কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া টাকা খরচের পর একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ সরকারই ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষ পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব দিয়েছে। বকেয়া নেই একটিও ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট (ইউসি)। প্রত্যেক রাজ্যকে কৃষিমন্ত্রকের দেওয়া ১৯ জুনের চিঠিতে বাংলার এই উদ্যোগকে নজিরবিহীন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। একথা অন্য কেউ বলছে না। জানাচ্ছে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রকের দেওয়া তথ্য। তাদের কথা যদি সত্যি হয়, তবে তো মানতেই হবে ভোটের প্রচারে এসে নরেন্দ্র মোদি-সহ গোটা বিজেপি দল মিথ্যে কথা প্রচার করেছিল। বলা হয়েছিল, এ-রাজ্যের কৃষকরা কেন্দ্রীয় প্রকল্প থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এখন বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া টাকা খরচের পর একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ সরকারই ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষ পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব দিয়েছে। বকেয়া নেই একটিও ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট (ইউসি)। প্রত্যেক রাজ্যকে কৃষিমন্ত্রকের দেওয়া ১৯ জুনের চিঠিতে বাংলার এই উদ্যোগকে নজিরবিহীন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
আসল কথা, বাংলা-বিদ্বেষের কারণেই মোদির এই মিথ্যাচার। একের পর এক ভোটে ভরাডুবির পর মরিয়া হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারকে যেভাবে হোক মানুষের চোখে হেয় করার চেষ্টা। তবে শেষমেশ তা আর ধোপে টিকল না। শুধুমাত্র ভোট পেতে বাংলার কুৎসা থেকে শুরু করে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে নানাভাবে মিথ্যাচার চালিয়েছিল গেরুয়া শিবির। তার জবাব বাংলার মানুষই ভোটবাক্সে ওদের দিয়েছে। এবার কেন্দ্রের দেওয়া চিঠিতেও তা স্পষ্ট হয়ে গেল। সব ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা বজায় রেখে কাজ করে বাংলা— এটাই আরও একবার প্রমাণ হয়ে গেল।
গত ১৩ বছরে কৃষকবন্ধু, বাংলা শস্যবিমার মতো একাধিক প্রকল্প রাজ্যের কৃষকদের জন্য চালু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। একইসঙ্গে, কেন্দ্র-রাজ্য যৌথভাবে রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা (আরকেভিওয়াই) সহ বেশ কিছু প্রকল্পও চালু হয়েছে। এতে কেন্দ্রের ৬০ শতাংশ টাকার পাশাপাশি ৪০ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করে রাজ্য। গড়ে তোলা হয় কৃষি-পরিকাঠামো। এই ক্ষেত্রে ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে কেন্দ্র এবং রাজ্যের অনুদান মিলিয়ে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। তবে শুধু তৃণমূল স্তর পর্যন্ত কাজের রূপায়ণ নিশ্চিত করাই নয়, প্রতিটি কাজের খুঁটিনাটি রিপোর্ট ও হিসেব জমা দেওয়া হয়েছে রাজ্যের তরফে। এই প্রকল্পের অধীনে হওয়া অন্তত ২৫ শতাংশ কাজের থার্ড পার্টি বা তৃতীয় স্বাধীন কোনও সংস্থাকে দিয়ে নজরদারি এবং মূল্যায়ন করানো বাধ্যতামূলক । একেবারে ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের জন্যই এই ২৫ শতাংশ মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে কেন্দ্রের চিঠিতে। এই মূল্যায়নের ফলে কৃষক সমাজের জন্য প্রকল্পগুলিতে আগামী দিনে কোনও পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখার কথা জানিয়ে গত মাসের ১৩ তারিখ কেন্দ্র রাজ্য সরকারকে একটা চিঠিও দিয়েছে। সেসব থেকে একটা কথা পরিষ্কার। পশ্চিমবঙ্গ কোথাও কোনও হিসাব বকেয়া রাখেনি অথচ সেটাকেই অজুহাত করে বিজেপি রাজ্যের গরিব মানুষের টাকা আটকে রেখেছে। যদি হিসাব না দেওয়ার কথা ঠিক হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় রিপোর্ট মিথ্যে। আর কেন্দ্রীয় রিপোর্ট ঠিক হলে বিজেপি ভোটের সময় মিথ্যে বলেছিল। কোনও একটা জায়গায় তো ওরা মিথ্যাচার করেছে। এখন ওরাই বলুক, কখন ওরা মিথ্যে বলেছে।
আসলে, মোদি আর বিজেপি মানেই ভূরি ভূরি মিথ্যাচার। বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি ১০ বছরেও। শরিকদের কাঁধে ভর করে তৃতীয়বার সরকারে ফিরেছেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু সেই ধাক্কার পরও দেশের কর্মসংস্থানের ছবিতে বদল এল না। ফের বৃদ্ধি বেকারত্বের হারের।
শুধু বাড়েনি, গত আট মাসে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে গিয়েছে। এমনই উদ্বেগজনক তথ্য সামনে এসেছে সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র সমীক্ষা রিপোর্টে। তাদের দাবি, গত জুন মাসে দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ৯.২ শতাংশ। তার আগের মাসে (মে) তা ছিল ৭ শতাংশ। অর্থাৎ একমাসের মধ্যে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় আড়াই শতাংশ। এমনকী ২০২৩ সালের জুনের পরিসংখ্যানকেও (৮.৫ শতাংশ) তা ছাপিয়ে গিয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে দেশের আর্থিক অবস্থার হাল নিয়ে।
শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি আরও বেহাল। তা স্পষ্ট হয়েছে সিএমআইই-র কনজিউমার পিরামিডস হাউসহোল্ড সার্ভেতে। সেই রিপোর্ট বলছে, গত মে মাসে গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের হার ছিল ৬.৩ শতাংশ। জুনে তা একধাক্কায় বেড়ে ৯.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত বছর এই মাসে তা ছিল ৮.৮ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে পুরুষদের বেকারত্বের হার মে মাসে ছিল ৫.৪ শতাংশ। জুনে তা বেড়ে ৮.২ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে তা একধাক্কায় পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মে মাসে তা ছিল ১২ শতাংশ। সেটা জুনে ১৭.১ শতাংশে পৌঁছেছে। সরকারি তথ্য বলছে, শহরকে ছাপিয়ে গ্রামীণ অঞ্চলে রকেটের গতিতে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নীতি নির্ধারণ কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি। তার মধ্যেই এবার রোজগারের সুযোগের অভাবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সংসারে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার খুব বেশি বাড়েনি। গত মে মাসে শহরে এই হার ছিল ৮.৬ শতাংশ। জুনে তা হয়েছে ৮.৯ শতাংশ। গ্রামের মতো শহরেও মহিলাদের বেকারত্বের হার অনেকটাই বেড়েছে। মে মাসে ছিল ১৮.৫৩। জুনে বেড়ে হয়েছে ২১.৩৬ শতাংশ। সারা দেশের হিসেবে মহিলাদের কর্মহীনতার হার জুনে ছিল ১৮.৫ শতাংশ। জাতীয় গড়ের তুলনায় তা অনেক বেশি।
ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে রোজগারের অভাব সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। নিত্যদিনের সংসার-জোয়াল টানতে রীতিমতো কালঘাম ছুটছে মানুষের। সম্প্রতি ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিসের (এনএসও) সমীক্ষাতেও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের বেহাল ছবি দেখা গিয়েছে। এমনকী তা কোভিড পর্বের আগের পর্যায়েও পৌঁছতে পারেনি।
মিথ্যা আর ব্যর্থতা, এই দুয়ের যোগফল বিজেপি। এটা পরিষ্কার।
আরও পড়ুন: ছক ভাঙার গল্প