পৃথিবীটা বহুদিন আগেই ছোট হয়ে গেছে। বলা যায়, একেবারে হাতের মুঠোয়। এখন সময় সুযোগ পেলে অনেকেই সপরিবারে বেরিয়ে পড়েন। বিদেশে ঘুরতে যান। ইউরোপ, আমেরিকা অথবা এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। অথচ আমাদের দেশেই এমন অনেক জায়গা আছে, যেগুলোর কথা বহু মানুষেরই অজানা থেকে গেছে। আজও। তেমনই একটি জায়গা হল ধনুশকোডি (Dhanushkodi)। সম্পূর্ণ নির্জন, নিরিবিলি এক স্থান। ভারতের তামিলনাড়ুর পূর্ব উপকূলে রামেশ্বরম দ্বীপের তীরে অবস্থিত। এই জায়গাটিকে ভারতের শেষ প্রান্ত বলা হয়। অসাধারণ সমুদ্র সৈকত। বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের মিলনস্থল। তীরে নানা ছন্দে ছোট বড় বিভিন্ন রকমের ঢেউ আছড়ে পড়ে। সারাদিন চলে এই খেলা। কিন্তু দেখার লোকজন খুব বেশি নেই। কারণ, বর্তমানে জায়গাটি প্রায় জনশূন্য। যদিও আগে ছিল জনকোলাহল মুখর। বহু মানুষের বাস। গমগম করত সারাদিন। স্বাভাবিক ছিল জনজীবন। চোখের সামনে ধরা পড়ত সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নার ছবি। ছিল রেলস্টেশন, হাসপাতাল, গির্জা, হোটেল, পোস্ট অফিস। একটি শহরে যা যা থাকে, প্রায় সমস্তই। তবে সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে। আছড়ে পড়ে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। তার ফলে শহরটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১,৮০০ জন নিহত হন এবং ১০০ যাত্রী বহনকারী ট্রেন ডুবে যায়। জায়গাটি পরিণত হয় প্রায় ধ্বংসস্তূপে। পরিস্থিতি দেখে সেই সময় শহরটিকে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে এই ছোট্ট দ্বীপে রয়েছেন প্রায় ৫০০ মৎস্যজীবী। তাঁরা ধনুশকোডিতে (Dhanushkodi) তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করেন। থাকেন শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি কুঁড়েঘরে। ধনুশকোডি (Dhanushkodi) তার করুণ ইতিহাসের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে ‘ভূতের শহর’ হিসেবেও পরিচিত। যদিও ভূতের উপদ্রব আছে বলে কেউ শোনেননি। দিনের বেলায় এখানে পর্যটকরা বেড়াতে আসেন। সন্ধে নামার আগেই ফিরে যান। ধনুশকোডি ভারত ও শ্রীলঙ্কা, দুই দেশের মধ্যে একমাত্র পার্থিব সীমানা। এই সীমানা আসলে বালির স্তূপ। এর দৈর্ঘ্য মাত্র ৫০ গজ। এই কারণে জায়গাটিকে বিশ্বের সবচেয়ে ছোট স্থান মনে করা হয়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, ধনুশকোডি সেই জায়গা, যেখানে শ্রীরামচন্দ্র এবং তাঁর সেনাবাহিনী রাবণের লঙ্কা শহরে প্রবেশের জন্য সেতু নির্মাণ করেছিলেন। নাসা প্রকাশিত ছবিতে এই ভূমির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা গেছে। তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, এটা প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট নয়। রামায়ণ মহাকাব্য অনুসারে, লঙ্কা থেকে স্ত্রী সীতাকে নিয়ে ফেরার সময় শ্রীরামচন্দ্র তাঁর ধনুকের ডগা দিয়ে সেতুটি ধ্বংস করেছিলেন। সেই কারণেই শহরের নাম হয় ‘ধনুশকোডি’, যার অর্থ ‘ধনুকের শেষ’। পুরো শহরটি বালি দিয়ে মোড়া। বিভিন্ন জায়গায় অবশিষ্ট কাঠামো দেখা যায়। ধনুশকোডি সমুদ্র সৈকতে প্রায়শই তুমুল জোয়ার দেখা যায়। পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং একক ভ্রমণকারীদের জন্য একটি আদর্শ ছুটি কাটানোর জায়গা। এই অঞ্চলে বিভিন্ন পরিযায়ী পাখি, যেমন গল, ফ্ল্যামিঙ্গো ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। উড়ে বেড়ায় সৈকতে, গাছে গাছে। পরিবেশ হয়ে ওঠে আনন্দমুখর। পাখি দেখার টানে ছুটে আসেন দূর দূরান্তের পক্ষীপ্রেমীরা। ধনুশকোডিতে আছে বেশকিছু দর্শনীয় স্থান। বহু মানুষ ঘুরে দেখেন। পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে এখানকার নির্জন সমুদ্র সৈকত। এই সৈকতে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় ভারত মহাসাগরের অত্যাশ্চর্য দৃশ্য। দেখা যায় অ্যাডামস ব্রিজ। ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে সংযোগকারী শুল্ক এবং প্রাচীরের একটি শৃঙ্খল। যা রাম সেতু নামেও পরিচিত। আছে কয়েকটি মন্দির। সেইগুলোও ঘুরে আসা যায়। যেতে পারেন আরিচালমুনাই। এটা একটা বাতিঘর। সমুদ্রের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য একটি মনোরম স্থান। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। অনেকেই ঘুরে দেখেন ধানুশকোডি জাদুঘর। এই জাদুঘরে স্থানীয় অঞ্চলের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির বহু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। ১৮৯৭ সালে ধনুশকোডি পরিদর্শন করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। এখানে রয়েছে এই মহামানবের একটি স্মৃতিসৌধ। বহু মানুষ ঘুরে দেখেন। আছে আরও কিছু দর্শনীয় স্থান। সবমিলিয়ে ধনুশকোডি ভ্রমণ মনের মধ্যে অফুরান আনন্দের জন্ম দেবে। সপরিবারে ঘুরে আসুন। সমুদ্র সৈকত হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
ধনুশকোডির ডাক
তামিলনাড়ুর পূর্ব উপকূলে রামেশ্বরম দ্বীপের তীরে অবস্থিত ধনুশকোডি। নির্জন, নিরিবিলি এক স্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। তার মধ্যেও থাকেন মৎস্যজীবীরা। বেড়াতে আসেন বহু পর্যটক। সপরিবারে ঘুরে আসতে পারেন। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী