জওহরলাল নেহরুকে ছুঁতে চেয়েছিলেন। ছুঁয়েওছেন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অবশ্য অধরা থেকে গিয়েছে। ধীরে ধীরে স্বমহিমায় ফিরছেন মোদিজি (Narendra Modi)। একেবারে অবিকৃত ফর্মে।
নোট বাতিল বা জিএসটির মতো ব্যর্থ প্রশাসনিক নীতিকে তিনি চাপা দিতে পারেন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক দিয়ে, চূড়ান্ত আগ্রাসী হয়ে সংসদে দাঁড়িয়েই বিরোধীদের কর্মসূচিকে ‘নখরা’ বা ‘ন্যাকামো’ বলার সাহস দেখান, আবার মূল্যবৃদ্ধি বা বেকারত্বের মতো জ্বলন্ত ইস্যুকে ২৫ বছরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভুলিয়ে রাখেন। এটাই মোদির গ্যারান্টি।
জরুরি অবস্থা স্বাধীন ভারতের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। তাই তৃতীয়বার ক্ষমতাসীন হয়েই সেই অধ্যায় নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছেন মোদি। জরুরি অবস্থা নিয়ে ৫০ বছর পরও মানুষের মনে আতঙ্ক আর ঘৃণা। আজও। তাই ওই বিষয়টাই মোদির অত পছন্দের। কিন্তু মোদির কী অধিকার আছে জরুরি অবস্থা সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করার?
সবাই জানি,ইমার্জেন্সি জারি হয়ে যাওয়া মানে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। মত প্রকাশের অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাবার, পরিকাঠামোর দাবি… কোনওটাই আর সহজলভ্য নয়। সংবিধানের একটি ধারা ব্যবহার করে সংবিধানকেই স্রেফ শেলফে তুলে রাখা। নাঃ, নরেন্দ্র মোদি সংবিধানের ৩৫২ নম্বর ধারা কার্যকরের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে করেননি। কিন্তু মৌলিক অধিকার সব বজায় আছে তো? বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো? কাজ করে পারিশ্রমিক পাওয়াটা যে কোনও দেশবাসীর সাংবিধানিক অধিকার। বাংলার যে মানুষগুলো ১০০ দিনের কাজে শ্রম দেওয়ার পর পারিশ্রমিকের আশায় বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছেন, তাঁদের মৌলিক অধিকার কি লঙ্ঘিত হয়নি? মত প্রকাশ করলেই কি সমাজকর্মী বা সাংবাদিকদের দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া হয়নি? সরকারি হিসেবই বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার নাগরিক ইউএপিএ বা সরাসরি রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত হয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই কি দোষী প্রমাণিত? না। মোদি সরকাররের রিপোর্টই বলে, ২০১৪ সাল থেকে যত রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের হয়েছে, তার ৯৭ শতাংশই ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন। তাহলে এভাবে আইনের ব্যবহার করে মত প্রকাশে তালা লাগানোর ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা কি অস্বাভাবিক? এটা কি অলিখিত জরুরি অবস্থা নয়?
তুমি আঞ্চলিক দল হিসেবে নির্বাচনে জিততেই পারো। কিন্তু আমার ছত্রচ্ছায়ায় থাকতে হবে। না হলে বন্ধ হবে সরকারি সুবিধা, ধেয়ে যাবে এজেন্সি। বিরোধী কোনও নেতা বা নেত্রী মোদি সরকার বা বিজেপির বিরুদ্ধে সরব হলে দরজায় কড়া নাড়বে ইডি। আর তার ভবিষ্যদ্বাণী করবেন সেই গেরুয়া দলেরই কোনও তল্পিবাহক নেতা। কীভাবে? সবটাই কি প্ল্যান্টেড? উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? এটাও কি জরুরি অবস্থা নয়? বেআব্রু হয়ে পড়বে মহামান্য ভারত সরকারের দুর্নীতি। আর সেই নিট পরীক্ষায় নতুন প্রজন্মের লক্ষ লক্ষ প্রতিনিধির আঘাতের কথা বলতে গেলে সংসদের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে বিরোধী দলনেতার মাইক। তাঁর কথা শুনবে না দেশ। শুনবে না অধিবেশন। নাঃ, ইমার্জেন্সি চলছে না। কিন্তু তাও সমালোচনা শোনা যাবে না। শুনতে দেওয়া যাবে না। এরপরও একে অলিখিত ইমার্জেন্সি বলা যাবে না? শোনা যায়, বিভিন্ন পত্রিকা ও চ্যানেলের সম্পাদকদের নিয়ে বৈঠকে বসেন ‘কোনও এক দলের’ শীর্ষ নেতা। প্রত্যেককে খুব বিনয়ের সঙ্গে কিছু প্রশ্ন করেন। একেবারে ব্যক্তিগত প্রশ্ন। বুঝিয়ে দেন, আপনাদের হাঁড়ির সব খবর আমাদের কাছে আছে। আর বলেন, ভোটে একটু দেখবেন। তারপর বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে যান। একে কী বলা যায়? গণতন্ত্র?
একনায়কতন্ত্রের শিকড় মোদি ভারতের মাটিতে মজবুত করছেন। ইন্দিরা গান্ধী দেশের জন্য যতটা নিজেকে উজাড় করেছিলেন, যেমন নীতির প্রণয়ন করেছিলেন, তার ছিটেফোঁটাও দেওয়ার ক্ষমতা নেই মোদি সরকারের। প্রশ্নফাঁস… পরীক্ষা দুর্নীতি… শিক্ষায় গৈরিকীকরণ… সাংবাদিকদের অধিকার হরণ, এসবই এই সরকারের মুকুটের পালক। আর ব্যাঙ্ক অধিগ্রহণ, গৃহহীন শ্রমিকদের মাথার উপর ছাদের ব্যবস্থা করা, ভূমি সংস্কার আইন, বন্ডেড লেবার প্রথার অবলুপ্তি, গরিব মানুষের ঋণ মকুব, আয়ের অনুপাতে মধ্যবিত্তকে কর কাঠামোয় সুবিধা, সবুজ বিপ্লব, এসব করার মুরোদ নেই। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নিয়ে মশকরা, মনরেগার টাকা আটকানো, এসবেই এই সরকারের যাবতীয় তৎপরতা।
মোদি (Narendra Modi) বাহিনীকে তাই দিকে দিকে পরাস্ত করুন। নইলে দেশ বাঁচবে না।
আরও পড়ুন: অতিরিক্ত ঘাম কমাতে