠিক, এই খেলা শুরু করেছিল কংগ্রেসই। তবে কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধীই আবার দলবদলের খেলা বন্ধ করতে দলত্যাগ বিরোধী আইন চালু করেছিলেন। সেই আইনের অনেক ফাঁকফোকর পরবর্তীকালে সামনে আসে। তবে লক্ষণীয়, ২০১৪-তে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দল ভাঙানোর খেলায় হাত পাকিয়েছে বিজেপি। এই কাজে এতটাই সিদ্ধহস্ত যে, দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস তাদের টিকিও পায় না। এই নোংরা রাজনীতিতে তাদের আটকায় কার সাধ্যি!
আরও পড়ুন-সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে লোকসভা ভোট করার দাবি তৃণমূলের
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের ৩১টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র ছটিতে বিজেপির স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও ১৮টি রাজ্যে না হয় বিজেপি ক্ষমতা ভোগ করছে, কিন্তু মাত্র ছ’টি রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে কীভাবে তারা দেশের সাধারণ নির্বাচনে নিজেদেরকে এতটা শক্তিশালী অবস্থায় নিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে? একবার ভেবে দেখুন, সিকিম, মিজোরাম, তামিলনাড়ুতে বিজেপির কোনও আসন নেই। অন্ধ্রপ্রদেশে ১৭৫টির মধ্যে মাত্র চারটি আসন তাদের দখলে, কেরলে ১৪০টির মধ্যে মাত্র একটি আসনে জয়ী বিজেপি। এছাড়া পঞ্জাবে ১১৭টির মধ্যে মাত্র তিনটি আসনে, তেলেঙ্গানায় ১২৯টির মধ্যে পাঁচটি আসনে, দিল্লিতে ৭০টির মধ্যে আটটি আসনে, ওড়িশায় ১৪৭টির মধ্যে দশটি আসনে, নাগাল্যান্ডে সাতটির মধ্যে ১২টি আসনে বিজেপি রয়েছে। আর বাংলায় বিজেপি রয়েছে ২৯৪টির মধ্যে ৭৪টি আসনে।
এ তো গেল, বিজেপি যে সমস্ত রাজ্যে ক্ষমতায় নেই, তার পরিসংখ্যান। যে রাজ্যগুলিতে বিজেপি জোট সরকারে আছে সেখানে বিজেপির প্রাপ্ত আসনের অবস্থানটাও একবার ফিরে দেখা দরকার। মেঘালয়ে ৬০টির মধ্যে বিজেপি মাত্র দুটি, বিহারে ২৪৩টির মধ্যে ৭৪টি, জম্মু-কাশ্মীরে ৮৭টির মধ্যে ২৫টি, গোয়ায় ৪০টি আসনের মধ্যে ১৩টিতে রয়েছে বিজেপি। সারা দেশে মোট ৪১৩৯টি বিধানসভা আসনের মধ্যে বিজেপির আসন সংখ্যা সাকুল্যে ১৫১৬টি। তার মধ্যে ৯৫০টি আসনই গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের মতো ছ’টি রাজ্যে। অর্থাৎ বাকি ২৫টিতে মাত্র ৫৬৬টি আসন রয়েছে তাদের। এই তো বিগত ১০ বছরে কেন্দ্রের শাসক বিজেপির হাল! এই পরিসংখ্যানই বলছে, বিজেপির কোনও ঢেউ বা ঝড় নেই দেশে। পুরোটাই ঢক্কানিনাদ। শুধু বিভাজনের খেলা আর ক্ষমতা কায়েম করার অপচেষ্টা। একথা ভুললে চলবে না যে, আজও বিজেপি দেশের ৬৬ শতাংশ আসনে হেরে রয়েছে।
আরও পড়ুন-তুঘলকি আচরণ কমিশনের! ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিযুক্ত সহায়কে সরিয়ে ডিজিপি করা হল সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে
কর্নাটক হাতছাড়া হওয়ার পর দক্ষিণ ভারত এখন বিজেপি-মুক্ত। গেরুয়া শিবিরের সবচেয়ে ভাল উপস্থিতি এখন উত্তর-পূর্ব ভারতে, যেখানে আবার ২০১৬-র আগে দলের কার্যত অস্তিত্বই ছিল না। দেশের বাকি অংশে পদ্ম শিবিরের উপস্থিতি ক্রমশ ফিকে হচ্ছে। তবে নির্বাচনে হেরেও সরকার গড়াতে তারা নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করেছে অপারেশন লোটাস অর্থাৎ দল ভাঙানোর খেলায়। তাই মাত্র ছ’টি বিধানসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ১৮টি রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। দেশের জনমত বিজেপির পক্ষে নেই। এবার জনতা জনার্দন ভাবুন আসন্ন ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে আপনারা কী করবেন? বিজেপিকে আবার ক্ষমতায় আসার জায়গা করে দেবেন নাকি ছুঁড়ে ফেলে দেবেন আরব সাগরে?
আরও পড়ুন-তুঘলকি আচরণ কমিশনের! ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিযুক্ত সহায়কে সরিয়ে ডিজিপি করা হল সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে
মনে রাখবেন, বিজেপি লোকসভা ভোটের আগে সুপরিকল্পিতভাবে সিএএ লাগু করে বিভাজনের তাস খেলতে শুরু করে দিয়েছে। এমনকী সিএএ লাগু করার আগে তারা আধার কার্ড বাতিলের এক নোংরা খেলায় মেতেছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া হুঁশিয়ারিতে এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপে বিজেপি সরকার আধার বাতিলের চক্রান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলে এসেছেন, বিজেপি বাংলা-বিরোধী, বাঙালি-বিরোধী। বিজেপি বিভাজনের রাজনীতির উপর নির্ভর করে ভোটে জেতা এবং ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করে। আর তৃণমূল জনকল্যাণ ও উন্নয়নের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। এই মর্মে মুখ্যমন্ত্রীর স্পষ্ট বার্তা, রাজবংশী, নেপালি, গোর্খা, তফসিলি, আদিবাসী, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন বা অন্য যে কোনও সম্প্রদায়ের মানুষই হোক না কেন, আমি তাঁদের জন্য আছি। আমরা প্রতিটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে আছি। কিন্তু বিজেপি একজন শিখ অফিসারকে খালিস্তানি বলে। মুসলিম ভাইদের পাকিস্তানি বলে। দলিত ও তফসিলিরা নির্যাতিত হয় বিজেপির শাসনে। সংখ্যালঘু ভাইদের সম্প্রতি দিল্লিতে একজন পুলিশ লাথি মেরেছে। মণিপুরে মহিলাদের বিবস্ত্র করে হাঁটানো হয়েছিল, বিজেপি তা থামাতে কিছুই করেনি, আগুন জ্বলেছে মণিপুরে। বিজেপির এই ধ্বংস ও বিভাজনের রাজনীতি থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। ফেরাতে হবে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। আসন্ন ২০২৪-এর নির্বাচনে সেটাই হোক একমাত্র লক্ষ্য।