সিকল সেল অ্যানিমিয়া

'সিকল সেল অ্যানিমিয়া'— বংশগত এই হিমোগ্লোবিন ব্যাধি বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট উদ্বেগ তৈরি করেছে। প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ শিশু হিমোগ্লোবিনজনিত রোগ নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। এসব শিশুর প্রায় ৮০ শতাংশই রয়েছে উন্নয়নশীল দেশে। বাবা বা মা কোনও একজন বাহক হলেই শিশুর এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই রোগটি নিয়ে সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগে প্রচারাভিযান বেশ জোরদার। প্রতিবছর জুন মাসে পালিত হয় 'বিশ্ব সিকল সেল দিবস'। সিকল সেল অ্যানিমিয়া কী? কেন হয়? প্রতিরোধই বা কী? লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

রোগ নিয়ে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে প্রত্যেক বছর ঘুরে ফিরে আসে একটি নির্দিষ্ট দিন। প্রতিবছর সেই দিনটি পালিত হয়, প্রচার কর্মসূচি চলে, তা নিয়ে লেখালেখি চলে। কোনও কোনও রোগের ক্ষেত্রে সপ্তাহ বা মাসও উদযাপন হয়। এর উদ্দেশ্য একটাই, সেই রোগ এবং রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে আরও বেশি করে মানুষকে সচেতন করে তোলা। কারণ পরিবর্তন একদিনে আসে না। বিন্দু বিন্দুতে সিন্ধু তৈরি হয়। যেমন, সিকল সেল অ্যানিমিয়া। এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে প্রকট হয়ে ওঠা এক সমস্যা। প্রতিবছর জুনে পালিত হয় ‘বিশ্ব সিকল সেল দিবস।’ রোগটা এতটা বিরল হওয়ায় দিনে দিনে চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। তাই প্রতিবছর এই দিনটায় বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষ থেকে এবং বেসরকারি উদ্যোগেও প্রচারাভিযানের চালানো হয়।

আরও পড়ুন-ব্রিটানিয়া কোম্পানি বাংলাতেই, বিজেপিকে নিশানা করে প্রতিবাদ সাগরিকার

সিকল সেল অ্যানিমিয়া রোগ নয়
যাকে বলে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। কারণ একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সিকল সেল অ্যানিমিয়ায় আক্রান্তের দুই-তৃতীয়াংশই জন্ম নেয় আর্থিক অনুন্নত, পশ্চাদপদ এলাকায়। অর্থাৎ তাদের আর্থিক সচ্ছলতা অনেকটাই কম হয়। যার ফলে এই রোগের চিকিৎসা করানো কঠিন হয়ে পড়ে। এই রোগে আক্রান্তকে নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। হিসাবে অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪৪ লাখ মানুষের সিকল সেল রোগ রয়েছে। আরও সাড়ে ৪ কোটি মানুষের সিকল সেল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারা এ রোগের বাহক। এ রোগের প্রায় ৪০ শতাংশ দেখা যায় আফ্রিকায়। তবে ভারত, দক্ষিণ ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার কিছু অংশেও এই রোগ দেখা যায়। বংশগত এই হিমোগ্লোবিন ব্যাধি বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট উদ্বেগ তৈরি করেছে। প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ শিশু হিমোগ্লোবিনজনিত রোগ নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। এসব শিশুর প্রায় ৮০ শতাংশই রয়েছে উন্নয়নশীল দেশে।
কী এই বিরল রক্তের রোগ
সিকল সেল অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা জিনঘটিত, হিমোগ্লোবিনজনিত রক্তের একটি রোগ। এটি বংশপরম্পরায় বাহিত হতে পারে। হিমোগ্লোবিন হচ্ছে একটি মেটালোপ্রোটিন, যা প্রায় সব মেরুদণ্ডী প্রাণীর লোহিত রক্তকণিকায় থাকে। প্রত্যেক সুস্থ মানুষের প্রতি ১০০ মিলিগ্রাম রক্তে ১২ থেকে ১৮ মিলিগ্রাম হিমোগ্লোবিন থাকে। প্রতি গ্রাম হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন বহনের ক্ষমতা ১ দশমিক ৩৪ মিলিগ্রাম। হিমোগ্লোবিন অন্যান্য গ্যাসও পরিবহণ করে। যেমন কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড, সালফার মনোক্সাইড ও সালফাইড ইত্যাদি। হিমোগ্লোবিনের জন্যে রক্ত যেমন ঘন হয়, তেমনি লালও হয়। এর মূল কাজ শরীরে অক্সিজেন পরিবহণ করা। এটি মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। তাই রক্তে হিমোগ্লোবিন কমলে অক্সিজেনও কমে যায়। আমাদের রক্তে লোহিত রক্তকণিকার বা আরবিসি-র আকার সাধারণত গোল। কিন্তু সিকল সেল ডিজিজ হলে এই হিমোগ্লোবিনের আকার বিকৃত হয়।

আরও পড়ুন-বড়বাজারের মেহতা বিল্ডিংয়ে ভয়াবহ আগুন

সেটা দেখতে অনেকটা ‘Sickle’ বা কাস্তে বা অর্ধচন্দ্রের মতো হয়। যেগুলো অনমনীয় ও চটচটে, যা রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। সেই ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনসহ কাস্তে-কোষগুলোর ১০ থেকে ২০ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়। ফলে রক্তে লোহিত রক্তকণিকার অভাব (অ্যানিমিয়া) দেখা দেয়। পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা ছাড়া শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না এবং দেহ ভীষণ ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। এই ত্রুটিপূর্ণ লোহিত রক্তকণিকা বুক, পেট ও দেহের জয়েন্টগুলোয়, ক্ষুদ্র রক্তনালিতে রক্তচলাচলে বাধা দেয়। রক্তপ্রবাহ ধীরে বা ব্যাহত হলে হাত-পা ফুলে যেতে পারে, স্ট্রোক হতে পারে। এটি প্লীহার ক্ষতি করে ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া সিকল সেল কোষ চোখের রক্তনালিতে আটকে যেতে পারে। ফলে দৃষ্টিশক্তির ঘাটতি হতে পারে। একে সিকল সেল ডিজঅর্ডারও বলে।
তাই আক্রান্ত রোগীকে ঘন ঘন রক্ত বা আরবিসি ট্রান্সফিউশনই হচ্ছে একমাত্র পথ, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। হাড়ের মজ্জাও নিয়মিত ট্রান্সপ্লান্ট করাতে হয়।

কাদের হয়
মূলত শিশুদের দেখা দেয় সিকল সেল অ্যানিমিয়া। বাবা বা মায়ের মধ্যে যেকোনও একজনের শরীরে এই রোগ থাকলে তার শিশুর এই রোগের আশঙ্কা থাকে। সাধারণত ছয় থেকে সাত মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে এই রোগের উপসর্গ দেখা যায় না। ৮-৯ মাস বা ১ বছরের পর থেকে এই রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। তবে চার মাসের শিশুদের মধ্যেও অনেক সময় এই রোগ দেখা দেয়।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর তোপের মুখে পড়ে রাত থেকেই শুরু দখলমুক্তির কাজ

কী কী লক্ষণ
শরীরে ক্লান্তিভাব থাকতে পারে।
বুকে-পেটে ও বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
বিরক্তিবোধ, মেজাজ খিটখিটে, খিদে কম, হাত-পা ফুলে যেতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে ঘন ঘন বিভিন্ন রোগে সংক্রমিত হয়ে পড়া।
কিডনির সমস্যা হয় ও ত্বকে হলদে ভাব দেখা দিতে পারে।
সিকল সেল অ্যানিমিয়া থেকে আসে নানা রোগ
এই রোগ থেকে আরও রোগের সৃষ্টি হয়। প্লীহা শুকিয়ে যেতে পারে, বুকে ব্যথা হতে পারে, স্ট্রোক, অ্যাকিউট চেস্ট সিনড্রোম, অন্ধত্ব, গলব্লাডারে স্টোন, পায়ের আলসার, থ্রম্বোসিস বা রক্ত জমাট বাঁধা, গর্ভকালীন নানা জটিলতা হতে পারে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোপোরেসিস, এইচপিএলসি এবং আইইএফ পরীক্ষা করলে রোগ ধরা পড়ে। পাশাপাশি রুটিন রক্ত পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে ডায়াগনোসিস করা হয়।
চিকিৎসা
এই রোগ একেবারে সারিয়ে তোলার কোনও চিকিৎসা পদ্ধতি এখনও জানা নেই। তবে রোগের প্রকোপ কম রাখতে নানারকম থেরাপি আছে। যেমন—স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন করা যেতে পারে, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনে রোগের ট্রিটমেন্ট হতে পারে, ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে রক্তে লোহিত রক্তকণিকার মাত্রা বাড়িয়ে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। তাছাড়া কিছু ওষুধপত্র আছে। সেই সঙ্গেই সঠিক ডায়েট জরুরি। এই রোগের সবরকম থেরাপিই খুব জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ যা নিয়ে সরকারি দৃষ্টি আকর্ষণ জরুরি।

Latest article