সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমানে একটি অত্যাধুনিক নাম। বলতে গেলে এই অত্যাধুনিকতার স্রোতে সমস্ত পৃথিবীতে এমন কোনও মানুষ নেই যে গা ভাসায়নি। বর্তমানে এমন কোনও মানুষ চোখেই পড়ে না যে এই স্রোতের উল্টো অভিমুখে সাঁতার কাটছে। মানুষ তার ব্যক্তিগত মুহূর্ত কর্মের মুহূর্ত সমস্ত কিছু ছবি-সহ শেয়ার করছে এই সোশ্যাল মিডিয়ায়। মুহূর্তে বেড়ে উঠছে তার লাইক ফলোয়ার্স ফ্রেন্ডস। এদেরকে বলে ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডস। এই সোশ্যাল মিডিয়ার একটা অনন্য অবদান হল ফেসবুক। ২০০৪ সালে মার্ক জুকারবার্গ ফেসবুক আবিষ্কার করে যাতে মানুষ বিভিন্ন মানুষের সাথে ভার্চুয়ালি কথা আদান-প্রদান করতে পারে। ভার্চুয়াল জগতেও যাতে অনেক মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হতে পারে। আবিষ্কারের কিছুদিন পরেই এই সামাজিক মাধ্যমটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মানুষ তার অবসর সময় অতিবাহিত করার মূল মাধ্যম হিসেবে এটিকে ব্যবহার করেছে দিনের পর দিন। কথায় আছে কোন জিনিস অতিরিক্ত মনোগ্রাহী হয়ে গেলে সেটি হয়ে ওঠে আসক্তির কারণ। এই সমাজ মাধ্যম ফেসবুকটিও ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে মানুষের চরম আসক্তির কারণ। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রবণতা প্রায় জলপ্রপাতের মতো উপচে পড়েছে। প্রায় মানুষের জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই সোশ্যাল মিডিয়া গ্রাস করেছে। বেশিরভাগ মানুষই এখন তার অত্যন্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোকেও সমাজমাধ্যমে শেয়ার করে ফেলছে। এর ফলে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা। মানুষ এখন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাই তোলার ছবি থেকে শুরু করে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটা তুলে রাখা ছবি ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করে দিচ্ছে। মানুষের গোপনীয়তা বা নিজস্বতা যেন একেবারে হারিয়ে যাচ্ছে এর ফলে। ধীরে ধীরে ফেসবুক হয়ে উঠছে একটা লোক দেখানো দেখনদারির মাধ্যম। সবাই এখন এই আধুনিক যুগে আধুনিকতায় নিজেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সুন্দরভাবে উপস্থাপিত করতে মত্ত হয়ে উঠেছে। যেকোনও ভাল মুহূর্ত বা খারাপ মুহূর্ত তারা কাটাক না কেন সেই মুহূর্তগুলোর সাক্ষী সোশ্যাল মিডিয়া হবেই।
আরও পড়ুন-চাঁদের গভীরে মিলল গুহার খোঁজ
এই অত্যাধুনিকতা অনেক সময় মানুষের ক্ষতিও ডেকে আনে যেমন প্রতিনিয়ত প্রতিটা মুহূর্ত ফেসবুকে ডুবে থাকায় মানুষ এখন হয়ে উঠছে চরম অসামাজিক। নতুন জেনারেশনের কাছে এখন ভার্চুয়াল দুনিয়া হল আসল দুনিয়া। সেই দুনিয়ায় কেবলমাত্র রয়েছে মেসেজের মাধ্যমে কথোপকথন ছবি পোস্ট করে নিজেকে জাহির করা। কোনও ঘটনা ঘটলে সেই ঘটনার আপডেট যেভাবে হোক না কেন নিজের মনের মতো উগরে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক খবর ভাসছে। মানুষ কোনও বিচার বিবেচনার ধার-না-ধরেই সেগুলোকেই আসল জ্ঞান বলে ধরে নিচ্ছে। বহু মানুষ এখন বলতে গেলে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ নামক ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। এই সোশ্যাল মিডিয়ার হাতছানি ও নাটকীয় মঞ্চে সব সময় দূরে থেকে যাচ্ছে পুরনো দিনের নস্টালজিয়াগুলো যেগুলোর মধ্যে রয়েছে বন্ধুদের সাথে গল্প করা, সিনেমা দেখতে যাওয়া, মুখরোচক খাবার খেতে খেতে বাড়ির ছাদে বা খেলার মাঠে বসে আড্ডা দেওয়া, ভাই-বোন সবাই মিলে একসঙ্গে হয়ে কোনও বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে সিনেমা বা টিভি দেখা ইত্যাদি মুহূর্তগুলো। সামাজিক মাধ্যম মানুষকে সামাজিক করে তুললেও তার প্রবণতা আজ এত বেশি যে মানুষ প্রকৃত সমাজের থেকে আজ ক্রমশ চলে যাচ্ছে বহুদূরে। এই সোশ্যাল মিডিয়া এখন বলতে গেলে সাইবার ক্রাইমের আঁতুড়ঘর। আজকাল বিভিন্ন মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো ছবি দিয়ে ফেক প্রোফাইল বানিয়ে করে চলেছে বিভিন্ন ক্রাইম। কী নেই সেখানে, ওমেনাইজিং থেকে শুরু করে, ব্ল্যাকমেইলিং, ডার্টি চ্যাটিং, আরও কত কী। বিভিন্ন সময়ে অনেকের প্রোফাইল হ্যাক করে ঘটানো বিভিন্ন ধরনের অপরাধজনিত দূষিত সামাজিক চিত্র আমাদের চোখের সামনে হরদম ফুটে ওঠে। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার শুধুমাত্র মনোরঞ্জন বা অবসর সময় যাপনের নয়, বরং প্রতিটা মুহূর্তেই চলেছে। কলেজে ক্লাসের লেকচারের ফাঁকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে চলছে চ্যাটিং। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়েও মানুষ সামাজিকভাবে আত্মীয়-স্বজনের সাথে মেলবদ্ধ হওয়ার বদলে ফেসবুক-ট্যুইটার- হোয়াটসঅ্যাপে ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব করাতে ডুবে আছে। প্রায়শই দেখা যায় মানুষ ফেসবুকে বিভিন্ন জিনিস উপস্থাপিত করে কেউ কোনও নাচের ভিডিও পোস্ট করছে, কেউ কোনও গানের ভিডিও পোস্ট করছে কেউ আবার দু কলম কবিতা লিখে ফেলছে— আসলে এগুলো ছুতো। এগুলোর মাধ্যমে তারা জাহির করতে চাইছে নিজেকে। সমাজমাধ্যমে উপস্থাপিত করতে চাইছে নিজেকে বলতে চাইছে এগুলি ছুতো, আমাকে দেখো। সোশ্যাল মাধ্যম এদিক থেকে বলতে গেলে মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা নিয়ে এসেছে। মানুষ কেবল নিজেকেই সুন্দরভাবে উপস্থাপিত করতে ব্যস্ত। আজকাল মানুষজন তো কোনও ভিখিরি বা দরিদ্রকে দান বা কোনওরকম সাহায্য প্রদান করলেও সেটার ছবি বা ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করে দেখাচ্ছে যে দেখো আমি দান করছি। সোশ্যাল মিডিয়ার নিজেকে যেনতেনপ্রকারেণ পরিবেশন করার জন্য মানুষ সার্বজনীন উপমাটি ভুলে যাচ্ছে। যে উপমায় লেখা আছে মানুষকে সাহায্য করো, দান করো নিভৃতে। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার আরেকটি কুরুচিকর দিক হল সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজ ফিডে ঘুরে বেড়ানো বিভিন্ন কুরুচিকর, অশ্লীল ছবি বা ভিডিও যাকে বলে পর্নোগ্রাফি। এটি নষ্ট করে দিচ্ছে মানুষের মনোভাবকে। এই নোংরা প্রবণতার বশবর্তী হয়ে মানুষ ধর্ষণ শ্লীলতাহানি ইভটিজিং-এর মত জঘন্য কাজ করে ফেলছে। ২০২৩ সাল অনুসারে ভারতের মানুষ প্রতি লক্ষ জনসংখ্যা অনুসারে ১২৯টা সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছে। ২০২৪ সাল অনুযায়ী সমগ্র ধরণীতে ৪২২ মিলিয়ন মানুষ হয়েছে সাইবার ক্রাইমের শিকার। ধীরে ধীরে সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠছে লোকদেখানো সমাজ মাধ্যমের মূল অস্ত্র। এই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ট্যুইটার প্রভৃতিকে কেবল মনোরঞ্জন ও যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার ও সৎ পথে চালনা করাটাই আধুনিক নবসমাজের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। নচেৎ সুদূর ভবিষ্যতে এক চরম কলুষিত সমাজ-ব্যবস্থার আগমন অবশম্ভাবী। যে সমাজ-ব্যবস্থার কানায় কানায় থাকবে সাংস্কৃতিক দূষণ।