শাসনের পথে শোষণ
বিদেশি, বিশেষত ইউরোপিয়ান মানেই নিষ্ঠুর, অত্যাচারী। ইতিহাস পড়ে ব্রিটিশদের কথা জেনে এমন ধারণা পোষণ করেন অনেকেই। কেউ কেউ মনে করেন, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে এসেছিল শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। ব্যবসাই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। তারা এই দেশের যতটুকু উন্নতি সাধন করেছে, পুরোটাই নিজেদের সুবিধার্থে। ভারতবাসীর কথা মোটেও চিন্তা করেনি। পরবর্তী সময়ে এরাই শাসনের পথ ধরে করেছে শোষণ।
তবে সব বিদেশিকে কিন্তু এক বন্ধনীর মধ্যে রাখা ঠিক হবে না। কোনও কোনও বিদেশির মধ্যে আশ্চর্যরকম মানবিক মুখ দেখা গেছে। তেমনই একজন উইলিয়াম হ্যামিল্টন।
আরও পড়ুন-১৩.৩ ওভারে মাঠ ছাড়েন অক্ষর, মুখরক্ষা করলেন বিরাট
তিনি ছিলেন বিখ্যাত স্কটিশ সার্জন। অসাধারণ চিকিৎসক। অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয়। তিনি ১৭০৯ সালে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনো করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরিতে যোগ দেন। সেই সময় ইংল্যান্ডে সার্জনদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান একেবারেই আশাব্যঞ্জক ছিল না। তাই পাশ করা চিকিৎসকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যোগ দিতেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাঁধা চাকরিতে। এছাড়াও ভারতবর্ষের বিপুল সম্পদ সম্পর্কে লোভ তো ছিলই। প্রত্যেকের লক্ষ্য থাকত ভারতের মাটি থেকে অতিরিক্ত কিছু কামানো। যদিও এখানে চিকিৎসকদের মাইনে আহামরি কিছু ছিল না। তবে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করা যেত। সেই কারণেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাঁধা চাকরিতে যোগ দিতে চাইতেন চিকিৎসকেরা।
ছিঁড়ে যায় তার
উইলিয়াম হ্যামিল্টন জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য ইউরোপ থেকে জাহাজে চড়ে ভারতে পাড়ি জমান। সমুদ্রপথে দেখতে থাকেন স্বপ্ন। কিন্তু ছিঁড়ে যায় তাঁর। জাহাজের ক্যাপ্টেন তাঁর সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন। সেই জন্য তিনি তামিলনাড়ুর কাছে কাড্ডালোরে নৌকো করে পালিয়ে সোজা মাদ্রাজ চলে যান। সেখান থেকে কোম্পানির হুকুম উপেক্ষা করে কলকাতায় এসে পৌঁছন।
ভারতে ৬ মাসের জন্য সার্জন উইলিয়াম হ্যামিল্টনের বরাদ্দ ছিল ১৪৪ টাকা। প্রসঙ্গত, কলকাতার বুকে প্রথম যে পোস্টমর্টেমের খবর নথিভুক্ত আছে, সেই পোস্টমর্টেম করেছিলেন দু’জন সার্জন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন উইলিয়াম হ্যামিল্টন। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর দক্ষতা ছিল আশাতীত।
আরও পড়ুন-বালি নিয়ে পদক্ষেপ প্রশাসনের, পুর প্রশাসকের সঙ্গে বৈঠকে প্রাক্তন কাউন্সিলররা
কোম্পানির সঙ্কট
তিনি যখন ভারতে আসেন, তখনও সব জায়গায় জাঁকিয়ে বসতে পারেনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তার কয়েক বছর আগে, ১৬৯০ সালের ২৪ অগাস্ট জোব চার্নক হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত জলাভূমি বেষ্টিত সুতানুটির নির্বাচিত জমিতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি স্থাপন করেন। তারপর থেকেই ভারতবর্ষের মাটিতে ব্রিটিশ বসতি ছড়াতে শুরু করে। তবে অত্যন্ত মন্থর গতিতে। যে উদ্দেশ্যে এসেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, তখনও পর্যন্ত সেটা পূরণ হয়নি। তাদের বন্দোবস্তের শুরুর বছরগুলো ছিল রীতিমতো সংগ্রামের।
এরমধ্যে ঘটে যায় মস্তবড় অঘটন। ১৬৯২ সালে হঠাৎ মারা যান জোব চার্নক। কোম্পানি পড়ে মহাসঙ্কটে। কারণ মুঘল বাদশা আওরঙ্গজেব এবং বাংলায় তাঁর দেওয়ান মুর্শিদকুলি খান, উভয়েই ব্রিটিশদের সঙ্গে চলছিলেন দূরত্ব বজায় রেখে। কারণ পর্তুগিজদের সঙ্গে পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা মুঘলদের দারুণভাবে বিচলিত করেছিল। ফলে সমস্যা হচ্ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। কিছুতেই খোলাখুলি বাণিজ্য করার অনুমতি মিলছিল না।
রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ
১৭০৭ সালে মৃত্যু হয় সম্রাট আওরঙ্গজেবের। দিল্লিতে বেধে যায় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। দেশ পড়ে যায় চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। অবশেষে, শাহ আলম দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে এগিয়ে আসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অবিলম্বে দিল্লির শাসককে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা দান করে ব্যবসায়িক সুবিধা নিতে শুরু করে। যদিও সুখের দিন খুব বেশি স্থায়ী হয়নি। দিল্লিতে নানারকম সমস্যা দেখা দিতে থাকে।
বাংলায় বসে সমস্তকিছুর উপর নজর রাখছিলেন বুদ্ধিমান মুর্শিদকুলি খান। দিল্লির দুর্বল শাসকদের সুযোগ নিয়ে ধীরে ধীরে তিনি নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলছিলেন। ইংরেজরা ছিল তাঁর চরম অপছন্দের। ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিছুতেই ডানা মেলতে পারছিল না।
আরও পড়ুন-সোবার্সের দেশে কাপের হাতছানি, মুখোমুখি ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা
দূত পাঠানোর সিদ্ধান্ত
১৭১৭ সালে দিল্লির সিংহাসনে বসেন ফররুখসিয়ার। তিনি ছিলেন দশম মুঘল সম্রাট। ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন সজ্জন। এইসব কিছু জেনে আশায় বুক বাঁধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারা সম্রাট ফররুখসিয়ারের কাছে দূত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। যাতে ভারতে ব্যবসার প্রসার বাড়ানো যায়।
সেইমতো ১৭১৫ সালের এপ্রিল মাসে কোম্পানির একটি দল কলকাতা থেকে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। একবুক আশা নিয়ে। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন জন সারম্যান এবং এডওয়ার্ড স্টিফেনসন। তাঁরা কলকাতায় কোম্পানির পরিষেবার দুই সেরা ব্যক্তি হিসাবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। ধনী আর্মেনিয়ান বণিক খোজা সেরহাউদ সরকারি দোভাষী হিসাবে তাঁদের সঙ্গে যান। সেই দলেই ছিলেন চিকিৎসক উইলিয়াম হ্যামিল্টন।
সম্রাটের অসুস্থতা
তিন মাসের যাত্রার পর ৮ জুলাই কোম্পানির প্রতিনিধিরা মুঘল রাজধানীতে পৌঁছান। কিন্তু তাঁরা যে উদ্দেশ্যে এসেছিলেন, সেই উদ্দেশ্য কিছুতেই পূরণ করতে পারছিলেন না। সম্রাটের কাছে পৌঁছে দিতে পারছিলেন না কোম্পানির বার্তা। এইভাবেই পেরিয়ে গেল কয়েক মাস।
একদিন খবর আসে যে, সম্রাট ফররুখসিয়ার গুরুতর অসুস্থ। তাঁর কুঁচকির একটি অংশ ভীষণ রকমের ফুলে গেছে। ভয়ানক ব্যথা অনুভব করছেন তিনি। অবস্থা বেশ সঙ্গীন। চিন্তার ভাঁজ সকলের কপালে। সম্রাটের কন্যার বিবাহের অনুষ্ঠানও এই কারণে পিছিয়ে গেছে।
সেইসময় ঘটে যায় এক আশ্চর্য ঘটনা। সম্রাটের প্রাসাদে ডাক পড়ে সার্জন উইলিয়াম হ্যামিল্টনের। তাঁর হাতে দেওয়া হয় অসুস্থ শাসকের চিকিৎসার গুরুদায়িত্ব। সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত সার্জন উইলিয়াম হ্যামিল্টন। তিনি হাসিমুখে দায়িত্ব নেন। নিষ্ঠার সঙ্গে সম্রাটের চিকিৎসা করতে থাকেন। দিনের পর দিন ধরে। একজন সাদা চামড়ার সাহেব হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিরলসভাবে সেবা করে যান। উইলিয়াম হ্যামিল্টনের চিকিৎসায় একটা সময় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন সম্রাট। দূরে সরে যায় বিপদের কালো মেঘ। কিছুদিন পর জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে বিয়ে হয়ে যায় সম্রাটের কন্যার।
আরও পড়ুন-ও নদী রে
প্রকৃত বন্ধুর মতো
শুধুমাত্র চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে নয়, একজন প্রকৃত বন্ধুর মতো পাশে থেকে সম্রাটকে সুস্থ করে তুলেছিলেন উইলিয়াম হ্যামিল্টন। তাঁর আচরণে বিন্দুমাত্র ছিল না সাহেবসুলভ অহঙ্কার। বরং সম্রাটের তাঁকে অনেক বেশি বিনীত মনে হয়েছিল।
সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পর আনন্দে আত্মহারা সম্রাট ফররুখসিয়ার উইলিয়াম হ্যামিল্টনকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জড়িয়ে ধরেন। শুধু কি তাই? তিনি তাঁর প্রিয় চিকিৎসককে দুটি হীরের আংটি, দামি পোশাক, একটি হাতি, একটি ঘোড়া এবং পাঁচ হাজার টাকা উপহার দেন। কিন্তু এতকিছু উপহার দেওয়ার পরেও সম্রাটের মনে হয়, যথেষ্ট দেওয়া হল না। তিনি উইলিয়াম হ্যামিল্টনকে নির্দ্বিধায় আরও কিছু চেয়ে নিতে অনুরোধ করেন। পুরস্কার জাতীয় কিছু। উচ্চমানের সার্জন তো বটেই, একজন অত্যন্ত নিঃস্বার্থ মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন এই চিকিৎসক। ব্যক্তিস্বার্থ দূরে সরিয়ে তিনি সম্রাটকে জানান, কোম্পানির যে মিশনকে সফল করার উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁরা সুদূর কলকাতা থেকে দিল্লি এসেছেন, সেটা যেন মঞ্জুর করা হয়। সম্রাট ফররুখসিয়ার খুশি হন উইলিয়াম হ্যামিল্টনের কথা শুনে। বুঝতে পারেন এই চিকিৎসক একজন নির্লোভ ব্যক্তি। সম্রাট মঞ্জুর করেন উইলিয়াম হ্যামিল্টনের আর্জি। ইতিমধ্যে কোম্পানির দখলে থাকা তিনটি গ্রাম— সুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলকাতা তো বটেই, সেইসঙ্গে আশপাশের ৩৮টি গ্রাম কেনার অনুমতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি দেওয়া হয় কোম্পানিকে বাংলায় ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা। আগের তুলনায় অনেক বেশি সুরক্ষিত করা হয় কলকাতাকে। সম্রাটের এই অনুদান কোম্পানির ব্যবসা স্থাপনে এবং বাংলায় উপনিবেশ স্থাপনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আরও পড়ুন-সংসদে নিট-বিতর্ক এড়াতে মরিয়া কেন্দ্র, প্রতিবাদে উত্তাল ঐক্যবদ্ধ ‘ইন্ডিয়া’
অনালোকিত অধ্যায়
চাইলেই নিজের আখের গোছাতে পারতেন উইলিয়াম হ্যামিল্টন। কিন্তু সেটা না করে এইভাবেই তিনি ভেবেছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বার্থের কথা। যারা তাঁর রুটিরুজির ব্যবস্থা করেছে। এরপর উইলিয়াম হ্যামিল্টনের উদারতার কথা দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
সম্রাট ফররুখসিয়ার উইলিয়াম হ্যামিল্টনকে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে দিল্লিতে রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু উইলিয়াম হ্যামিল্টন সেই সময় থাকতে রাজি হননি। তবে তিনি সম্রাটকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ইউরোপ সফরের পরে তিনি ফিরে আসবেন এবং সম্রাটের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসাবে তাঁর সঙ্গে যোগ দেবেন। যদিও এরপর বেশিদিন জীবিত ছিলেন না উইলিয়াম হ্যামিল্টন। ১৭১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
এই দক্ষ চিকিৎসক উন্নত মানসিকতার জন্য সেই সময় ভারতীয়দের শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা অর্জন করেছিলেন। দুঃখের বিষয়, তাঁর কথা বর্তমানে খুব বেশি মানুষ জানেন না। অনালোকিত অধ্যায় হিসেবে থেকে গেছেন ইতিহাসের পাতায়।