জন্মমুহূর্তে শাঁখ বাজেনি। ঠাকুমা করেছিলেন হাহাকার, এতগুলো মেয়ের পরে আবার মেয়ে! জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই হয়েছেন বৈষম্যের শিকার। তবে তিনি, আশাপূর্ণা, দমে যাননি, থেমে থাকেননি। কম বয়সে ছিলেন তুমুল দস্যি। খেলতেন বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে। ক্যারমের হাত ছিল দারুণ। ওড়াতেন ঘুড়ি। সেইসঙ্গে খেলতেন পুতুল নিয়েও। পড়াশোনার প্রতি ছিল গভীর আগ্রহ। কিন্তু ঠাকুমার কঠোর নিষেধে স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করে উঠতে পারেননি। ফলে মনে ছিল চাপা কষ্ট। মুখফুটে কিছু বলতে পারতেন না। কারণ পুরুষশাসিত সমাজ। রক্ষণশীল পরিবার। মেয়েদের বেশি কথা বলতে নেই। তারা যে ‘অবলা’!
সেইসময় মুখে প্রকাশ না করলেও, মনের মধ্যে অনর্গল কথার জন্ম হয়েছে। মা বুঝতেন তাঁকে। মায়ের ইচ্ছায় ঘরেই পড়াশোনা শুরু। তখন তিনি সাড়ে পাঁচ বছরের। বিভিন্ন সাহিত্য পরিষদ এবং লাইব্রেরির সদস্যা ছিলেন মা। বাড়িতে ছিল নানা ধরনের বইয়ের পাহাড়। বাবাও ছিলেন শিল্প-সাহিত্যে অনুরাগী। মেয়ের মনের মধ্যে জ্ঞানের আলো জ্বালার চেষ্টা করতেন। বাড়িতে আসত ‘সাধনা’, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘সবুজপত্র’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘বসুমতী’, ‘বালক’, ‘শিশুসাথী’, ‘সন্দেশ’ প্রভৃতি পত্রিকা। পাশাপাশি ছিল দৈনিক পত্রিকাও। কম বয়সেই আশাপূর্ণা হয়ে ওঠেন বইয়ের পোকা। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলো গোগ্রাসে গিলতেন। এসবই আশাপূর্ণাকে পরিপূর্ণ সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে গড়ে তুলেছিল।
আরও পড়ুন-ভয়াবহ বন্যায় ভাসছে অসম ফুঁসছে ব্রহ্মপুত্র, মৃত ৯০
ছোট থেকেই ছিলেন অনুভূতিপ্রবণ। মানুষের, বিশেষত নারীদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। একাত্ম হয়ে যেতেন তাঁদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে। একটা সময় নিজেকে প্রকাশ করার কথা ভাবেন। হাতে তুলে নেন কলম। গল্প-উপন্যাসের জন্যেই মূলত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তবে আশাপূর্ণা দেবীর লেখালেখিতে হাতেখড়ি কবিতার মাধ্যমে। ১৯২২ সালে ‘বাইরের ডাক’ নামে একটি কবিতা ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তখনই গল্প লেখায় হাত পাকানো শুরু। সেই বছরই তাঁর ‘পাশাপাশি’ নামের গল্প একটি পত্রিকায় ছেপে বেরোয়। তবে সেসবই ছিল সূচনা পর্বের রচনা।
মাঝে কিছুদিন বিরতি নেন। নিজের জ্ঞানভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ করার পর আবার শুরু করেন লেখালিখি। প্রকাশিত হয় ‘পত্নী ও প্রেয়সী’ গল্পটি। এরপর বাকি জীবনে সমান তালে লিখে গেছেন। ছোটদের এবং বড়দের জন্য। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় বড়দের জন্য ছোটগল্পের সংকলন ‘জল আর আগুন’, তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘প্রেমও প্রয়োজন।’
আরও পড়ুন-বৃক্ষনিধন: দিল্লির এলজির তীব্র নিন্দা সুপ্রিম কোর্টের
ঘোরতর সংসারী ছিলেন। স্বামী, তিন সন্তান। পালন করেছেন সমস্ত রকমের দায়দায়িত্ব। তার পাশাপাশি সময় বের করে মনপ্রাণ ঢেলে লিখে গেছেন। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’ এবং ‘বকুলকথা’— তাঁর এই তিনটি উপন্যাস আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনার মর্যাদা পেয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি নারীদের মনের অন্দরমহলে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছিলেন। কারণ, তিনি লিখতেন নারীদের মনের কথা, নারীদের মনের মতো করে। সমাজ যাঁদের ‘অবলা’ মনে করে, তিনি তাঁদের করে তুলেছিলেন কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র। দিয়েছিলেন সম্মান। দেখেছিলেন নারীমুক্তির স্বপ্ন।
নারীবাদী সাহিত্যিক ছিলেন। তবে ঢক্কানিনাদ করে নারীবাদের প্রচার করেননি। তাঁর নারীবাদ সঞ্চারিত হয়েছে নীরবে। ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের প্রতিটি রোমকূপে। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র। তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্রদের মধ্যে নারীরা খুঁজে পেতেন নিজেদের। আজও পান। তাই তো বর্তমান সময়েও তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস এত জনপ্রিয়। তাঁর উপন্যাস এবং গল্প অবলম্বনে তৈরি হয়েছে ২৪টি সিনেমা। ১৯৬৬ সালে পেয়েছেন রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার। এছাড়াও পেয়েছেন পদ্মশ্রী (১৯৭৬), জ্ঞানপীঠ (১৯৭৭), মতিলাল ঘোষ পুরস্কার (১৯৫১), কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ‘লীলাবতী পুরস্কার (১৯৫৪) ও ‘ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক’ (১৯৬৩)। ১৯৮৮ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘হরনাথ ঘোষ পদক’, ১৯৮৯ সালে শরৎ সমিতি থেকে ‘শরৎ পুরস্কার’, বিশ্বভারতী থেকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ও লাভ করেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করে।
আশাপূর্ণা দেবীর জীবনের সবথেকে বড় প্রাপ্তি রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ। অল্প বয়সেই তিনি রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন এবং একটি উত্তরের আবদারও করেছিলেন। কবিগুরু উত্তরে লিখেছিলেন, ‘আশাপূর্ণা, তুমি সম্পূর্ণা।’