‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথ যামিনী রে’ রবীন্দ্রনাথের এই গানটা শুনলেই যেন প্রেমিকমনে উচাটন শুরু হয়ে যায়। মনে যেন প্রেম-প্রেম ভাব জেগে ওঠে। কিন্তু বর্ষাকাল কি শুধুই প্রেমিকদের ঋতু! একদমই নয়। বর্ষা হচ্ছে কবিতার ঋতু, প্রেমের ঋতু, রিমঝিম বৃষ্টির মিষ্টি ছোঁয়ায় প্রাণ ফিরে পাওয়া প্রকৃতির ঋতু। আসলে বর্ষা মানেই আকাশে জলভরা কালো মেঘের ঘনঘটা আর চারিদিকে রিমঝিম বৃষ্টির ফোঁটা। কখনও-বা চারিদিক সাদা হয়ে ঝেঁপে বৃষ্টি আসা। প্রকৃতির কোলে গাছেরা এই সময়ে সিক্ত হয়ে তাদের ফুলের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে দেয় চারিপাশে। আসলে মুখ গোমড়া কাজল কালো আকাশ আর হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে নাগরিক জীবনে মুগ্ধতা ছড়িয়ে বেড়ায় সুগন্ধে মাতোয়ারা করা বর্ষার ফুল (Flowers)। তবে বর্ষাঋতুর আগমনি গান শাখায় শাখায় কদম ফুলের উচ্ছ্বাসেই বেজে ওঠে। প্রেমিকার হাতের মুঠোয় ধরা বৃষ্টি ভেজা কদম জানান দেয় বর্ষা আসছে। আর তাই বোধহয় বর্ষাকেই প্রকৃতির রানি রূপে আখ্যা দেওয়া হয়।
বর্ষাকালের একঘেয়েমি কাটাতেই যেন ফুলেরা তাদের রঙিন ক্যানভাস প্রকৃতির কোলে ছড়িয়ে দেয়। বর্ষা ঋতুর পুরোটা জুড়েই থাকে নানা রকম ফুলের আগমন। একেকটা ফুল একেক রকমের হয়, আর তাদের রঙের ভিন্নতা যেন প্রকৃতির বুকে রামধনুর মতন হয়ে ছড়িয়ে থাকে। তবে বর্ষাকালে যত ফুল ফোটে তার মধ্যে সাদা ফুলের সংখ্যা বেশি হয়। বর্ষাকালে সাদা ফুলগুলোর বেশিরভাগই আবার রাতে ফোটে। আর এরপর সুগন্ধ বিলিয়ে তাদের আগমনবার্তা চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়।
বর্ষা মানেই কদম ফুল। আর এরপরে আস্তে আস্তে দেখা মেলে মালতীলতা, জুঁই, কেয়া, রজনীগন্ধা, বেলি, জুঁই, কামিনী, দোপাটি, বিভিন্ন ধরনের জবা, রেন লিলি, গাঁদা ইত্যাদি ফুলের।
কদম ফুল
বর্ষার সঙ্গে কদম ফুলের নিবিড় সম্পর্ক। আর তাই তো কবি লিখেছেন ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’। বর্ষার আগমনি বার্তা নিয়ে আসা এই কদম আমাদের তথা বাঙালিদের খুব প্রিয় একটা ফুল। ঐতিহ্য আর সাহিত্যে কদম গাছ ও ফুল কয়েক হাজার বছরের পুরনো। হিন্দু পুরাণে কদম গাছ ভগবান কৃষ্ণের সাথে সম্পর্কিত। আর এই কদম ফুল শ্রীকৃষ্ণের খুব প্রিয়। এবং কদম ফুল রাধার প্রতি তাঁর ভালবাসার প্রতীক হিসাবে বিশ্বাস করা হয়। কদম ফুলের সুবাস আর সৌন্দর্য ভারতবর্ষে বহু শতাব্দী ধরে কবি-শিল্পী এবং সংগীতজ্ঞকে অনুপ্রাণিত করেছে। কদম ফুল হচ্ছে প্রেম, সৌন্দর্য এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতীক।
তবে কদম ফুল শুধুমাত্র সুগন্ধই ছড়ায় না, কদম ফুল জলে সেদ্ধ করে সেই জল দিয়ে কুলকুচি করলে মুখের দুর্গন্ধও দূর হয়। সাদা হলুদ গোলাকার বলের মতন দেখতে এই ফুলটি rubiaceae পরিবারভুক্ত। ফুলটির বৈজ্ঞানিক নাম anthocephalus indicus। ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ মায়ানমার, চিন ও নেপালে কদম ফুল দেখতে পাওয়া যায়। বর্ষার দূত তথা বর্ষা ঋতুর প্রতীক এই কদম ফুল বর্ষা আসার আগেই প্রস্তুত হয়ে থাকে বাদল দিনের আগমনের বার্তা নিয়ে।
আরও পড়ুন- বর্ষায় চুলের দেখভাল
পর্তুলিকা
পর্তুলিকা খুব সুন্দর একটি ফুল। ফুলটিকে দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। এই ফুলটি চিকন চিকন পাতায় ঘেরা। পাতার মাঝখানে ছোট্ট ফুলটি ফুটে থাকে। এই পর্তুলিকা ফুলটি লাল, কমলা, সাদা, বেগুনি, গোলাপি, হলুদ ইত্যাদি রঙের হয়ে থাকে। দেখে মনে হয় রামধনু।
পর্তুলিকা বর্ষাকালের একটি ফুল। এই ফুলটি (Flowers) মস রোজ বা সান রোজ নামেও পরিচিত। বর্ষাকালেই এই ফুল গাছটি বৃদ্ধি পায়। প্রতিদিন একই টাইমে এই ফুলটি ফোটে বলে একে অনেকের টাইমফুল নামেও ডাকে। পর্তুলিকার আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকা। এই ফুলটি পর্তুলিকা গ্রান্ডিফ্লোরা (portulaca grandiflora) প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। রংবাহারি হিসেবে এই ফুলটির জনপ্রিয়তা থাকলেও, এর কোনও গন্ধ নেই। চোখ জুড়ানো এই ফুলটি নানান রঙের হয়ে থাকে। পর্তুলিকা লতা জাতীয় উদ্ভিদ। বর্ষাকালেই এই গাছটি দ্রুত বেড়ে ওঠে। পর্তুলিকার উজ্জ্বল প্রাণবন্ত রং আমাদের মোহিত করে।
পদ্মফুল
বর্ষাকাল মানেই বৃষ্টি আর বৃষ্টি মানেই জল। আর জল মানে জলজ ফুলের (Flowers) মেলা। বর্ষা আসতে আসতেই খাল বিল পুকুর এবং অন্যান্য জলাশয়ে পদ্ম ফুটতে শুরু করে। বিভিন্ন জলাশয়ের শোভা বর্ধন করতে গোলাপি, নীল, সাদা রঙের পদ্মের জুড়ি মেলা ভার। পদ্মকে আমরা ব্রহ্ম কমল বা ব্রহ্মার পদ্মও বলে থাকি। পবিত্রতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে দেখা হয় পদ্মকে। হিন্দুশাস্ত্র মতে পদ্মফুল ভগবান শিবের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান ধারণ করেন। পদ্মফুলে মিষ্টি একটি গন্ধ থাকে। আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সঙ্গে পদ্মফুলের অনেক ভেষজ গুণও আছে। Nelumbonaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত পদ্মফুলের বৈজ্ঞানিক নাম nelumbo nucifera। পদ্মফুল আকারে বড় এবং অসংখ্য নরম কোমল পাপড়ি সমন্বয়ের সৃষ্টি। শুধু জলাশয় নয়, আজকাল বাগানেও পদ্ম তার শোভা বর্ধন করতে সক্ষম।
কাঠচাঁপা বা প্লুমেরিয়া
গোলাপ যেমন মানুষের কাছে ভালবাসার প্রতীক ঠিক তেমনি কাঠচাঁপা বা প্লুমেরিয়াও ভালবাসার প্রতীক হিসেবে সমাদৃত। কৃষ্ণের অষ্টতর শত নামের মতন এই কাঠচাঁপা বা প্লুমেরিয়াও বহু নামে পরিচিত। আমাদের কাছে যেটি কাঠগোলাপ, সেটি আবার আমেরিকাতে প্লুমেরিয়া আবার ভেনিজুয়েলাতে এমাপুলা, দক্ষিণ চিনে এগফ্লাওয়ার ইত্যাদি। কাঠচাঁপা বা প্লুমেরিয়া apocynaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এটি প্লুমেরিয়া বর্গ এবং রুবরা প্রজাতির সদস্য। কাণ্ডের ডগায় গুচ্ছ-গুচ্ছ ফুলগুলোকে (Flowers) দেখলে সময় মনে হয়। সারাদিন ধরে এই ফুলগুলো সুগন্ধ ছড়ালেও রাতের বেলায় সেই গন্ধে তীব্রতা বাড়ে।
কাঠচাঁপা বা প্লুমেরিয়া সুগন্ধ এবং সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত। বর্ষাকাল এলেই প্রচুর পরিমাণে এই ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। আমাদের অতি-পরিচিত এই কাঠচাঁপা লাল, সাদা, হলুদ ও গোলাপি রংয়ের হয়। এর মিষ্টি গন্ধ আমাদের বাগানকে পূর্ণ করে। এই মায়াময়ী ফুলটিকে (Flowers) বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মৃত্যুহীন প্রাণের প্রতীক হিসেবে দেখেন।
জুঁই ফুল
কবি বলেছেন ‘শ্রাবণবেলা বাদল ঝরা, যুথি বনের গন্ধে ভরা’। আসলে বর্ষাকালের এই শ্বেতশুভ্র জুঁইফুল গন্ধে এবং সৌন্দর্যে অতুলনীয়। এই জুঁইফুলের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আপন খেয়ালে। আমাদের বাঙালিদের তাই প্রতি ঘরেই বাগান, ছাদবাগান, অথবা এক চিলতে ব্যালকনিতে জুঁইফুলের গাছ দেখতে পাওয়া যায়। মনে করা হয় যে জুঁইফুল ঘরের ইতিবাচক শক্তি বজায় রাখে। এই ফুলটি প্রধানত দক্ষিণ ভারতের মাদুরাইয়ে চাষ করা হয়। আজ সেই কারণেই জুঁই ফুলের অপর নাম মাদুরাই মল্লি। জুঁইফুলের আরও একটি নাম জেসমিন। এরাবিয়ান জেসমিন এবং নাইট ব্লুমিং জেসমিনের মতো জুঁই ফুলের জাতগুলো জনপ্রিয়। জুঁই ফুল হচ্ছে ফুলের রানি। ভারতীয় সংস্কৃতিতে জুঁই ফুলের কদর অপরিসীম। এই জুঁই ফুলটি আসলে প্রেম-রোমান্সের সাথে জড়িত। মহাভারত এবং কামসূত্রের মতো প্রাচীন গ্রন্থেও জুঁই ফুলের (Flowers) উল্লেখ আছে। একটি পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে অযোধ্যার রাজা পার্থন একটি জুঁইভরা বনে ভগবান শিবের উপাসনা করেছিলেন। কিংবদন্তি, সম্রাট পারি তাঁর শিকার অভিযানের সময় জুঁইফুলটি আবিষ্কার করেছিলেন বলে দাবি করা হয়।
জবাফুল
জবাগাছগুলো সাধারণত বর্ষাকালেই বড় হয়। কারণ জবাফুলের গাছগুলো আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত পছন্দ করে। বাঙালি বাড়িতে জবা গাছ থাকা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। জবা ফুল যেমন মা কালীর প্রিয় তেমনি মা লক্ষ্মীরও প্রিয়। মনে করা হয় যে বাড়িতে জবাফুলের গাছ থাকে সে-বাড়ির সমস্ত সঙ্কটমোচন হয়। বর্ষাকালে বেড়ে ওঠা এই ফুলটি শুধুমাত্র দৃষ্টিনন্দনই নয়, জবাফুলের অনেক গুণও আছে। জবাফুল থেকে তৈরি চা কোলেস্টেরল কমায়, ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখে, লিভারের কর্মক্ষমতা বাড়ায়, মানসিক অবসাদ কমায়, ওজন কমায়, পিরিয়ডের সমস্যা মেটাতে সাহায্য করে। বিভিন্ন রঙের জবাফুল বাড়ির বাগানের সাথে সাথে ব্যালকনির টবে শোভা বর্ধন করতে অপরিহার্য।
রেইন লিলি
বর্ষার ফুলের মধ্যে রেইন লিলি অন্যতম। এই ফুলের সৌন্দর্য অনেক ফুলকেই হার মানায়। বর্ষার মৌসুমে এই রেইন লিলি প্রকৃতির বুকে হাজির হয় তাদের রঙের ডালি নিয়ে। বর্ষার মরশুমে ফোটে বলেই এই নাম। সাদা-লাল-গোলাপি-পিচ-হলুদ ইত্যাদি বহু কালারের রেইন লিলি দেখতে পাওয়া যায়। বর্ষার সময় বাড়ির ব্যালকনির টবে অথবা বাগানের সৌন্দর্য বাড়াতে রেইন লিলির জুড়ি মেলা ভার।
মর্নিং গ্লোরি
মর্নিং গ্লোরি অর্থাৎ ভোরের রানি। যে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ে তাকে আদর করে ডাকা হয় ভোরের রানি। এই মর্নিং গ্লোরির আরও অনেক নাম আছে। তার মধ্যে অন্যতম প্রভাতজ্যোতি বা প্রভাতরানি। আমাদের দেশে বর্ষাকালের একটি অন্যতম ফুল এই মর্নিং গ্লোরি। এই ফুল মূলত মেক্সিকো ও সেন্ট্রাল আমেরিকার অধিবাসী। মর্নিং গ্লোরি নীল, উজ্জ্বল লাল, সাদা, বেগুনি, গোলাপি-সহ নানা রঙের দেখতে পাওয়া যায়। বর্ষাকালের সকালবেলায় লতানো এই গাছটির অসাধারণ সৌন্দর্যে ভরা ফুলগুলো মন ভাল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। মর্নিং গ্লো-এর রূপ যেমন রানির মতো তেমনি আভিজাত্যও রানির মতন। আর তাই তো সে প্রভাতরানি।
বর্ষাকালে আরও অনেক ফুল ফোটে : ভরাবর্ষায় স্বর্ণচাঁপা অথবা দোলনচাঁপা বাতাসে তাদের সুগন্ধ ছড়িয়ে দেয়। ঘনঘোর বর্ষার ভেজা বাতাসে ভেসে বেড়ায় বেলি ও বকুলের সৌরভ। বর্ষাকালের আরও একটি ফুল হচ্ছে ফুড়ুস। ইংরেজিতে যার নাম ক্র্যাব ফ্লাওয়ার। কোনও গন্ধ না থাকলেও ফুলটির অসাধারণ সৌন্দর্য সবাইকে মাতোয়ারা করে তোলে। সাধারণত সাদা, গোলাপি, বেগুনি রঙের ফুড়ুস ফুল দেখা যায়। বর্ষাকালের আরও একটি ফুল হচ্ছে দুপুর মণি। দুপুরবেলায় ফোটে বলেই এই নাম। গন্ধহীন এই ফুলটির অতুলনীয় রূপ সবাইকে মুগ্ধ করে। বর্ষায় আরও একটি ফুল (Flowers) হচ্ছে দোপাটি। লাল-বেগুনি আকাশ-নীল সাদা-গোলাপি-সহ বহু কালারের দোপাটি দেখতে পাওয়া যায়। তবে এই বর্ষা ঋতুর বৃষ্টিতে দোলনচাঁপার আগমন অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। দোলনচাঁপাকে দেখলে মনে হয় বৃষ্টির জলে গা ধুয়ে সবুজ পাতার শাড়ি পরে এসে উপস্থিত হয়েছে। সুগন্ধী। সাদা রঙের ফুল দোলনচাঁপা। দোলনচাঁপার বড় বড় পাপড়িগুলো অনেকটা প্রজাপতির মতো দেখতে হয়। আর সেই কারণে এই দোলনচাঁপার আরও একটি নাম বাটারফ্লাই লিলি।