এই ভরা পচাগরমের ফাঁকেই বর্ষার শুভারম্ভ। নিঃসন্দেহে বৃষ্টি এখন আমাদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। বৃষ্টির কয়েক ফোঁটাতেই মিলেছে স্বস্তি, শান্তি আর আনন্দ। সতেজ আর প্রাণবন্ত হয়েছে শরীর-মন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই বর্ষাতেই আবার আমরা এমন অনেক সমস্যায় পড়ি যা অন্য ঋতুতে আমাদের সচরাচর পড়তে হয় না। যেমন চুল পড়া। শুধু চুল পড়া নয় চুলের যাবতীয় সমস্যা যেন এই ঋতুতে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে। সারাবছর ধরে থাকা চুলের (Hair Care) সমস্যা এই সময় আরও বেড়ে যায়।
বর্ষাকালের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা অতিরিক্ত চুল ঝরে যাওয়া। আজকের যুগে চুল পড়ার একশো কারণ, যেমন, চুলে (Hair Care) কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট এখন মুড়ি-মুড়কি। এর সঙ্গে পুষ্টির অভাব, ভিটামিনের ঘাটতি, বিভিন্ন হেয়ার স্টাইলিং টুলসের ব্যবহার, অযত্ন ইত্যাদি। এর সঙ্গে বর্ষাকাল এলে বিপদ বাড়ে। আবহাওয়ার ওঠানামা, অতিরিক্ত আপেক্ষিক আর্দ্রতা অর্থাৎ হিউমিডিটি সেই আবহাওয়ায় একটা আঁঠালো চটচটে ভাব থাকে। যা চুলের গোড়াকে আরও দুর্বল করে দেয়। এই সময় পরিবেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ময়েশ্চার থাকে ফলে চুল পড়া বেড়ে যায়। যে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সারাদিনে ৫০ থেকে ১০০ চুল ঝরা স্বাভাবিক কিন্তু বর্ষাকালে সেই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় ২৫০-এ।
চুলের বিপত্তি
আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে অতিরিক্ত ঘাম হয়। তাতে চুলের ফলিকলগুলি জমাট বেঁধে যায় ও মাথার ত্বকে চুলকানিভাব ও জ্বালাভাব দেখা যায়। চুলের গোড়াও আলগা হয়ে যায়। চুল পড়ে বেশি।
বাতাসে আর্দ্রতা স্ক্যাল্পের প্রাকৃতিক তেল বের করে দেয়। ফলে, স্ক্যাল্প রুক্ষ এবং শুষ্ক হয়ে ওঠে। চুলের (Hair Care) গোড়া দুর্বল হয়ে যায় এবং সহজেই ঝরে যায়।
চুলের গোড়ার মুখগুলো বন্ধ হয়ে যায় ময়লা, তেল, ঘামে। সহজেই জট পড়ে যায়৷ নিষ্প্রাণ, জেল্লাহীন হয়ে পড়ে চুল৷ ভঙ্গুর হয়ে যায়। স্প্লিট-এন্ড অর্থাৎ ডগা চিরে দুটো মুখ হয়ে যায়। ফ্রিজি হয়ে পড়ে চুল।
বৃষ্টিতে চুল ভিজে গেলে চুলের উজ্জ্বলতা হ্রাস পায়। সময়মতো শুকনো না করা হলে আরও চুল পড়তে পারে। তারপর বেশিরভাগই হার্ড ওয়াটারে স্নান করেন। এতে চুলের ক্ষতি আরও বেশি হয়। ওই জলে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগেসিয়াম থাকে৷ যার আলাদা আস্তরণ পড়ে যায় চুলে৷ ফলে আর্দ্রতা চুলের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। তাই এই সময় হার্ড ওয়াটার বাদ দিয়ে চুল ধুতে হবে৷
ড্যাম্প ধরে যাওয়া আবহাওয়ার কারণে চুলের গোড়ায় ফাঙ্গাল ইনফেকশন হয়। এতে খুশকি বেড়ে যায় এবং খুশকির ফলে চুল ঝরা আরও বাড়তে থাকে।
এখন বৃষ্টির জল মারাত্মক দূষিত। এই দূষণের ফলে অ্যাসিডিক হয়ে পড়েছে বৃষ্টির জল। যার ফলে মাথায় জল পড়লে চুল ড্যামেজ হয় এবং ভীষণভাবেই চুল পড়ে।
বর্ষায় চুলে ব্লো ড্রাই বা কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট না করাই ভাল। হেয়ার স্টাইলিং টুল যেমন কার্লারা, স্ট্রেইটনার ব্যবহার করা, ড্রাই স্প্রে করার মতো ভুলগুলো বর্ষায় না করাই ভাল।
এ-ছাড়া একটা বড় কারণ হল পুষ্টির অভাব। ডায়েটের পরিবর্তন ঘটে বর্ষায়। ভিটামিন বি১২, বায়োটিন ও ফোলেটের মতো পুষ্টির ঘাটতির জন্যও চুল পড়তে পারে। অস্বাস্থ্যকর খাবার, হরমোনের ভারমাস্য হারিয়ে ফেললে চুল দুর্বল হয় এবং বর্ষায় হঠাৎ আবহাওয়া বদল হয়ে ওঠে সুগ্রীব দোসর। চুল উঠতে শুরু করে।
ভেজা চুল চিরুনি দিয়ে আঁচড়ানো ভুল। এতে চুলের গোড়া আরওই আলগা হয়ে যায় ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চুল পড়ার জন্য এটি অন্যতম কারণ।
চুল পড়া কমাতে
বৃষ্টিতে ভিজলে আগে বাড়ি ফিরেই স্নান করুন। এতে বৃষ্টির জলে থাকা অ্যাসিড এবং দূষিত পদার্থ ধুয়ে যাবে। এবার মাইল্ড কোনও প্যারাবেন-মুক্ত শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন।
চুল শুকিয়ে গেলে আঁচড়ানোর চেষ্টা করুন। তবে প্রথমে চুলের আগা থেকে আঁচড়ানোর চেষ্টা করুন। তাতে ক্ষতি কম হয়। সব সময় তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল শুকনো করে মুছে নেবেন৷ তাহলে চুলে জট পড়বে না। মাইক্রো। ফাইবার বা ছোট তন্তুর তোয়ালে দিয়ে চুল মুছলে তা চুলের (Hair Care) জন্য ভাল।
চুলের জন্য ম্যাসাজ খুব জরুরি। ঠিকমতো ম্যাসাজ করলে চুল এবং স্ক্যাল্প ভাল থাকে। রক্ত সঞ্চালন খুব ভাল হয়। চুলের কোষে শুষ্কতা বন্ধ হয়ে যায় ফলে অকালে চুল পেকে যায় না এবং চুল পড়া বন্ধ হয়ে যায়। চুলের স্বাস্থ্য অটুট থাকে৷
এমনিতেই চুল আঁচড়ানো বা ব্রাশ দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্ষাকালে দিনে অন্তত তিন থেকে চারবার চুল খুব ভাল করে আঁচড়ে নিন। এতে চুল অনেক বেশি মজবুত, হবে। চুল পড়বে অনেক কম।
চওড়া দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানো ভাল৷ কাঠের চিরুনি দিয়ে আঁচড়ালে চুলের সার্বিক স্বাস্থ্য ভাল থাকে৷ এছাড়া সফট ব্রাশ চুলের জন্য খুব উপকারী।
অ্যালোভেরা ও গ্রিন টি বেসড শ্যাম্পু চুলে দিন৷ এতে চুলের গোড়া মজবুত হয়৷ চুলে জট পড়ে না৷ সপ্তাহে দু’বার শ্যাম্পু করুন। এই সময় বেশি ঘাম হলে তিনবার করা যেতে পারে। তবে শ্যাম্পু করার আগে একটু তেল মেখে নিন এতে চুলের ভঙ্গুরভাব দূর হয়৷
বৃষ্টির জল থেকে চুল বাঁচিয়ে রাখুন, কারণ বৃষ্টির জলে প্রচুর অ্যাসিড ও নোংরাও থাকে। তাই একান্ত ঝামেলায় না পড়লে বৃষ্টির জল চুলে না লাগতে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। বড় ছাতা বা হুড দেওয়া রেনকোট ব্যবহার করুন। যদি কোনওভাবেই বৃষ্টির জল এড়াতে না পারেন, তা হলে বাড়ি ফিরে শ্যাম্পু করে কন্ডিশনার লাগিয়ে নেবেন।
চুলের জন্য উপকারী
নারকেল তেল
চুলের যত্নে নারকেল তেলের চেয়ে উপকারী কিছু নেই। বর্ষায় নয়, সারাবছর নারকেল তেল দিয়ে সপ্তাহে অন্তত দু’দিন ম্যাসাজ করুন এতে আপনার চুলের গোড়া শক্তিশালী হবে, চুল পড়বে কম।
নারকেল তেলের ময়েশ্চারাইজিং প্রপার্টি মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে শুষ্কতার বিরুদ্ধে লড়ে। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান বর্ষার সময় চুলের সংক্রমণের বিরুদ্ধেও লড়াই করে।
নারকেল তেলে থাকা ভিটামিন এ এবং ই ও লরিক অ্যাসিড চুলকে ভঙ্গুরতা থেকে রক্ষা করে।
পেঁয়াজের রস
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, পেঁয়াজের রসে থাকা সালফার-সহ প্রয়োজনীয় খনিজ যা চুল (Hair Care) পড়া এবং ভঙ্গুরতা প্রতিরোধ করে। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান মাথার ত্বকের জন্য পুষ্টিকর এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়ে। সপ্তাহে দু’দিন চুলের গোড়ায় পেঁয়াজের রস লাগান, এক ঘণ্টা রেখে শ্যাম্পু করে নিন।
ডিমের কুসুম
ডিমের কুসুমে সালফার থাকে, স্বাস্থ্যকর চুলের জন্য এই সালফার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ডিমের কুসুম চুলের শিকড়কে পুষ্ট করে, মাথার ত্বককে সজীব রাখে। উপরন্তু, ডিমে থাকা এক লেসিথিন নামক পদার্থ চুলকে কার্যকরীভাবে ময়শ্চারাইজ করে। সপ্তাহে একদিন এক কাপ দইয়ে একটি ডিম মিশিয়ে সেই মিশ্রণটি চুলে এবং মাথার ত্বকে লাগিয়ে আধঘণ্টা পরে ধুয়ে শ্যাম্পু করে নিন।
আরও পড়ুন- ‘মা বিপত্তারিণী, শক্তি সনাতনী’
হেয়ার সিরাম
যে কোনও ঋতুতে চুলকে দূষণমুক্ত রাখতে সিরাম খুব জরুরি। বিশেষত বর্ষায়। কারণ এই ঋতুতে আবহাওয়ার কারণে চুলের হাল বেহাল হয়। বৃষ্টির জলের সঙ্গে দূষণ কমবেশি সবার চুলেই যায়। তাই নিয়মিত হেয়ার সিরাম মাস্ট।
১ টেবিল চামচ ক্যাস্টর অয়েল, ২ টেবিল চামচ নারকেল তেল, ৫-৬ ফোঁটা ল্যাভেন্ডার অয়েল বা রোজ়মেরি অয়েল মিশিয়ে একটি সিরাম বানিয়ে নিন। এই সিরামটি মাথার ত্বক এবং চুলে খুব ভাল করে ম্যাসাজ করুন। পাঁচ মিনিট। তারপর চুল বেঁধে রেখে দিন আধঘণ্টা। শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে নিন।
৩ টেবিল চামচ অ্যালোভেরা জেল, ১ টেবিল চামচ জোজোবা অয়েল, ৬ ফোঁটা রোজ়মেরি অয়েল ভাল করে মিশিয়ে নিয়ে মাথায় ম্যাসাজ করুন। বর্ষায় চুলের জেল্লা বাড়বে আর বৃদ্ধিও হবে।
দু’চামচ পেঁয়াজের রস, ১ চামচ অলিভ অয়েল আর ১ টেবিল চামচ মধু ভাল করে মিশিয়ে চুলে লাগিয়ে নিন। আধ ঘণ্টা রেখে শ্যাম্পু করে নিন। সপ্তাহে দু’ থেকে তিনবার। এই সিরামেই বাড়বে চুলের ঔজ্জ্বল্য। চুলের গোড়া মজবুত হবে, চুল পড়ার সমস্যাও কমবে।
হেয়ার প্যাক
বর্ষায় সপ্তাহে অন্তত একদিন একটা হেয়ার প্যাক চুলে দিন। এতে আবহাওয়ার প্রভাব অনেক কম পড়বে। চুল (Hair Care) পড়া এবং চুলের বিভিন্ন সমস্যা কমবে।
টক দই, লেবু এবং সর্ষের তেল একসঙ্গে মিশিয়ে একটা প্যাক বানিয়ে নিন। চুলের জন্য তিনটেই দারুণ উপকারী। বিশেষ করে রুক্ষ চুল মসৃণ করতে, চুল পড়া রোধ করতে এই প্যাক বেশ কার্যকরী। এই প্যাক সপ্তাহে অন্তত ২ দিন লাগাতে পারেন। এতে চুল ঝরা কমবে।
ডিমের সাদা অংশ, লেবু এবং মধু— এই উপকরণগুলি চুলের জেল্লা আনে সহজেই। চুলের গোড়ায় ভাল করে এই প্যাক লাগিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিন। শুকিয়ে এলে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে ২-৩ দিন ব্যবহার করলে উপকার পাবেন।
আমলকী চুল ঝরা কমায়। একটা আমলকীর ক্কাথ সঙ্গে ২ টেবিল চামচ নারকেল তেল মিশিয়ে প্যাক তৈরি করুন। রুক্ষ এবং শুষ্ক চুলের জন্য এই প্যাক বেশ উপকারী।
ট্রিটমেন্ট চুলের জন্য
বর্ষাকালে সবচেয়ে সমস্যা হয় তাঁদের, যাঁরা চুলে কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট করান বা ইতিমধ্যেই করিয়েছেন। তাঁদের দরকার বিশেষ যত্ন।
কার্লি হেয়ার
মেথি ভিজিয়ে ছেঁকে নিন, এবার পাকাকলা, বাদাম তেল মিশিয়ে চুলে প্যাক লাগান। পনেরো মিনিট পরে চিরুনি দিয়ে আঁচড়ান। এর ৩০ মিনিট পর শ্যাম্পু করে নিন।
আমলকীর রস, চায়ের লিকারের সঙ্গে মিশিয়ে দিলে চুলের গোড়াতে দিলেও চুল ভাল থাকবে এবং গোড়া শক্ত হবে, চুল পড়বে না।
কালারড হেয়ার
রঙিন চুলে কেমিক্যাল থাকে। তেলের সঙ্গে ভিটামিন ই ক্যাপসুল মিশিয়ে চুলের গোড়ায় ম্যাসাজ করুন সপ্তাহে তিনদিন। ৩০ মিনিট পর শ্যাম্পু করুন। ডিপ কন্ডিশন রঙিন চুলে জরুরি তাই একটা অন্তত স্পা করতে হবে এই ঋতুতে। সপ্তাহে একবার নিউট্রিলাইজার ক্রিমও ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্ষাকালে হিট দেবেন না কালার করা চুলে।
স্ট্রেট হেয়ার
স্ট্রেট হেয়ার চুলের জন্য প্রোটিন প্যাক ব্যবহার করতে পারেন। হেনার সঙ্গে ডিম দিয়ে বা দুটো ডিমের কুসুম দিয়ে, একটু মধু দিয়ে মিশিয়ে স্নানের আগে সারা চুলে দিয়ে রাখুন। আধঘণ্টা পরে ওই চুল চিরুনি দিয়ে আঁচড়ান। আরো ৩০ মিনিট পর শ্যাম্পু করে নিন। এতে চুল সোজাই থাকবে ও ঝরঝরেও হবে চুল পড়বে না।