তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়ে এবার বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন এই সাংবাদিক-বিধায়ক। কিন্তু তাঁর অল্প সময়ের অভিজ্ঞতাটাই বিজেপির মুখোশ খোলার পক্ষে যথেষ্ট। পদ্মশিবিরের কিছু অকথিত কাহিনি লিখলেন প্রবীর ঘোষাল
আরও পড়ুন-লালা লাজপত রায়ের প্রয়াণ দিবসে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য
বিধানসভা ভোটে পদ্মফুলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পরই আমার কিছু শুভানুধ্যায়ী জিজ্ঞাসা করেছিল, বিজেপি করতে পারবি তো? এদের কী নিম্নমানের রুচি দেখেছিস? তাদের এই প্রশ্ন তোলার সঙ্গত কারণ ছিল। এলাকার বিজেপি’র একাংশ আমার প্রার্থীপদ মেনে নিতে পারেনি। তারা প্রকাশ্যেই প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু যে কুরুচিকর ভাষা প্রয়োগ এবং মিথ্যা অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে করেছিল সেইসব নিয়েই আমার হিতাকাঙ্ক্ষীরা প্রশ্ন তুলেছিল। তখনও বুঝতে পারেনি বিজেপি-র ভিতরটা কতটা নরকগুলজার হয়ে আছে।
আরও পড়ুন-লালা লাজপত রায় এর প্রয়াণ দিবসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য
অবশ্য নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে এসেছে ততই পদ্মফুলের কদর্য কাজিয়ার চেহারাটা গোটা রাজ্য জুড়ে বেআব্রু হয়ে পড়েছে। ব্যতিক্রম আমার নির্বাচনী কেন্দ্রও ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়েই নতুন দলে পথচলা শুরু হল। প্রার্থী ঘোষণার পর বিজেপির নিচেরতলার সিংহভাগ কর্মী-সমর্থক আমার হয়ে কাজে নামতে চান। প্রাথমিক কাজ ছিল, প্রচারের জন্য দেওয়াল দখল। এমনিতে পদ্মফুলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ অস্বাভাবিক দেরি হওয়ার জন্য বিজেপি’র প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেস আগেই ম্যাচ জিতে গিয়েছিল।
অধিকাংশ দেওয়ালই তারা আগেভাগে দখল করে নিয়েছিল। বাদবাকি দেওয়ালের অনেকটা সিপিএম নিয়েছিল। উচ্ছিষ্ট পড়ে ছিল। সেই দেওয়াল দখল করে লিখতে গিয়ে নিজের দলের নেতা-নেত্রীদের কাছ থেকেই বিজেপি’র কর্মীরা হুমকি-ধমকের মুখোমুখি হচ্ছিলেন। আমার কাছে এসে তাঁরা নালিশ করতে লাগলেন। আমি বিষয়টি উচ্চ নেতৃত্বের গোচরে আনি। সেসব শুনে বিজেপি’র সংশ্লিষ্ট জেলা সংগঠনের এক শীর্ষ কর্তা আমাকে পরামর্শ দেন, ‘‘আপনি বরং অন্য কোনও কেন্দ্রে প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করুন।”
আরও পড়ুন-আজ প্রথম টি-২০ , উইলিয়ামসনের বদলে নেতৃত্বে সাউদি
বিজেপি’র অসংখ্য শাখা সংগঠন। ৬০টিরও বেশি। পদাধিকারীরা সবাই নিজেদের নেতা-নেত্রী মনে করেন। কেউ কর্মী নন। তাঁদের সকলের আলাদা আলাদা দাবি-সনদ। বেশিরভাগই অর্থকেন্দ্রিক। কাজ করার চেয়ে টাকা চাওয়ার লোক বেশি। আমি সবাইকে বলি, বুথ সংগঠন কারা করে? তাদের তালিকা কই? শেষমেশ বুথের দলীয় সভাপতিদের নামের একটি তালিকা এবং তাঁদের মোবাইল নম্বর আমাকে দেওয়া হয়।
সেই তালিকা ধরে ধরে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের ফোন করার দায়িত্ব দিলাম আমার বিশ্বস্ত দুই সহকর্মীকে। তারা যে তথ্য দিল, তাতে চক্ষু চড়কগাছ! সেই তালিকার ৮০ শতাংশের বাস্তবে অস্তিত্বই নেই। হয় ফোন নম্বর, নয়তো নামটাই ভুয়ো। আর যাঁদের ফোনে নাগাল পাওয়া যাচ্ছে, তাঁদের অনেকেই বলে দিচ্ছেন, ‘‘আমরা বিজেপি’র সঙ্গে যুক্ত নই। সুতরাং ভোটে কাজ করার কোনও প্রশ্নই নেই!”
আরও পড়ুন-হাঁপানি নিরাময়ে
এই অবস্থার মধ্যে বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিজেপি’র হিন্দিভাষী পর্যবেক্ষকদের আগমন শুরু হয়। আমার ভাগ্যে জুটল হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থানের নেতা-বিধায়করা। তাদের খাঁই বিরাট। হোটেল-গাড়ি বন্দোবস্ত করতে হবে। হরিয়ানার এক বিধায়ক গাড়ি পেয়েই দু’দিনের সফরে চলে গেলেন গঙ্গাসাগর দর্শনে! উত্তরপ্রদেশের এক তরুণ বিজেপি নেতা হঠাৎ একদিন এসে বললেন, তাঁর ব্যাগ থেকে এক লক্ষ টাকা চুরি হয়েছে।
ওই নেতার সন্দেহ, চোর টাকাটা হাতিয়েছে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কার্যালয় থেকে। এমনভাবে টাকার জন্য কাকুতিমিনতি করতে লাগলেন যে, তাঁকে ৫০ হাজার টাকা জোগাড় করে দিতে হল। আর এক পর্যবেক্ষক এই ঘটনা শুনে মুচকি হাসলেন। সঙ্গে মন্তব্য করলেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশের নেতা তো এই ভোটের পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসবেন। তারই প্রস্তুতি আর কী!’’
কী যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যে কাজ করতে হয়েছে তা কাকে বোঝাব। রোজ নির্বাচনী কেন্দ্রের চারদিক থেকে শুধু ঝগড়া নয়, নিজেদের মধ্যে মারামারির খবরও আসতে লাগল। একদিন তো একদল ছেলে মার খেয়ে ছেঁড়া পাঞ্জাবি-পাজামা পরে দল বেঁধে বাইক নিয়ে অফিসে এসে হাজির। আমি বললাম, ‘‘তোমাদের তো রাস্তার লোকজন এই অবস্থায় দেখল? এইসব দেখে আর মানুষ বিজেপিকে ভোট দিতে চাইবে?” এসব প্রশ্নে তাদের কোনও হেলদোল নেই। তারা তখন বিজেপি’র যুযুধান গোষ্ঠীকে খতম করার হুমকিতে মত্ত।
ভোটের সাতদিন বাকি। বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ আসবেন, সাংগঠনিক জেলার প্রার্থীদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করবেন। সন্ধ্যার প্রচার বন্ধ করে ১ ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে হাজির হলাম বৈঠকস্থলে। আরও ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর বলা হল, দিলীপবাবু বিশেষ কাজে জেলা ছেড়ে কলকাতায় চলে গিয়েছেন। বৈঠকে আসতে পারবেন না। কয়েক ঘণ্টা এইভাবে ভোটের মুখে নষ্ট হওয়ার পর বিজেপি’র রাজ্য সভাপতিকে সরাসরি ফোন করলাম। জানতে চাইলাম, এলেন না কেন? তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। দিলীপবাবু বললেন, “আপনাদের নিয়ে কোনও বৈঠকের খবর তো আমার জানা ছিল না!’’
এরকম দুঃসহ অবস্থার মধ্যে দু’বার আমি ভোটের ময়দান থেকে সরে আসতে চেয়েছিলাম। একদিন রাতে তো সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেও ফেলেছিলাম। কিন্তু মাঝপথে ভোটে লড়ছি না ঘোষণা করলে, গোটা রাজ্যে বিজেপি’র মুখ পুড়তে পারে। এই আশঙ্কায় পদ্মফুলের কয়েকজন নেতা ছুটে আসেন। তাঁরা কার্যত আমার হাতেপায়ে ধরে অনুরোধ করেন, ‘‘আমাদের এতবড় সর্বনাশ করবেন না।” এখন মনে হয়, তাঁদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেই বোধহয় ঠিক কাজ হত। কারণ, বিজেপি’র মতো দিশাহীন একটি রাজনৈতিক দলে আমাদের মতো মানুষরা নিঃসন্দেহে একেবারেই বেমানান!