মোদি সরকারের ৯৬ মাস অর্থনীতির নাভিশ্বাস

কালো টাকা ফেরত এল না। জিএসটি অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে। টাকার দাম অধোমুখী— সব মিলিয়ে অর্থনীতির বেহাল দশা আর বিজ্ঞাপনী চমকে আড়াল হচ্ছে না। লিখছেন কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

Must read

যে তিনটি বিষয়ে মোদি সরকার তার আট বছরের সাফল্য দাবি করে সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে তা হল— সেবা, সুশাসন ও গরিব কল্যাণ। অথচ এই তিনটি বিভাগেই সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে ঘরে-বাইরে সমালোচনার ঝড় উঠছে। এই স্বল্প পরিসরে যেহেতু তিনটি বিষয়ে আলোচনা সম্ভব নয়, তাই সুশাসন নিয়েই লেখাটিতে সীমাবদ্ধ থাকলাম। তবে সুশাসনের মধ্যেও শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সুশাসন নিয়েই দু-একটা দিক তুলে ধরছি। এটি যে সুশাসন নয়, চরম অপশাসন তাই নিবন্ধটির মর্মার্থ।

আরও পড়ুন-হারানো দিনের স্মরণীয় নায়িকা

এখনও পর্যন্ত নোটবন্দির ফলে বিদেশ-গচ্ছিত কালো-টাকা যে ফেরত আসেনি তা সকলেই জানেন। কারও ব্যাঙ্কের বইয়ে একটা পয়সাও সরকার দেয়নি। দেশে সমান্তরাল অর্থনীতিতে রাশ টেনে কালো-টাকার উৎসও বন্ধ করা যায়নি। নোটবন্দিতে অর্থনীতিতে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তিন হয়নি। ডিজিটাল লেনদেন নোটবন্দি না করেও করা যেত। বস্তুত নোটবন্দির সঙ্গে ডিজিটাল লেনদেনের প্রসারের কোনও সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধিও প্রামাণিত হয়নি। এটি নীতি প্রয়োগের একটি চরম ব্যর্থতা।

আরও পড়ুন-তীজন বাঈ পাণ্ডবানী

আরও একটি ভয়ঙ্কর নীতি-দুর্বলতা হল মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরাতে ব্যর্থ হওয়া। রিজর্ভ ব্যাঙ্ক বলছে, মূল্যবৃদ্ধির কারণ হল বাজারে অতিরিক্ত নগদের জোগান। সেই বাস্তবে দেখুন মানুষের হাতে টাকা নেই। নতুম কর্মসংস্থান নেই। চাকরি চলে গেছে। গত ৪৫ বছরে সর্বাধিক বেকারত্বের হার। উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমেছে। আসলে নগদের জোগান অতিরক্ত মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে, জিনিসপত্রের জোগান কম হওয়ার জন্য। অর্থনীতির ভাষার সাপ্লাই সাইডের ঘাটতি। সেদিকে না তাকিয়ে সুদের হার বাড়িয়ে এই অতিরিক্ত নদগের জোগান কমানোর যে চেষ্টা চলছে তাতে যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি মার খাবে, আরও বেকারত্ব বাড়বে। সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। জুন মাসেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস আরও এক দফা সুদের হার বাড়াতে চলেছেন। জমি, বাড়ি, গাড়ি কেনার ইএমআই গুনতে হবে চড়া হারে।

আরও পড়ুন-পুতুল-গ্রাম

মোদি জামানার সুশাসনে আমরা দেখলাম, আয়কর-সংক্রান্ত রির্টান বা অন্য কোনও তথ্য সাইটে আপলোড করা যাচ্ছে না। দিনের পর দিন ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে, ব্যাঙ্ক ঋণের আবেদন করা যাচ্ছে না। কারণ সাইট কাজ করছে না। এর দায় নির্মলা সীতারামণ এক বহুজাতিক সংস্থার ঘাড়ে চাপিয়েই চুপ করে বসেছিলেন। ভারত যেখানে সফটওয়্যার রফতানিতে বিশ্বের এক নম্বর, অন্যদেশকে এক্সপার্ট বা বিশেষজ্ঞ-পরামর্শ দেয়, সেখানে ভারতের সরকারেরই এই বিষয়ে মুখ থুবড়ে পড়া লজ্জার বিষয়।

আরও পড়ুন-শাশুড়ি জামাই সংবাদ

শঙ্কার মেঘ দেখা যাচ্ছে শেয়ার বাজারেও। তিরশ জন বিনিয়োগ-বিশেষজ্ঞকে নিয়ে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স একটা সমীক্ষা করে বলেছে— সুদবৃদ্ধির কারণে আর্থিক বৃদ্ধি ধাক্কা খেলে শিল্পসংস্থাগুলির আয় ও মুনাফা কমে যাবে। তারই বিরূপ প্রভাব পড়বে শেয়ার বাজারে। ২০১৫ সালের পর এই প্রথম ২০২২-এ শেয়ারসূচক নজিরবিহীনভাবে পতনের মুখ দেখতে পারে। যার অন্যতম কারণ, ভারত থেকে বিদেশে লগ্নিকারী সংস্থাগুলির পুঁজি তুলে নেওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে। চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশি সংস্থাগুলি ১.৭১ লক্ষ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে। এই মে মাসেও ভারতের শেয়ার বাজার প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বিদেশিলগ্নি হারিয়েছে। ভারতের বাজারে আস্থা কমে অস্থিরতা বেড়েছে।
এই যে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে লগ্নি সরানোর প্রবণতা, শেয়ার বাজারে টানা লোকসান, মূল্যবৃদ্ধির অস্বাভাবিকতার প্রভাব, সুদের হার বৃদ্ধি, অশোধিত তেলের চড়া দর ও যোগদানের ঘাটতি, ভারত থেকে ডলার বেরিয়ে যাওয়ার ধাক্কা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে ডলারের সাপেক্ষে টাকার দামের অবমূল্যায়নের ওপর। বর্তমানে এক ডলারের দাম হয়েছে ৭৭.৭১ টাকা। নিট হিসাবে টানা ৫ মাস কমেই চলেছে। এর আগে কখনও এত নীচে নামেনি টাকার দর। বিশ্ববাজারে মোদি সরকারের অর্থনীতির ওপর আস্থা কমার এটিও একটি সূচক হিসাবেই ধরা হবে।

আরও পড়ুন-আলবিদা…

মোদি জামানার আর্থিক সুশাসনের ঢাক পেটানো হচ্ছে জিএসটির নতুন আইন প্রণয়নের কথা বলে। এটা আসলে ভারতীয় কর ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে রাজ্যগুলির হাত থেকে কর সংগ্রহের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার একটা নির্লজ্জ ব্যবস্থা। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে সংবিধান সংশোধন করে রাজ্যগুলিকে ২০২২ পর্যন্ত জিএসটির নতুন আইন প্রণয়নের কথা বলে। এটা আসলে ভারতীয় কর ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে রাজ্যগুলির হাত থেকে কর সংগ্রহের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার একটা নির্লজ্জ ব্যবস্থা। আইন অনুযায়ী রাজ্যগুলির কর আদায়ের পরিমাণ ১৪%-এর কমে হলে, বাকিটা কেন্দ্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুষিয়ে দেবে। একমাত্র ওড়িশা ছাড়া আর কোনও রাজ্যেরই ১৪% কর আদায়ে বৃদ্ধি হয়নি। তাই কেন্দ্র মে মাস পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ মিটিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এই জুন মাস থেকে কেন্দ্র আর ক্ষতিপূরণ দেবে না। কিন্তু ক্ষতি তো হয়েই চলবে। রাজ্য এই ক্ষতি মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

আরও পড়ুন-পাশের হারে এগিয়ে রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ-সহ অনেকগুলি রাজ্য জিএসটি কাউন্সিলে ক্ষতিপূরণ বৃদ্ধির সময়সীমা বাড়ানোর দাবি তুললেও কেন্দ্র কর্ণপাত করছে না। ইন্ডিয়া রেটিংস-এর একটি পরিসংখ্যান বলছে জিএসটি চালু হওয়ার আগে রাজ্যগুলির নিজস্ব করবাবদ আয়ের মধ্যে স্টেট জিএসটির পরিমাণ যা ছিল, জিএসটি চালু হওয়ার পর তা মোটামুটি একই আছে। অর্থাৎ জিএসটি চালু হওয়ার ফলে রাজ্যগুলির বিন্দুবিসর্গ লাভ হয়নি। এত ঢাক পিটিয়ে জিএসটি চালু করেও কার্যত কোনও বদল দেখা যায়নি। পাশাপাশি, আগের কর ব্যবস্থায় রাজ্য-জিএসটি আদায় বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৭%। যে-সমস্ত পণ্য ও পরিষেবা জিএসটিতে অর্ন্তভুক্ত হয়েছে, সেগুলি ধরলে আগের জমানায় বৃদ্ধির হার ছিল ৯.৮%। রাজ্যের আদায় বাড়াতে জিএসটি যে কোনও রকম সাহায্য করেনি, তা এটা থেকেই প্রমাণিত। জিএসটি নীতি প্রণয়ন আসলে যে অশ্বডিম্ব প্রসব তা এখন বোঝা যাচ্ছে।

Latest article