আদিম মানুষের অনিশ্চয়তা থেকে জন্ম নিয়েছিল নানান দেবদেবী। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য সংগ্রহের অনিশ্চয়তা, বিভিন্ন রোগ ব্যাধি থেকে মানুষের মনে জন্ম নিল ভয় এবং এর থেকে এল অযুত দেবদেবী, পুজো অচ্চর্নার নানা রীতি ও বিধি। তেমনি এক লৌকিক দেবী হলেন বিপদতারিণী। বিপদ তারণ করেন যিনি তিনিই বিপত্তারিণী (Bipodtarini Puja)।
প্রভু জগন্নাথ রথে চেপে মাসির বাড়িতে কিছুদিন থাকেন। উল্টোরথের দিন তিনি বাড়ি ফেরেন। জগন্নাথদেবের রথ থেকে উল্টোরথ যাত্রার মধ্যে অর্থাৎ আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া থেকে শুক্লা দশমীর মধ্যে মঙ্গলবার এবং শনিবার এই পুজো হয়ে থাকে।
‘শনি বা মঙ্গলবার নবমীর মাঝে
উপযুক্ত হবে যেন এই ব্রতের কাজে।’
দেবী দুর্গার ১০৮ রূপের মধ্যে অন্যতম দেবী সঙ্কটনাশিনীর এক রূপ বিপত্তারিণীর (Bipodtarini Puja)।
দেবী পুরাণে দেবীর নানা রূপের বিশেষ বর্ণনা রয়েছে। যার মধ্যে দেবী বিপত্তারিণী প্রসঙ্গ ও রয়েছে। দেবী রক্তবর্ণা, চতুর্ভুজা ও ত্রিনয়না। কোথাও তিনি শঙ্খ, চক্র, শূল, অসিহস্তা, স্বর্ণবর্ণা, ত্রিনয়না। কোথাও আবার ঘোর কৃষ্ণা, লোলজিহ্বা, খড়্গ, শূলহস্তা সিংহে আসীন বরাভয় দায়িনী। বাংলার ঘরে ঘরে দেবী পূজিতা হন রক্ষাকর্ত্রী হিসাবে। কথিত আছে মার্কেণ্ডেয় মুনি প্রথম বিপত্তারিণী ব্রতকথা প্রচার করেন। তারিণ্যুপনিষদ নামে এক তন্ত্র-গ্রন্থে এই দেবীর হদিশ পাওয়া যায়। এছাড়াও বিপত্তারিণীতন্ত্রম্ নামে আরেকটি পুঁথিতেও এই দেবীর উল্লেখ রয়েছে।
আবার কথিত আছে, মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে পাণ্ডবদের বিপদ নাশ ও রক্ষায় তাঁদের হাতে বেঁধে দিয়েছিলেন তেরোটি গিঁট দেওয়া লালসুতো। বলা হয় দেবী গৌরী মাত্রই মহামায়ার রূপ। সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা কখনও অসুরনাশিনী আবার কখনও তিনি বিপত্তারিণী (Bipodtarini Puja)।
দেবী বিপত্তারিণী আসলে বাংলার এক লৌকিক দেবী। বিপত্তারিণী অর্থাৎ বিপদ থেকে রক্ষা করেন যিনি। তবে মূলত দেবী দুর্গার আরেক রূপের আরাধনা। বিপত্তারিণী দেবীর পুজো করলে সমস্ত রকম বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এমনটাই বিশ্বাস ভক্তদের।
সংসারের কল্যাণ কামনায় সাধারণত মহিলারাই এই ব্রত পালন করে থাকেন।
বিপত্তারিণী ব্রত পালনের সঙ্গে তেরো সংখ্যাটির এক বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কী সেই তাৎপর্য?
পুজোর নিয়ম অনুযায়ী দেবীকে সবকিছু তেরোটা করে উৎসর্গ করতে হয়। যেমন তেরোটি ফল দিয়ে নৈবেদ্য সাজাতে হয়। তেরো রকম ফুল, তেরোটি পান, তেরোটি সুপারি, তেরোটি বড় এবং ছোট এলাচ, তেরোটি পৈতে।
‘আপনার প্রিয় দ্রব্য সাজাবে যতনে
ত্রয়োদশ করি ফল দিবে গুনে গুনে
নৈবেদ্যের সাথে দিবে তম্বুল ও জল
ব্রাহ্মণে করিবে দান হইবে সফল’
এছাড়াও বিপত্তারিণী (Bipodtarini Puja) ব্রত পালনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে হাতে বাঁধতে হয় লাল তাগা বা ডোর। পবিত্র এই ডোর তৈরির ক্ষেত্রেও তেরোটি গিঁট দিতে হয়, তেরো গাছা দূর্বা সহযোগে। এই তেরো গিঁট বিশিষ্ট তাগা বা ডোরকে বিপদ থেকে রক্ষাকারী প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়।
‘তেরোটি গাঁইট দিয়ে রক্তবর্ণ সুতা
সকলে বাঁধিবে হস্তে না হয় অন্যথা’।
এই পুজোকে নিয়ে রয়েছে নানান প্রচলিত কাহিনি। কী সেইসব কাহিনি আসুন দেখে নেওয়া যাক।
শ্রীমন্ত সদাগার বাণিজ্য করতে তরী-পরিপূর্ণ জিনিসপত্র নিয়ে সমুদ্রের পথে পাড়ি দিলেন। কালীদহে এসে এক অপূর্ব বিষয় চাক্ষুষ করলেন। কালীদহের পদ্মবনে দেবীকে প্রত্যক্ষ করলেন। শ্রীমন্ত ভক্ত মানুষ সারাক্ষণই দেবীর স্তব করেন। আর দেবীর অকস্মাৎ অভাবনীয় দর্শনে উদাত্ত কণ্ঠে অবিরাম মা মা বলে স্তুতি করে চললেন।
সমুদ্রপথ শুরু হল প্রকৃতির খেয়ালে ভীষণ ঝড় বৃষ্টি। মগরার মোহনায় এসে নৌকা প্রায় উল্টে যায়যায় আর কি! তবে ভক্তের ভগবানকে আহ্বানে রক্ষা পেল নৌকা। এইভাবে দেবীর আশীর্বাদে সমুদ্রপথে প্রকৃতির নানা খেয়াল পেরিয়ে সিংহলে এসে দড়ি ফেলল শ্রীমন্ত। সিংহলে রাজার সঙ্গে সীমন্তের পরিচয় হল।
রাজা জানতে চাইলেন পরিচয়।
‘পরিচয় জিজ্ঞাসিল সিংহল ভূপতি
কি নাম হয় তোমার কোথায় বসতি।’
শ্রীমন্ত জানালেন, ‘বাণিজ্যের তরে সিংহলেতে আগমন।’
কথায় কথায় সরল মনে দেবী দর্শনের কথা রাজাকে জানাল। সেকথা শুনে রাজা তো অভিভূত—
‘শুনি রাজা বলে মোর লাগে চমৎকার
যদি তা দেখাতে পারো দিব পুরস্কার।’
অর্ধেক সাম্রাজ্য তো পাবেই, সঙ্গে কন্যাকেও দেব। সিংহলের জামাই হবে তুমি। রূপে গুণে কন্যা আমার দেবীসম। আর যদি তোমার কথা অসত্য প্রমাণিত হয় তাহলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।
‘শ্রীমন্ত কহিল রাজা মিথ্যা না কহিব
যাহা দেখিয়াছি আমি নিশ্চয়ই দেখাব।’
সিংহল ভূপতি আর শ্রীমন্ত এলেন কালীদহের জলে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় রাজার চোখে কিছুই পড়ল না। দেবী দর্শনের সাধ অধরাই রয়ে গেল ভূপতির। ক্রোধে অগ্নিশর্মা রাজা শ্রীমন্তকে বধ করার আদেশ দিলেন জল্লাদকে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে করজোড়ে বিপত্তারিণী দেবীর স্তব শুরু করলেন শ্রীমন্ত এক মনে। ভক্তের কাতর আহ্বানে দেবী দেখা দিলেন। দয়াময়ী ভক্তের জননী ভক্তের প্রাণ রক্ষা করলেন।
‘মায়ের মাহাত্ম্য কে কেবা বর্ণিতে পারে
আপনি আসিল চণ্ডী তাকে রক্ষীবারে।’
আগেই লিখেছি মায়ের মাহাত্ম্য নিয়ে নানা কাহিনি রয়েছে। সেই রকমই আরও একটি কাহিনি হল ধনপতি সদাগর আর খুল্লনার কাহিনি।
ধনপতি নামে এক সদাগর ছিলেন। তাঁর দুই পত্নী। তাঁরা অত্যন্ত সুন্দরী। খুল্লনা নামে এক স্ত্রীর মনে ছিল খুব দুঃখ। রাজা তাঁকে ভাল চোখে দেখতেন না। স্বামীর ভালবাসা পাওয়ার আশায় সে দেবী বিপত্তারিণী পুজোর আয়োজন করল। সওদাগর জানতে পেরে ঘট ভেঙে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। সেই ভাঙা ঘট মাথায় নিয়ে খুল্লনা কেঁদে কেঁদে দেবীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
এদিকে, সদাগর বাণিজ্যে যায়। পথের বিপদে তাঁর প্রাণ সংশয় হয়। খুল্লনা কেঁদে কেঁদে দেবীকে এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য আর্জি জানায়।
‘বিপদতারিণী স্মরি খুল্লনা কাতরা
পাঠাল শ্রীমন্ত পুত্রে উদ্ধারিতে ত্বরা।’
দেবীর কৃপায় সে-যাত্রা ধনপতি উদ্ধার পেল।
আরও দুটি প্রচলিত কাহিনি দিয়ে দেবীমাহাত্ম্য বর্ণনা শেষ করব।
বিদর্ভের রাজা সত্যদাস এবং তাঁর পুত্র অলকেশ একবার হরিণ শিকার করতে পথ ভুলে পাশের রাজ্য অবন্তীপুরের সীমানায় ঢুকে পড়েন। সে জায়গাটি ছিল অবন্তী রাজ্যের মৃগয়াক্ষেত্র। অনধিকার প্রবেশ ও সেখানে একটি হরিণ শিকার করায় অবন্তী রাজ্যের সেনারা তাকে বেঁধে নিয়ে যায় রাজদরবারে।
সেই সময় অবন্তী রাজ্যের রাজা ছিলেন চক্রধর। তিনি সমস্ত ঘটনা শোনার পর অলকেশকে বন্দি করার আদেশ দেন।
আরও পড়ুন- বিজয়া
‘রক্তচক্ষু মহারাজ হেরিয়া তাহারে
আদেশিল রাখ গিয়া অন্ধ কারাগারে।’
অলকেশকে বন্দি হওয়ার খবর যখন চলে যায় রাজপুত্রের পিতার কাছে, তখন রাজা সত্যদাস ছুটে আসেন অবন্তীরাজের দরবারে। কিন্তু অবন্তীরাজ রেগে তাকেও বন্দি করে রাখেন। বিদর্ভের রাজপুত্র এবং রাজার বন্দি হওয়ার খবর শুনে রানি রত্না কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এই সময়ই দৈববাণী শোনেন রানী—
‘বিপত্তারিণী দুর্গায় পুজোহ বিশেষ
আমার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা তোমার অশেষ।’
দুঃখ সাগরে ভেসে যেতে যেতে তিনি চোখের জল মুছে পুজোর আয়োজন করতে শুরু করেন।
সেদিন ছিল রথযাত্রার পরের মঙ্গলবার। একাগ্র মনে রানি দেবীর স্তব করতে লাগলেন এই বিষম বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। এই দেবী হলেন দেবী দুর্গার আরেকটি রূপ। দেবীর চরণে মনোকামনা পূরণের কামনা জানালেন রানি রত্না।
এবং দৃঢ় সংকল্প করলেন মায়ের কৃপা না হলে তিনি দেহত্যাগ করবেন।
‘বিপদনাশিনী মা জগৎ জননী
এ ঘোর সংকট হতে রক্ষা করো তুমি।’
কিন্তু সঠিক সময়ে দেবী অবন্তীরাজকে স্বপ্নাদেশ দেন, ‘আমার ভক্ত কে বন্দি করায় আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের মুক্তি দাও।’
‘সে মোর প্রিয় জানো নাকি তুমি’
এই স্বপ্ন দেশ পেয়ে অবন্তীরাজ বিদর্ভের রাজপুত্র এবং রাজাকে মুক্তি তো দিলেনই এবং নিজের কন্যার সঙ্গে রাজপুত্রের বিবাহ দিয়ে আত্মীয়তা সূত্রে বাঁধলেন। দেবীর কৃপা লাভ করে দুই রাজ্যে শান্তি ফিরল।
দেবীর মাহাত্ম্য নিয়ে এমন একাধিক বৃত্তান্ত রয়েছে। তেমনি আর ও একটি কাহিনী হল—
বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ বংশের রানি গুণবতীর এক নিম্নবর্ণের সখী ছিল। তিনি জাতে মুসলিম। সেই সখী নিয়মিত গোমাংস খেতেন। রানিও একদিন কৌতূহলী হয়ে গোমাংস খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। সখী কিন্তু কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না প্রথমে। কিন্তু রানির বারবার আবদারে তিনি গোমাংস আনেন। যেই খবর নিষ্ঠাবান ধার্মিক রাজা সত্যক্রমের কাছে পৌঁছে যায়। রাজা অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে দেখতে চান সখী রানিকে কি দিয়েছে। এই বিপদে রানি সখীর আনা গোমাংস আঁচলে লুকিয়ে রেখে বিপত্তারিণী মা দুর্গাকে স্মরণ করতে থাকেন। রানিকে তল্লাশি করে রাজা দেখতে পান তার আঁচলের আড়ালে গোমাংস নয় রয়েছে একটি লাল জবা। লাল জবা কালীপুজোর অন্যতম উপকরণ। মায়েরই ফুল দেখে রাজা তাঁর ভুল বুঝতে পারেন এবং রানিকে ক্ষমা করে দেন। মা বিপত্তারিণীর (Bipodtarini Puja) কৃপায় রানির বিপদ কেটে যায়।
‘কেন মাতা তুমি এত মনে করো ভয়
আমার নাম জানো তো নিশ্চয়
জানো, বিপদে পড়িয়া যেবা লয় পদাশ্রয়।
কাহার বিপদ মাগো কখন কি রয়
স্তবে তুষ্টা হইল আমি দিলা এই বর।
মাংস হইল পুষ্প দেখো অতঃপর।’
এরপর থেকে রানি নিষ্ঠা সহকারে বিপত্তারিণী দেবীর পুজোপাঠ করতে থাকেন।
‘দুর্গ দুঃখ হরা তারা বিপদনাশিনী
দুর্গমে স্মরি মা তারা শক্তি সনাতনী।।’