দিনটা ছিল ২৬ জুন। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। কাগজে-কলমে আষাঢ়। বর্ষাকাল। কিন্তু বাইরে ছিটেফোঁটাও ঝরেনি। তবে তুমুল বৃষ্টি নেমেছিল পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি-র জীবনানন্দ সভাঘরে। অক্ষরের ধারাজলে সিক্ত হন উপস্থিত প্রত্যেকেই। তাঁদের কেউ কবি। কেউ কবিতা-পাঠক। কেউ কবিতা-ভাবুক। গীর্বাণ আয়োজিত একটি বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান উপলক্ষে ওইদিন ঘটেছিল সারস্বত সমাবেশ। মঞ্চ আলোকিত করে ছিলেন অধ্যাপক পবিত্র সরকার, অধ্যাপক চিন্ময় গুহ, কবি সুধীর দত্ত, কবি সর্দার আমজাদ আলি, কবি ও চিত্রশিল্পী শ্যামল জানা। উত্তরীয়, ফুল, চন্দনে তাঁদের বরণ করে নেন জুলি লাহিড়ী, মীনা ভট্টাচার্য। সুরের মায়াজাল বিস্তার করেন বিপ্লব ঘোষ। অতিথিরা সমবেতভাবে প্রকাশ করেন প্রাবন্ধিক পারমিতা ভৌমিকের বই ‘কবিতায় এক-এ চন্দ্র দুই-এ পক্ষ’। কবিতা-বিষয়ক প্রবন্ধের বই। আলোচনার বই।
সাহিত্যের একনিষ্ঠ ছাত্রী পারমিতা থাকেন হাওড়ায়। লিখছেন বহু বছর। মূলত বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে এবং মুখবইয়ের পাতায়। আগে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কয়েকটি গবেষণাধর্মী বই। ‘কবিতায় এক-এ চন্দ্র দুই-এ পক্ষ’ বইয়ে তীক্ষ্ণ মেধা ও মনন দিয়ে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর পছন্দের কিছু কবিতা। খ্যাতনামা কবিদের পাশাপাশি এমন কয়েকজন কবিকে নির্বাচন করেছেন, যাঁরা ততটা আলোকিত এবং আলোচিত নন। অথচ লেখনী বলিষ্ঠ। স্বাভাবিকভাবেই বইটা সম্পর্কে আগ্রহ জন্মায়।
আরও পড়ুন-আজ বিশ্বকাপ ফাইনালে রোহিতদের পক্ষেই বাজি
দেখে নেওয়া যাক পারমিতা সম্পর্কে দুই প্রাজ্ঞজনের মন্তব্য। বইটির ‘কথামুখ’-এ অধ্যাপক পবিত্র সরকার লিখেছেন, ‘আমি মুখবইয়ে বেশ কিছু সময় ধরে তাঁর আলোচনাগুলি পড়ছি এবং তাঁর সন্ধানের ব্যাপ্তি ও বিশ্লেষণের গভীরতায় আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। প্রথমত, তাঁর সৌজন্যে আমি মাঝে মাঝেই এমন চমৎকার সব কবিতা পড়তে পেরেছি যা আমার নিজের উদ্যোগে খুঁজে পড়া সম্ভব হত বলে আমি মনে করি না। দ্বিতীয়ত, এই কবিতাগুলিকে তিনি অসামান্য প্রজ্ঞা নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, যা যে কোনও পাঠককে আলোকিত করবে।’
অধ্যাপক চিন্ময় গুহ-র কথায়, ‘যখন নিবিড় পাঠ অত্যন্ত বিরল, আপনি একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। এর সূত্রপাত করেন শঙ্খ ঘোষ— রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনায়।’
৩২৮ পৃষ্ঠার বইটিতে পারমিতা খুঁটিয়ে আলোচনা করেছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, পবিত্র সরকার, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, চিন্ময় গুহ, শ্যামলকান্তি দাশ, সুধীর দত্ত, মৃণাল বসু চৌধুরী, অনন্ত দাশ, মল্লিকা সেনগুপ্ত, অগ্নি বসু, সৈয়দ কওসর জামাল, অমরেন্দ্র চক্রবর্তী, আবদুস শুকুর খান, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়, শঙ্কর ঘোষ, গোলাম রসুল, রামচন্দ্র প্রামাণিক, চন্দন রায়, রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বৃন্দাবন দাস, শালিনী চৌধুরী প্রমুখের কবিতার উপর। ধ্রুপদী আলোচনা। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, পারমিতা কবিতার ব্যাকুল পাঠক। নিবিষ্ট পাঠক। গভীর তাঁর পর্যবেক্ষণ। ডুবুরির মতো পৌঁছে যান অতলে। সেই অর্থে তিনি কবি নন, প্রাবন্ধিক, আলোচক, গবেষক। তবে কবিদের ঘরে তাঁর বসত। থাকেন আপনজন হয়ে। নির্ভেজাল বন্ধু হয়ে। বই ঘেঁটে, নানা সময়ের পত্রপত্রিকা হাতড়ে তিনি নিত্যনতুন বিশুদ্ধ কবিতা অন্বেষণ করেন। আবিষ্কার করেন। মগ্ন পাঠকের সামনে সযত্নে তুলে ধরেন কবিতা সম্পর্কে মুক্ত ভাবনা। তাঁর নির্মেদ আলোচনায় পণ্ডিতি নেই, আছে আন্তরিকতা। কোথাও কোনওরকম দায় নেই তাঁর, তাই বলে যেতে পারেন খোলামনে। একশো শতাংশ সৎ থেকে। চোখে পড়ে বৈপরীত্য। কখনও তিনি সংযত, হিসেবি। কখনও ভীষণরকম আবেগি। হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই টানেন না লাগাম। তিনি নির্মল। শরতের রোদ্দুরের মতো। তাঁর আলোচনাও তাই।
আরও পড়ুন-১৩.৩ ওভারে মাঠ ছাড়েন অক্ষর, মুখরক্ষা করলেন বিরাট
একটা সময় কবি ও সম্পাদক পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের মহাকবিতা নিয়ে গবেষণা করেছেন পারমিতা। তাঁর সম্পর্কে ‘কবিপত্র’-সম্পাদক কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘অনুভূতি, বোধ ও বুদ্ধির সম্মিলিত রসায়নে পারমিতার প্রবন্ধ ঋদ্ধ। বহুমুখী চিন্তনশীলতার প্রতিমূর্তি তাঁর লেখা। সাহিত্য আলোচনাকে তিনি তুলে ধরেন আশ্চর্য আলাদিনের প্রদীপের মতো।’
এই প্রদীপের আলো এসে পড়ে এমন কিছু কবিতার উপর, যেগুলো দীর্ঘদিন ছিল অন্ধকারে আচ্ছন্ন। কবি এবং আগ্রহী পাঠকের মধ্যে সেতু হয়ে দাঁড়ান পারমিতা। দুই হাত বাড়িয়ে দুই পক্ষকে নিয়ে আসেন কাছাকাছি। পাশাপাশি। এক আসরে আনন্দ-আলো জ্বেলে এগিয়ে যান দূরে কোথাও, দূরে দূরে। আরও দুই পক্ষের মিলন ঘটাতে। তিনি যেন কবিতার এক আশ্চর্য বাতিওয়ালা। কারুলিপি প্রকাশিত পারমিতা ভৌমিকের ‘কবিতায় এক-এ চন্দ্র দুই-এ পক্ষ’ আলোচনা গ্রন্থ-১ পাঠকের সমাদর পেলে আদতে বাংলা কবিতার পক্ষে মঙ্গল। সাহিত্যের পক্ষে মঙ্গল। শ্যামল জানার প্রচ্ছদ অসাধারণ। দাম ৫৫০ টাকা। দ্বিতীয় খণ্ডের অপেক্ষায় রইলাম।