প্রতিবেদন : পশ্চিমবঙ্গকে অন্ধকারে রেখে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তির পুনর্নবীকরণ করার দিকে এগনোয় কড়া প্রতিক্রিয়া জানাল তৃণমূল কংগ্রেস। বাংলার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে কোনও অবস্থাতেই এভাবে বাংলাকে অন্ধকার রেখে এই ধরনের চুক্তি করা যায় না বলেই মত দলের। শুধু কড়া প্রতিক্রিয়া দেওয়াই নয়, সংসদের নতুন অধিবেশনের শুরুতেই এ-নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলবেন তৃণমূল সাংসদেরা। কেন ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করা হল না সেই প্রশ্নও তুলেছে দল। তৃণমূল কংগ্রেসের স্পষ্ট বক্তব্য, পড়শি দেশের সঙ্গে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে চুক্তির পুনর্নবীকরণ হচ্ছে অথচ যে রাজ্যের উপর দিয়ে গঙ্গা বয়ে গিয়েছে সেই বাংলাকে অন্ধকার রেখে এই চুক্তি হয় কীভাবে! সংসদের ভিতরে ও বাইরে এ-নিয়ে টানা প্রতিবাদ চালাবে তৃণমূল কংগ্রেস।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
এনডিএ সরকারের তুঘলকি সিদ্ধান্ত কোনও অবস্থাতেই মানা হবে না যেখানে বাংলার মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে। এখানে কোনও অবস্থাতেই এই ধরনের কাজকে সমর্থন করেন না মা-মাটি-মানুষের নেত্রী তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার জল-ফরাক্কা ব্যারেজ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করার আগে একবারও বাংলাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না প্রধানমন্ত্রী। এমনকী প্রবল বাংলা-দরদি হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করতে চাওয়া বিজেপি বাংলাদেশের সঙ্গে জল চুক্তির কথা শুরু আগে একবারও বাংলার মানুষের বন্যায় ভেসে যাওয়া, গঙ্গা ভাঙনে ভিটেমাটি হারানোর কথাও বিবেচনা করল না। শনিবার ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পরে মোদির এই সিদ্ধান্তের আবারও বঞ্চনার প্রতিবাদে সরব তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলেন, যে চুক্তি শুরু হয়েছিল বাংলার মধ্যস্থতায়, সেই বাংলাকেই পুনর্নবীকরণের সময় বেমালুম বাদ দিয়ে দিলেন মোদি, ঠিক যেভাবে কেন্দ্রের প্রকল্পের টাকা থেকে একের পর এক বাদ দিয়েছেন বাংলাকে। এখানেও বঞ্চনার সেই এক ছবি। অথচ এই ফরাক্কা ব্যারেজের জন্য একদিকে বন্যা, অন্যদিকে ভাঙন নিয়ে জেরবার হতে হয় এই বাংলাকেই। গঙ্গার ড্রেজিং না করার জন্য বাংলার বিপদ বাড়ে। ভাঙন ও বন্যা দুটিতেই প্রচণ্ড ক্ষতি হয় বাংলার জনজীবনের। এই ঘটনার এবার কেন্দ্রের কাছে জবাব চাইবে তৃণমূল কংগ্রেস। শনিবার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী জানান, ১৯৯৬ সালের গঙ্গা জল চুক্তি পুনর্নবীকরণ করার জন্য প্রযুক্তিস্তরের কথাবার্তা শুরু করার বিষয়ে আমরা ঐকমত্য হয়েছি। এই চুক্তি অনুযায়ী, দু-পক্ষের সহমতে এই চুক্তি পুনর্নবীকরণ করা সম্ভব। আর এতেই প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূল কংগ্রেসের স্পষ্ট বক্তব্য, সংবিধানের ২৫৩ ধারা অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যে কোনও বিষয়ে ভারত সরকার চুক্তি করতে পারে। কিন্তু একটি নদীমাতৃক রাজ্যের সহযোগিতা না থাকলে সেই পথে এগোতে কতটা সমস্যা হয় তা এর আগে তিস্তা চুক্তির সময় কেন্দ্র বুঝেছিল। এরপর বাংলার সঙ্গে কথা বলেই সেই চুক্তির পথে গিয়েছিল কেন্দ্র। অথচ তিস্তা জল বণ্টন চুক্তির সময় সবথেকে বেশি প্রভাবিত হতে চলা বাংলাকে বেমালুম বাদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এটা করা যায় না। যে অঞ্চল দিয়ে গঙ্গা বয়ে গিয়েছে আর যে পরিমাণ জল বাংলাদেশ সরকারের তরফে চাওয়া হচ্ছে সেই জল দিতে গেলে উত্তরের অধিকাংশ কৃষিভিত্তিক অঞ্চল জলসঙ্কটে পড়বে। মার খাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা। বাংলার মানুষের এই ক্ষতি কোনও অবস্থাতেই হতে দেবেন না মুখ্যমন্ত্রী। বাংলাদেশের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর যথেষ্ট সুসম্পর্ক বিশেষ করে শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুসম্পর্ক সর্বজনবিদিত। কিন্তু বাংলার মানুষের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে কোনও অবস্থাতেই কোনও কাজ কখনও করেননি মুখ্যমন্ত্রী।
আরও পড়ুন-চণ্ডীপুর সমবায় জিতল তৃণমূল
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়ায় ব্যাপক ভাঙন নিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখেছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফরাক্কা ব্যারাজের জন্য ব্যাপকভাবে ভাঙনে বাংলার মানুষের ভিটেমাটি, চাষের জমির ক্ষতি হচ্ছে, সে-কথাও ওই চিঠিতে বিস্তারিত জানানো হয়। ২০১৭ সালে তৎকালীন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও একইভাবে ফরাক্কা ব্যারেজের জন্য বন্যার কথা তুলে সরব হয়েছিলেন। অথচ মুখ্যমন্ত্রীর চিঠির পরেও গঙ্গার ড্রেজিং বা পুরোনো চুক্তি অনুযায়ী টাকা— কিছুই পৌঁছায়নি বাংলার বরাদ্দে। বারবার তৃণমূলের পক্ষ থেকে এই প্রসঙ্গ তোলা হলেও একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনা, মিড-ডে মিলের টাকার মতো এক্ষেত্রে কেন্দ্রের বঞ্চনায় বাংলা। বিজেপি সরকারের চোখ-বন্ধ-করা নীতিতে সেই সঙ্গে ক্ষতির মুখে বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ।
এ-বিষয়ে রবিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রাক্তন সাংসদ কুণাল ঘোষ বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাস্তববাদী, উদার। তিনি নিশ্চিতভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশকে ভালবাসেন। বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার পক্ষে। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ, পশ্চিমবঙ্গের কৃষিভিত্তিক সমাজ এবং সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের স্বার্থ যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সেটাও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে হয়। ফলে যে নদীগুলি পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে গিয়েছে সেই নদীগুলি সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে গেলে, কেন্দ্রের উচিত নিশ্চিতভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তার মধ্যে রেখে তাঁর মতামত নিয়ে কোনও পদক্ষেপে যাওয়া।