লোকসভা নির্বাচনের আগে পুরীর বিজেপি সাংসদ সম্বিত পাত্র দাবি করেছিলেন, প্রভু জগন্নাথদেবও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (Narendra Modi) ভক্ত। যা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকও ভগবান জগন্নাথকে রাজনীতিতে না টেনে আনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এরপর তড়িঘড়ি সম্বিত জানান, তিনি মুখ ফস্কে কথাটি বলে ফেলেছিলেন। এর জন্য উপবাস করে প্রায়শ্চিত্ত করার কথাও ঘোষণা করেন সম্বিত। সেই ঘটনার রেশ মেলাতে না মেলাতেই এবার জগন্নাথদেবের সঙ্গে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহনচরণ মাঝির তুলনা করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান।
আসলে এটাই হচ্ছে বিজেপি। নিজেদের ভগবান ভাবে। অক্লেশে মনে করে তাঁরা দেবদূত কিংবা দেবতা। এজন্যই এবার ধর্মেন্দ্র প্রধান দাবি করেছেন, ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন মাঝি ও দুই উপ মুখ্যমন্ত্রীকে ভি সিং দেও ও পার্বতী পারিদা যেন প্রভু জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা।
জগন্নাথ জগতের নাথ। বলা হয়, প্রত্যেক ধর্মমতের ইষ্টদেবতার স্বরূপ তাঁর মধ্যেই উপলব্ধ। তিনি গাণপত্যের গণপতি, বৈষ্ণবের বিষ্ণু, শৈবের শিব, শাক্তর শক্তি, বৌদ্ধর বুদ্ধ, জৈনের জিন তীর্থঙ্কর, সৈরির সূর্য। কিন্তু আচমকা জানা গেল, মোদির প্রতি প্রীতিপক্ষপাত যাদের, তাদের কাছে তিনি কোনও দেবতা নন, স্রেফ একজন মোদিভক্ত। আর এখন জানছি, নররূপে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা ওড়িশা বিজেপির তিন নেতা-নেত্রী।
অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গদজেবের আমল থেকেই রাজ্য শাসকের সঙ্গে জগতের নাথের সম্পর্ক-সমীকরণ স্থির হয়ে গিয়েছিল। চোড়গঙ্গদেব ঘোষণা করেছিলেন, ওড়িশার রাজাধিরাজ মহাপ্রভু জগন্নাথদেব, আর তিনি মহাপ্রভুর সামন্তরাজা, রাউত। আজকের ভারত জানছে, ভারত শাসকের ভক্ত হলেন জগন্নাথদেব। তাঁর সঙ্গে নরেন্দ্রমোদির (Narendra Modi) সম্পর্ক ভক্তের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্ক, ভগবানের সঙ্গে ভক্তের সম্পর্ক নয়। জগন্নাথদেবই মহারাজাধিরাজ নরেন্দ্র মোদির অধীনস্থ একজন রাউত। কিংবা শাসকই স্বয়ং জগন্নাথ।
আরও পড়ুন- থ্রি-ডি প্রিন্টেড মস্তিষ্ক-কোষ
ঐতিহাসিক নিয়ামতউল্লার ‘মাকাজান-ই-আফগানি’তে কালাপাহাড়ের জগন্নাথ মন্দির ভাঙার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে। এই বিবরণ রয়েছে আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’তেও। মন্দিরে শ্রীবিগ্রহ খুঁজে পায়নি সে। কারণ, রাজ প্রতিনিধি দিব্যসিংহ পট্টনায়ক জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার তিনটি মূর্তিকে চিলকা হ্রদের ভেতর ছাপলি হাতিপাড়া নামের একটা ছোট্ট দ্বীপে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেই জায়গার হদিশ কালাপাহাড়কে জানিয়ে দেন পুরী জেলার ব্রহ্মগিরি অঞ্চলের গড় কোকালা গ্রামের প্রধান দনপাহন্ত সিমহা। বিনিময়ে কালাপাহাড়ের কাছ থেকে সে পায় দু-দুটো বড় জায়গির। বিগ্রহ তিনটে পাওয়ার পর সেগুলোকে হাতির পিঠে চাপিয়ে পুরীতে এনেছিল কালাপাহাড়। সবাইকে দেখাতে চেয়েছিল, জগতের অধীশ্বররূপে পূজিত, সর্বশক্তিমান রূপে বন্দিত জগন্নাথদেবও তার হাতে বন্দি। এখন সেই মানসিকতাই ফুটে উঠছে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের কথায়। ভাবটা এমন, বিজেপিই সব। ওসব জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা তুচ্ছ দেব-দেবী মাত্র।
কথিত আছে, জগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহ পুড়িয়ে ধ্বংস করেছিল কালাপাহাড়। চেয়েছিল গোটা মন্দিরটা ধূলিসাৎ করতে। কিন্তু পারেনি। বিশেষ ধরনের হালকা-গোলাপি উৎকৃষ্ট খোল্ডালাইট পাথরে তৈরি ওই শক্তপোক্ত মন্দির চুরমার করে দেওয়া কালাপাহাড়ের মতো মন্দির ধ্বংসকারীর পক্ষেও সম্ভব হয়নি। এখন দেখছি, বর্তমান শাসক শিবিরের একাংশ কালাপাহাড়ের মতোই দেখাতে উৎসুক, জগতাধিপতি সর্বশক্তিমান আদতে তাদের নেতা কিংবা তাদের সর্বোচ্চ নেতার ভক্তমাত্র। কালাপাহাড় শ্রীমন্দির ধ্বংস করতে না পেরে রাগে অন্ধ হয়ে মন্দিরের গায়ে বেশ কিছু অমূল্য ভাস্কর্যের ক্ষতি করেছিল। কালাপাহাড় সম বিজেপিও ভারতীয় সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতার শক্তপোক্ত মন্দিরটা ভঙতে চায়। না পেরে রাগের চোটে তার অমূল্য ভাস্কর্যের ক্ষতি করে ছাড়ছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বুঝি এভাবেই ঘটে।
হান্টার লিখে গেছেন, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বুঝেছিল, জগন্নাথকে কবজা করতে না পারলে ওড়িশা তাদের হস্তগত হবে না। তাই, ১৭৬৬-১৭৭৮ খ্রিঃ যখন মারাঠারাজ জানুজি ভোসলে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে বসলেন, তখন চুক্তির তেরোটি শর্তের মধ্যে প্রথমেই ছিল জগন্নাথ মন্দির সংক্রান্ত শর্ত। পরে ব্রিটিশরা যখন ওড়িশা দখল করল, তখন, ১৮৩৭ খ্রিঃ ফিলিপ মেলভিলে ওড়িশার সামন্তপ্রভুদের বুঝিয়েছিলেন, যা হচ্ছে, সবই প্রভু জগন্নাথের ইচ্ছায়। ব্রিটিশ হোক বা মারাঠা, কেউই জগন্নাথকে অস্বীকার করে তাঁর সার্বভৌমত্বকে খাটো করে, শাসক সাজার সাহস দেখায়নি। সেটা দেখাল বিজেপি, সেটা দেখালেন মোদির অনুরাগীরা।
তুলসীদাস উপলব্ধি করেছিলেন, জগন্নাথ ‘বিনুপদ’ হলেও গতিশীল, ‘বিনু কানা’ হলেও শ্রবণক্ষম। ‘নয়ন বিনু’ হলেও তিনি সব দেখতে পান।
সেই পুরুষোত্তম জগন্নাথ কিন্তু সব দেখছেন, সবকিছু শুনছেন। আগামীর রথের রশি তাঁরই হাতে। গণদেবতার হাতে।
মোদির দল নিজেদের যতই সর্বশক্তিমান ভাবুক না কেন!