গড়পড়তা বঙ্গবাসীর মনে কর্মবীর বাঙালির যে তালিকাটি আছে তার মধ্যে অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের (Prasanta Chandra Mahalanobis) নাম সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটা দুর্ভাগ্যজনক এই কারণে যে প্রশান্তচন্দ্রের মতো বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র খুব বেশি বাঙালির নেই। তবু তাঁর নাম আমজনতার মধ্যে তেমন করে ছড়ায়নি তার কারণ এক দিকে তাঁর কাজের শিকড় প্রোথিত ছিল বিশুদ্ধ বিজ্ঞান-জিজ্ঞাসায় এবং অন্য দিকে তাঁর কাজের উদ্দেশ্য জনকল্যাণমূলক হলেও পদ্ধতিগত দিক থেকে তা ছিল সারস্বত গবেষণা-ভিত্তিক, সাধারণ নাগরিক সমাজের অনুধাবনের বাইরে। অনুমান করা যায়, যদি সমাজ-সংস্কার কিংবা সাহিত্য রচনা তাঁর কাজের ক্ষেত্র হত তা হলে আরও অনেক মানুষ তাঁর কাজের কথা জানতেন। কিন্তু তাঁর ছিল বিশেষজ্ঞের কাজ। এইসব কাজের জন্য দেশে ও বিদেশে তিনি নানারকম সম্মান পেয়েছেন, কিন্তু জনপ্রিয়তা বলতে যা বোঝায় সেটা কখনও তাঁর করায়ত্ত হয়নি। তাঁর অসাধারণ কাজগুলো সম্বন্ধে তাই সাধারণ মানুষের জন্য কিছু বলা দরকার।
১৮৯৩ সালের ২৯ জুন এক আলোকপ্রাপ্ত ব্রাহ্ম পরিবারে প্রশান্তচন্দ্রের জন্ম। শিক্ষা ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজে বিষয় ছিল পদার্থবিজ্ঞান। সেই সময়ের তারকাখচিত প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রশান্তচন্দ্র শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো কিংবদন্তিদের। তিনি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ছেন তখন তাঁর ঠিক এক ক্লাস নিচে ওই কলেজেই পড়ছেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা এবং আরও এক ক্লাস নিচে সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯১২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হবার পর ১৯১৩-তে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন প্রশান্তচন্দ্র। কিন্তু ঘটনাচক্রে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে ভর্তি হলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজে। ১৯১৫ সালে সেখান থেকে ট্রাইপস করার পর ছুটি কাটাতে কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরলেন, ইচ্ছে ছিল কেম্ব্রিজে ফিরে গিয়ে পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট করবেন। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, তাই আর ফেরা হল না। প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞান পড়াতে শুরু করলেন।
কেম্ব্রিজে পড়াশোনা করার শেষ দিক থেকেই রাশিবিজ্ঞান নামক বিষয়টির প্রতি প্রশান্তচন্দ্রের আকর্ষণ। যদিও বিমূর্ত গণিতের প্রয়োজনীয়তাকে প্রশান্তচন্দ্র কখনই অস্বীকার করেননি, তাঁর মনে হত গণিতের চৌহদ্দি থেকে রাশিবিজ্ঞানকে বার করে এনে একে নানা ব্যবহারিক দিকে কাজে লাগানো সম্ভব। দেশে ফিরে, প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াতে পড়াতে, তাঁর ফলিত রাশিবিজ্ঞানে উৎসাহ আরও বাড়তে থাকে। আবহাওয়া বিজ্ঞান এবং নৃতত্ত্ব এই দুই বিষয়ে রাশিবিজ্ঞানের সার্থক প্রয়োগ করে প্রকাশ করেন কয়েকটি গবেষণাপত্র। পাশাপাশি রাশিবিজ্ঞানের গাণিতিক তত্ত্ব নিয়ে তাঁর মৌলিক গবেষণা, মহলানবীশ ডিস্ট্যান্স ফাংশান, সারস্বত মহলে বিশেষ রেখাপাত করেছিল।
রাশিবিজ্ঞানের পঠন-পাঠন-গবেষণার জন্য ১৯৩২ সালে কয়েকজন সমমনস্ক বিজ্ঞানীকে নিয়ে প্রশান্তচন্দ্র স্থাপনা করলেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউট বা আইএসআই এবং ১৯৭২ সালে তাঁর মৃত্যু অব্দি দক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে একে চালনা করলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি নয় দশক জুড়ে শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবীর রাশিবিজ্ঞান চর্চায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। শুধু রাশিবিজ্ঞান কেন, যে কোনও বিষয় যাতে রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগ সম্ভব— পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, জনসংখ্যাতত্ত্ব, কৃষিবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান— সব ধরনের জ্ঞানচর্চাকেই আইএসআই জায়গা দিয়েছে। একই সঙ্গে বিমূর্ত গণিতের চর্চাতেও আইএসআই-এর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৫৬ সালে প্রশান্তচন্দ্রের উদ্যোগে আইএসআই-এর কলকাতা ক্যাম্পাসে ভারতের প্রথম কম্পিউটার বসানো হয়। সেই থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানের চর্চাও আইএসআই-এর অন্যতম প্রধান কাজ। নির্দ্বিধায় বলা চলে, আইএসআই-এর মতো সারা পৃথিবীতে স্বীকৃতি পেয়েছে এমন কলকাতা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান খুব একটা নেই।
আরও পড়ুন- ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, ফের বলল আমেরিকা
প্রশান্তচন্দ্র (Prasanta Chandra Mahalanobis) বুঝেছিলেন দেশের উন্নতি করতে গেলে দেশকে জানতে হবে এবং এত বড় দেশটাকে জানতে গেলে নমুনা সমীক্ষা ছাড়া উপায় নেই। এই লক্ষ্যে তিনি নমুনা সমীক্ষার নানারকম অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন যা দিয়ে তিনি কৃষির উৎপাদনশীলতা, বন্যা-নিয়ন্ত্রণ বা দুর্ভিক্ষ পরবর্তী অবস্থার বিশ্লেষণ করেছিলেন। ১৯৫০ সালে প্রশান্তচন্দ্র পাকাপাকিভাবে স্থাপনা করলেন ন্যাশানাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস বা এনএসএসও যার কাজ হল বিভিন্ন আর্থসামাজিক দিক থেকে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে নিয়মিত নমুনা-ভিত্তিক সমীক্ষা করা। এনএসএসও-র নমুনা সমীক্ষা শুধু দেশে নয় সারা বিশ্বে কদর পেয়েছে। বস্তুত, প্রশান্তচন্দ্রের নেতৃত্বে ভারতে পরিসংখ্যান সংগ্রহের যে পদ্ধতি গড়ে তোলা হয়েছিল সারা বিশ্ব তাকে অনুসরণ করেছে। কথাটা নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী অ্যাঙ্গাস ডিটনের।
এখানেই আশঙ্কা। প্রশান্তচন্দ্রের নেতৃত্বে যে পরিসংখ্যান পদ্ধতি তিল তিল করে গড়ে তোলা হয়েছিল, পৃথিবী জুড়ে যে পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত, বেশ কিছুদিন ধরে বিজেপি সরকার তাকে ধ্বংস করে দিতে সচেষ্ট হয়েছে। এনএসএসও-কে দিয়ে ভুল এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পরিবেশন করানো হচ্ছে যাতে সাধারণ মানুষকে বোঝানো যায় বিজেপি আমলে আমাদের দেশ একটা অভূতপূর্ব ভাল সময়ের মধ্যে দিয়ে চলছে। বলাই বাহুল্য মানুষকে বোকা বানানো অত সহজ নয়। মাঝখান থেকে ভারতীয় পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতাটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই সঙ্কটে প্রশান্তচন্দ্রকেই বারবার মনে পড়ে।