জি-৭ সম্মেলন সেরে ইতালি থেকে দেশের বুকে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ইতালিতে অনুষ্ঠিত সেই জি-৭ সম্মেলনে গিয়ে স্বভাবসিদ্ধ আত্মপ্রচারের ভঙ্গিতে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন তাঁর ‘ঐতিহাসিক জয়’ আসলে ‘গণতন্ত্রের জয়’ ও ‘গোটা গণতান্ত্রিক দুনিয়ার জয়’। মোদিজি কথিত এই তথাকথিত গণতন্ত্রের যে পথচলার সূচনা হল সেই তথাকথিত গণতন্ত্রের আসল স্বরূপটিকে তুলে আনা জরুরি। গত ৪ জুন লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের দিনে খুবই সন্তর্পণে সমস্ত সংবাদমাধ্যমের নজর এড়িয়ে প্রকাশিত হল সর্বভারতীয় ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষা ‘নিট’-এর ফলাফল। ফলাফল প্রকাশের পরবর্তী সময় থেকেই আমরা দেখলাম ‘নিট’ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে একাধিক অনিয়ম, গরমিল ও দুর্নীতির খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই অনিয়ম, গরমিলগুলোকে সাধারণ চোখ দিয়ে দেখলেই স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় দুর্নীতির। প্রাথমিকভাবে তদন্তকারীদের অনুমান, কেলেঙ্কারির জাল ছড়িয়ে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, গুজরাত, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ-সহ একাধিক রাজ্যে এবং দুর্নীতির টাকার অঙ্ক হাজার কোটি ছাপিয়ে যাবে। তবে সাধারণ নাগরিক হিসাবে তীব্র হতাশার জায়গা এটাই যে, শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান পুলিশের তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই প্রশ্ন ফাঁস হয়নি বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন, আশঙ্কা হয় শিক্ষামন্ত্রীর এই বিবৃতিতে তদন্ত থমকে যাবে না তো?
লোকসভা নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন নির্বাচন কমিশনের বিধিনিয়মের তোয়াক্কা না করে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিরুদ্ধতার স্বর তুলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। লোকসভার ফলাফল প্রকাশের পর আমরা এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হলাম। বিজেপির নবনির্বাচিত ২৪০ জন সাংসদের মধ্যে একজনও মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নেই, রাজ্যসভাতেও বিজেপির কোনও মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নেই, এনডিএ জোটের যে মন্ত্রিসভা গঠিত হল তাতেও মুসলমান সম্প্রদায়ের কোনও প্রতিনিধিকে জায়গা দেওয়া হল না, অথচ ২০১১ সালের সর্বশেষ জনগণনা অনুসারে ১৭.২২ কোটি মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস আমাদের ভারতবর্ষে, যা মোট জনসংখ্যার ১৪.২ শতাংশ। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটি সম্প্রদায়কে রাজনৈতিকভাবে বহিষ্কার করে দেওয়ার মধ্য দিয়েই শুরু হল মোদিজির তথাকথিত গণতন্ত্রের জয়যাত্রা।
আরও বিস্ময়কর এক তথ্য উঠে আসে মোদিজির মন্ত্রিসভার ৭২ জন সদস্যের মধ্যে ২০ জনের অধিক সদস্য এমন পারিবারিক পরিধি থেকে উঠে এসেছেন যাঁদের পরিবারের খুব নিকট সদস্যরা পূর্বে কোনও কেন্দ্রের সাংসদ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বের পদ-সহ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীত্বের দায়িত্ব সামলেছেন। যে ভারতীয় জনতা পার্টি গোটা লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে পরিবারতন্ত্র নিয়েই বিরোধী কংগ্রেস-সহ আঞ্চলিক দলগুলোকে আক্রমণ করে গেল তাদেরই আসল স্বরূপ আজ দেশবাসীর কাছে প্রকাশিত হয়ে গেছে। পরিবারতন্ত্রের এক বৈশিষ্ট্য হল পরিবারতন্ত্র আমাদের সমাজের যে গতিশীলতা তাকে বদ্ধ করে দেয়, সাধারণ পরিবার থেকে লড়াই করে, সংগ্রাম করে যে ছেলেটি বা মেয়েটি ঊর্ধ্বমুখী সচলতার দিকে এগোতে চাইছে তাঁর পথকে রুদ্ধ করে দেয়। এই পরিবারতন্ত্র সর্বতোভাবেই গণতন্ত্রের পরিপন্থী।
আরও পড়ুন- মেয়র ও আমলাদের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সভামঞ্চ থেকে ভারতীয় জনতা পার্টির কোচবিহার জেলার সহ-সভাপতি দীপা চক্রবর্তী মঞ্চে উপস্থিত রাজ্য স্তরের নেতৃত্বের সামনেই লক্ষ্মী ভাণ্ডার প্রকল্প বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। ২০২৩ সালে প্রতীচী ট্রাস্ট নামক এক গবেষণা সংস্থা লক্ষ্মী ভাণ্ডারের প্রভাব নিয়ে সারা বাংলা জুড়ে যে গবেষণা চালিয়েছিল তাতে দেখা গেছে লক্ষ্মী ভাণ্ডারের প্রভাবে পরিবারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে মহিলাদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এক বৃহৎ অংশের মহিলারা লক্ষ্মী ভাণ্ডার থেকে তাঁদের প্রাপ্য টাকা ছোটখাটো বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। আসলে ভারতীয় জনতা পার্টির ৫৬ ইঞ্চির বুকের যে পুরুষতান্ত্রিক দাম্ভিকতা তা বাংলার মহিলাদের এই স্ব-শক্তীকরণকে মেনে নেয়নি। ভারতীয় জনতা পার্টি এবং তাঁদের এনডিএ জোট যে তীব্র নারীবিদ্বেষী তা তাঁদের মন্ত্রিসভা গঠনের সূচনা থেকেই স্পষ্ট, এনডিএ জোটের অন্যতম শরিক জে ডি (এস) দলের লোকসভা নির্বাচনে কর্নাটকের হাসান কেন্দ্র থেকে প্রার্থী ছিলেন কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়ার পৌত্র প্রজ্বল রেভান্না, যিনি বর্তমানে একাধিক ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত। তবে খুবই হতাশাব্যঞ্জকভাবে এই দেবেগৌড়ার পরিবারেরই সদস্য এইচ ডি দেবেগৌড়ার পুত্র ও ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত প্রজ্বল-খুল্লতাত এইচ ডি কুমারস্বামীকে পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুটি দপ্তরের, অথচ এনডিএ জোট সরকারে জেডি (এস) দলের নির্বাচিত সাংসদ সংখ্যা মাত্র দুই। আসলে ভারতীয় জনতা পার্টির গদি বাঁচানোর লড়াই এবং কর্নাটক রাজ্যে নিজেদের জায়গাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার তাগিদ এতটাই প্রকট যে, সেক্ষেত্রে মহিলাদের সম্ভ্রমের জায়গাটি গৌণ হয়ে গিয়েছে।
পশ্চিমবাংলার বুকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী-সহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলার বুকে ভারতীয় জনতা পার্টির ৩৫-এর উপর আসন পাবার অলীক স্বপ্নে বুঁদ হয়েছিলেন। ৪ জুন তাঁদের সেই স্বপ্নের বেলুন ফেটে যায়, ৩৫ নেমে আসে ১২-তে। তবে মোদিজির এই তথাকথিত গণতন্ত্রের সূচনাযাত্রাতে এটাই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ভারতীয় জনতা পার্টি বাংলাকে ও বাংলার মানুষকে কেবল ভোটার হিসাবেই দেখেছেন, অন্তর থেকে ভালবাসতে পারেনি, সেই কারণেই তো বঙ্গজননীর কোনও সন্তানের কপালে পূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্বভার জোটেনি। বাংলার ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা, নেত্রীদের প্রশ্নহীন ও অযৌক্তিক মোদিবন্দনা যে বাংলার মানুষ ভালভাবে গ্রহণ করেননি তা লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকেই স্পষ্ট। নিশ্চিতভাবে তাই বলা যায়, আগামী দিনে বাংলার মানুষ মোদিজির এই মিথ্যা গণতন্ত্রের মুখোশকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেবেন।