ডাঃসুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনকাহিনি একেবারেই যেন ‘সিনেমায় যেমন হয়’। বস্তুত সাহিত্যিক এবং চলচ্চিত্রনির্মাতাও তাঁর জীবন-সূত্র থেকে নেওয়া আখ্যান পুরো নিতে পারেননি; তাঁরা দেখিয়েছিলেন এই চিকিৎসক-গবেষক ছিলেন কুষ্ঠের প্রতিষেধকের উদ্ভাবক। আসলে তাঁর গবেষণার বিষয় এতটাই নতুনরকম ছিল যে সেই সময়ে তা বুঝে ওঠা সম্ভবপর ছিল না। সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৯৭০-এর দশকে টেস্টটিউব-বেবি নিয়ে গবেষণা করতেন। সেটা এমন এক সময় যখন ইন্টারনেটের কল্যাণে যেকোনও বিষয় হাতের তালুর মধ্যে পাওয়ার সুযোগ ছিল না। প্রয়োজনীয় বই বা জার্নাল বিদেশ থেকে আনানো সহজ ছিল না, চটজলদি জানা যেত না পৃথিবীর কোথায় কীভাবে এই বিষয়ে চর্চা চলছে। এরকম সময়ে বহু কষ্ট করে জার্নাল আনিয়ে পড়াশোনা করতেন তিনি আর কাজ করতেন নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে। গবেষণার জন্য অর্থও নিজের উপার্জন থেকেই ব্যয় করতে হত। কারণ সেটা এমন এক সময় যখন দেশে তো বটেই, সারা পৃথিবীতেই গবেষণার মূল জোর ছিল জন্মনিয়ন্ত্রণে, আর সুভাষ মুখোপাধ্যায় গবেষণা করছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্যে কৃত্রিমভাবে শিশুর জন্ম দেওয়ার জন্য।
আরও পড়ুন-নিট ঘোটালায় বিজেপি নেতা, সুপ্রিম কোর্টে ভর্ৎসনা
অর্থ এবং প্রয়োজনীয় জ্ঞানসম্পদ পাওয়ার সমস্যা তিনি হয়তো নিজের চেষ্টায় সামলাতে পেরেছিলেন কিন্তু সামলাতে পারেননি ক্ষমতাতন্ত্রকে। তাঁকে বারবার বদলি করেছে বামফ্রন্ট সরকার। বিদেশ থেকে কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ এসেছে অথচ সরকার তাঁকে ছুটি দেয়নি, প্রয়োজনীয় ‘নো অবজেকশন’ দেয়নি। তিনি কাজ করতেন কলকাতায়। সেই কাজে বিঘ্ন ঘটানো হল তাঁকে বাঁকুড়ায় বদলি করে দিয়ে। সাড়ে চার বছর পরে তাঁকে আর জি করে ফিরিয়ে আনা হল ‘স্বাস্থ্যের কারণে সহানুভূতি দেখিয়ে’। কিন্তু আর জি করে তাঁকে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে হত আর তা ছিল তাঁর দক্ষিণ কলকাতার বাড়ি থেকে অনেক দূরে। তিনি চেয়েছিলেন একতলায় ফিজিওলজি বিভাগ রয়েছে এমন কোনও হাসপাতালে বদলি করা হোক। কিন্তু এবার হৃদরোগী সুভাষকে বদলি করা হল রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমোলজিতে, যেখানে কোনও লিফট ছিল না, সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠতে হত আর কাজের কোনও সুযোগও ছিল না। এই বদলির পরেই তিনি স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেন।
তবে তাঁর মৃত্যুর আসল কারণ তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা। তাঁর টেস্টটিউব-বেবি সৃষ্টির দাবিকে খতিয়ে যে সরকারি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল তার নেতৃত্বে কোনও চিকিৎসক ছিলেন না; চেয়ারম্যান ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওফিজিক্সের অধ্যাপক! কমিটি রায় দিয়েছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দাবির সমর্থনে উপযুক্ত প্রমাণ মেলেনি। তাঁর দাবি ‘অবিশ্বাস্য’ এবং ‘হাস্যকর’। কাজেই তিনি একজন ‘প্রতারক’।
আরও পড়ুন-কলকাতার ট্রামে জুড়ল অস্ট্রেলিয়ান পর্যটন
সুভাষ মুখোপাধ্যায় ঠিক কী করেছিলেন জানেন? তিনি শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মিলন ঘটিয়েছিলেন দেহের বাইরে। নামে টেস্টটিউব বলা হলেও এই মিলন টেস্টটিউবে ঘটানো হয় না, ঘটানো হয় একটা চ্যাটানো পাত্রে। আজ ‘ইন ভিট্রো ফার্টিলিটি’ (আইভিএফ)-এর প্রসারের যুগে একথা তথ্যাভিজ্ঞরা জানেন যে দেহের বাইরে নিষেক ঘটিয়ে যে ভ্রূণ তৈরি করা হয় তা প্রতিস্থাপন করা হয় মাতৃজঠরে। এই পদ্ধতি যত সহজে বলা হল বিষয়টা ঠিক ততটা সহজ নয়। প্রথমত, নারীদেহে প্রতি মাসে একটি ডিম্বাণু উৎপন্ন হয়, সেই একটিমাত্র ডিম্বাণু দেহ থেকে বের করে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলন ঘটালে যে সাফল্যের সম্ভাবনা থাকে তা অনেক বাড়ানো যায় একাধিক ভ্রূণ তৈরি করা গেলে। সেজন্য ডিম্বাণুর উৎপাদন বাড়ানো দরকার। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? সেই পদ্ধতিরও উদ্ভাবক ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তিনিই প্রথম টেস্টোস্টেরোন হরমোন প্রয়োগ করে নারীর ডিম্বাণু উৎপাদন বাড়ানোর কাজ করেছিলেন, অথচ এই হরমোনের পরিচিতি পুরুষ হরমোন হিসেবে। একাধিক ডিম্বাণু সংগ্রহ করার পর নিষেক ঘটিয়ে একাধিক ভ্রূণ জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করার এবং ডিম্বাশয় থেকে যোনিপথে ডিম্বাণু বের করার পদ্ধতিও তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন। তাঁর উদ্ভাবিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল, যে-মাসিকচক্রে নারীদেহের ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হল সেই চক্রেই নারীর জরায়ুতে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন না করে তা কিছুদিন হিমায়িত অবস্থায় রেখে জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা। আর এক্ষেত্রে ডাঃ মুখোপাধ্যায়কে তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের কড়া প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাঁকে প্রশ্ন কড়া হয়েছিল আটাত্তর সালের কলকাতায়, লোডশেডিংয়ের শহরে তিনি কীভাবে রেফ্রিজারেটরে ভ্রূণ সংরক্ষণ করলেন? তিনি যখন বললেন যে তিনি তরল নাইট্রোজেনে ভ্রূণ হিমায়িত রেখেছিলেন তখন প্রশ্ন উঠল, ভ্রূণ হিমায়িত অবস্থায় রাখলে তো ভ্রূণের আকার বেড়ে যাবে। তখন অত লম্বা ভ্রূণ কীভাবে জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা যাবে? ডাঃ মুখোপাধ্যায় বললেন, হিমায়িত অবস্থায় অতি শীতল তরল নাইট্রোজেনে ভ্রূণের বৃদ্ধি হয় না। প্রশ্ন উঠল, তরল নাইট্রোজেন বাতাসে এলে তো বিস্ফোরণ ঘটে যাবে, তাহলে কীভাবে ভ্রূণ বের করা হল? সে জবাবও দিলেন সুভাষ। তিনি বললেন, বাতাসের সংস্পর্শে এলে তো বিস্ফোরণ হবে না, বরং তা বাতাসে মিশে যাবে ধূমায়িতরূপে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সকলের লক্ষ্য তো তাঁকে ঠগ প্রতিপন্ন করা!
সুভাষ মুখোপাধ্যায় শেষ অবধি সমাদর পেলেন তাঁর মৃত্যুর পরে। যিনি ভারতের প্রথম টেস্টটিউব-বেবির স্রষ্টা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন সেই ডাঃ আনন্দকুমার সুভাষের কাজের কাগজপত্র দেখে ঘোষণা করেন, তিনি নন, সুভাষই একাজে এদেশে পুরোধা। ১৯৭৮-এর ২৫ জুলাই ইংল্যান্ডে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল বিশ্বের প্রথম নলজাতক; আর সুভাষের সৃষ্টি দুর্গা আগরওয়াল পৃথিবীর আলো দেখেছিল ওই বছরেরই ৩ অক্টোবর। তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতি আজ সারা পৃথিবীতে অনুসৃত হয়। ইউরোপ-আমেরিকার প্রযুক্তি এদেশে আসার সঙ্গেই আমরা পরিচিত। কিন্তু এ হল ‘রিভার্স টেকনোলজি ট্রান্সফার’ যার জন্য আমাদের গর্বিত করেছেন তিনি, ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আর তাঁকে শেষ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুপ্ত জল্লাদের কাজ করেছে তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার।