অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ

৫ জুলাই মুক্তি পেয়েছে ‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’। দুলাল দে পরিচালিত বাংলা ছবি। গল্প দানা বেঁধেছে একটি খুনের ঘটনাকে ঘিরে। তীব্র নাটকীয়তায় মোড়া। চিত্রনাট্য, সংলাপ টানটান। গতি আছে। প্রথমবার গোয়েন্দার চরিত্রে জিতু কমল। সবমিলিয়ে দেখার মতো। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

গোয়েন্দা গল্প বাঙালির বড় প্রিয়। সে বইয়ের পাতায় হোক বা বড়পর্দায়। বিদেশি গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমস যেমন আছেন, তেমনই বাংলার ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কিরীটী, কাকাবাবু, দীপক, শবর, একেন প্রমুখ আছেন পছন্দের তালিকায়। গোয়েন্দা বা সত্যান্বেষীদের নিয়ে তৈরি হয়েছে বেশকিছু ছবি। সেই তালিকায় নতুন সংযোজন অরণ্য।
৫ জুলাই বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে বাংলা ছবি ‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’ (Aranyer Prachin Probad)। নাম শুনে মনে হতে পারে, ছবিটি জঙ্গলঘেরা কোনও অঞ্চলের ঘটনা নিয়ে বোনা। আসলে তা কিন্তু নয়। এই ছবির মূল চরিত্রের নাম অরণ্য চট্টোপাধ্যায়। তিনি একজন গোয়েন্দা।

কী আছে ছবির গল্পে? পানাঘাট অঞ্চলের একটি সরকারি হাসপাতাল ঘিরে ছবির গল্প দানা বেঁধেছে। এই হাসপাতালে চিকিৎসক হয়ে আসেন সৎ, আদর্শবান যুবক অমিত রায়। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য এলাকার গরিব মানুষের সেবা করা এবং সঠিক ভাবে তাঁদের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া। সাধারণ মানুষ উন্নত পরিষেবা পেতে থাকেন হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিছুদিনের মধ্যেই অমিতকে তাঁরা ভগবানের চোখে দেখতে শুরু করেন। হাসপাতালে কাজ করতে করতেই নার্স দেবযানীর সঙ্গে অমিত জড়িয়ে পড়েন প্রেমের সম্পর্কে। বিয়ে করেন বাড়ির অমতেই। অমিতের সততা, দায়িত্ববোধ এবং হাসপাতালের প্রতি ভালবাসা একটা সময় পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় এলাকার নার্সিংহোমের মালিকদের। ধাক্কা লাগে স্বাস্থ্য নিয়ে অসাধু চক্রের সাজানো ব্যবসায়। তখনই বেরিয়ে আসে কিছু ক্ষমতাবান মানুষের দাঁত, নখ। হঠাৎ একদিন খুন হয়ে যান অমিত। তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয় নদীর ধারে, একটা বস্তার মধ্যে। শুরু হয় তদন্ত। হেলায় পেরিয়ে যায় একটি বছর। পুলিশ খুনের কিনারা করতে পারে না। শেষমেশ সিআইডি অফিসার সুদর্শন হালদার এই খুনের কিনারার লক্ষ্যে পানাঘাট আসেন। তাঁর সঙ্গে আসেন ডাক্তারির ছাত্র, ক্রিকেট-ভক্ত শ্যালক অরণ্য চট্টোপাধ্যায়। রহস্য সমাধানে অরণ্যর মাথা এক্সপ্রেস ট্রেনের গতিতে ছোটে। তিনি বেসরকারি ভাবে জড়িয়ে পড়ছেন রহস্য সমাধানে। ছবির গল্প একজন আদর্শবান মানুষের শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলার গল্প। এমন একজন মানুষ, যিনি ক্ষমতার কাছে কোনওভাবেই মাথা নত করেন না। শেষ পর্যন্ত সৎ থাকেন। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই চালিয়ে যান।

আরও পড়ুন- দুষ্কৃতীদের ছাড় নয়, কড়া হাতে দমন করছে প্রশাসন

ছবিতে অরণ্যর চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন জিতু কমল। এই প্রথম তাঁকে দেখা গেল গোয়েন্দা চরিত্রে। বলা যায় তিনি যথেষ্ট সফল। জিতু একজন মেথড অ্যাক্টর। আগেও তা প্রমাণিত হয়েছে। সাবলীলভাবে উচ্চারণ করেছেন সংলাপ। ছবি জুড়ে কথা বলেছে তাঁর দুটি চোখ। কোথাও আবেগের প্রকাশ ঘটাননি। এগিয়েছেন মেপে। দাঁতে দাঁত চেপে। কেরিয়ারে এখনও পর্যন্ত তাঁর ছবির সংখ্যা হাতে গোনা। আশা করা যায় বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে আগামী দিনে যথাযথভাবে ব্যবহার করবে। বাংলা বাজারের যে-কোনও এলিট গোয়েন্দার চরিত্রে ভবিষ্যতে তাঁকে দেখা গেলে কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাঁর মধ্যে রয়েছে সমস্ত উপাদান।

চিকিৎসক অমিত রায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুহোত্র মুখোপাধ্যায়। কিছু ছবি এবং ওয়েব সিরিজের দৌলতে ইতিমধ্যেই তিনি হয়ে উঠেছেন দর্শকদের প্রিয় অভিনেতা। চেহারায় তেমন ঔজ্জ্বল্য নেই, তবে তাঁর চোখমুখ বুদ্ধিদীপ্ত। জিতুর মতোই বলিষ্ঠ কণ্ঠের অধিকারী। অভিনয় করেন মেধা দিয়ে। নিজেকে সরিয়ে রেখে চরিত্র হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। এই ছবিতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

নার্স দেবযানীর চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন মিথিলা। বাংলাদেশের এই অভিনেত্রী গত কয়েক বছরে হয়ে উঠেছেন এ-পারের দর্শকদের প্রিয় মুখ। অবশ্যই নিজের কাজ দিয়ে। ছবি জুড়ে সংযত অভিনয় করেছেন তিনি।

সিআইডি অফিসার সুদর্শনের চরিত্রে দেখা গেছে শিলাজিৎ মজুমদারকে। গল্পের খাতিরে চরিত্রটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তবে ছবিতে তাঁকে খুবই সাধারণ মনে হয়েছে। যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন, ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।

সহকারীর চরিত্রে সায়ন ঘোষের অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে। সুপারের চরিত্রে লোকনাথ দে যথাযথ। দিবাকরের চরিত্রে নজর কেড়েছেন নীলাদ্রি মৈত্র। রাজনীতিকের স্ত্রীর ভূমিকায় মার্জিত অভিনয় করেছেন অনন্যাথ। আবহে শুভদীপ গুহ এবং ক্যামেরায় প্রতীপ মুখোপাধ্যায় বিশেষ ছাপ ফেলেছেন।

ছবিটি পরিচালনা করেছেন দুলাল দে। তিনি অন্য জগতের মানুষ। ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবেই মূলত তাঁর পরিচিতি। তুলে ধরেন সবুজ মাঠের কথা। চেনা পরিধির বাইরে বেরিয়ে তিনি অসাধারণ একটি ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। এটাই তাঁর প্রথম ছবি। বলা যায়, প্রথম ছবিতেই যথেষ্ট মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। রীতিমতো ছক্কা হাঁকিয়েছেন। তাঁর কাছে প্রত্যাশা বেড়ে গেল। ছবি জুড়ে দুটি গল্প সমান্তরাল ভাবে এগিয়েছে। বর্তমানের পাশাপাশি বারবার ফিরে এসেছে অতীত। তবে কোথাও বিন্দুমাত্র তাল কাটেনি। গল্প, চিত্রনাট্য এবং সংলাপ রীতিমতো টানটান, নিটোল। তীব্র নাটকীয়তায় মোড়া। ছবিতে গতি আছে। দৃশ্যের পর দৃশ্য এগিয়েছে স্বাভাবিক ছন্দে। দর্শকদের এক চুলও নড়তে দেয় না। কে অপরাধী, জানার জন্য অপেক্ষা করতে হয় একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। সবমিলিয়ে জেএসএম এন্টারটেইনমেন্ট প্রযোজিত ‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’ (Aranyer Prachin Probad) দেখার মতো একটি ছবি।

Latest article