নির্বাচনী প্রচার থেকে শুরু করে নানান রাজনৈতিক ও সরকারি অনুষ্ঠানে হাইস্পিড, বুলেট ট্রেন চালানোর স্বপ্ন ফেরি করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অথচ, ট্রেনের ঝুঁকির যাত্রায় কেন ইতি টানা যাচ্ছে না? মোদি সরকারের কাছে সে প্রশ্নের উত্তর নেই।
১৭ জুন ডাউন কাঞ্জনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। সেই ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এক মাসের মধ্যে ফের রেল দুর্ঘটনা। গতকাল গোন্ডার কাছে মোতিগঞ্জ এবং জিলাহির মাঝখানে ডিব্রুগড় এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল তা তদন্তসাপেক্ষ। তবে প্রাথমিক ভাবে খবর, তিন-চার জন মারা গিয়েছেন। অন্তত ১০-১২টি কামরা লাইনচ্যুত হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গেছে। সাংসদ মহুয়া মৈত্র এই প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন, মোদি জমানায় গত ১০ বছরে ভারতীয় রেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকে গিয়েছে। মনে রাখতে হবে, এক বছর আগে গত বছর জুন মাসে করমণ্ডল এক্সপ্রেস ভয়ানক দুঘটনার শিকার হয়।
আরও পড়ুন-তারকেশ্বরে শ্রাবণী মেলা গুচ্ছ নির্দেশ প্রশাসনের
পর পর দুর্ঘটনা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন— কে দায়ী? আমাদের কি শুধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা উচিত নাকি সরকারের থেকে জবাব চাওয়া উচিত? মৃতের সংখ্যা কি শুধুই পরিসংখ্যানে পরিণত হয়েছে? মনে হয়, এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে বেশি খোঁজাখুঁজির দরকার নেই। এ তো পরিষ্কার, এতগুলো দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মোদি সরকার এবং কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী। তাঁকে আগে বরখাস্ত করতে হবে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সময় থেকে রেলমন্ত্রী এবং রেল মন্ত্রককে সিগন্যালিং সিস্টেমের ব্যর্থতার বিষয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল। তবে তা কানে তোলা হয়নি। ২০২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সাউথ ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে জোনের চিফ অপারেটিং ম্যানেজার সিগন্যালিং সিস্টেমের ব্যর্থতার বিষয়ে লিখেছিলেন, ট্রেনকে সঠিক সিগন্যাল দেখানোর পরে যাত্রাপথের দিকনির্দেশনা দেখানোর ক্ষেত্রে গলদ রয়েছে। কেন এই নিয়ে এখনও কোনও পদক্ষেপ করেনি রেল?
আরও পড়ুন-উন্নত বাস পরিষেবায় পিপিপি মডেল
সাম্প্রতিক অতীতে একাধিক মালগাড়ি লাইনচ্যুত হয় এবং লোকো পাইলটের মৃত্যু হয়। তাতেও কেন সরকারের ঘুম ভাঙেনি? এটাই কি সত্যি যে রেলমন্ত্রী আদতে বিপণনী প্রচার করছেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতেই বেশি ব্যস্ত। তাই তিনি রেলওয়ের নিরাপত্তার দিকে মনোযোগী নন। মনে পড়ে যাচ্ছে, গত ২ জুন, ২০২৩-এ চিন্তন শিবিরে রেল সুরক্ষা সংক্রান্ত প্রেজেন্টেশনে উপস্থিত ছিলেন না রেলমন্ত্রী। কেন?
রেলের কর্মীবল কম হওয়ার কারণেই কি এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে? সেটাও সামনে আসা দরকার। বর্তমানে রেলের ৩৯টি জোনে গ্রুপ সি-র ৩ লাখ ১১ হাজার পদ শূন্য পড়ে রয়েছে। স্মর্তব্য, ২০২২-২৩-এ ভারতে ৪৮টি ট্রেন দুর্ঘটনা হয়েছে যেখানে জানমালের ক্ষতি হয়েছে। তার আগের বছর ২০২১-২২-এ এই ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৩৫। কেন রেলের সব জোনে এখনও ‘কবচ’ সিস্টেম বসানো হয়নি? সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার হিম্মত আছে এই সরকারের? ‘কমিশন অফ রেল সেফটি’রও তো ডানা ছেঁটেছে রেল মন্ত্রক। রেলের সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না। এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
নরেন্দ্র মোদি সরকারের গত এক দশকে একের পর এক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার পরেও রেলযাত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে কোনও নজর পড়েনি। এর জন্য কেন্দ্রের গাফিলতি দায়ী। সেকথা বোধ হয় আর নতুন করে বলার দরকার নেই। রেল মন্ত্রককে এই সরকার ক্যামেরা-চালিত আত্মপ্রচারের মঞ্চ হিসেবে পরিণত করেছে। তাই মোদি সরকার এই দুর্ঘটনাগুলোর দায় এড়াতে পারে না। ভুল ব্যবস্থাপনা, ভুল নীতি, ভুল পদক্ষেপ এজন্য দায়ী। দিন-দিন লাইনের উপর চাপ বাড়ছে। কিন্তু, নিরাপত্তায় কোনও নজর নেই। স্পষ্ট কথাটা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা দরকার। মোদি সরকার বন্দে ভারত নিয়েই ব্যস্ত। বাকি রেল ব্যবস্থা চুলোয় গেলেও মোদির প্রচারমুখ নিয়েই ব্যস্ত রয়েছেন রেল আধিকারিকরা।
মোদি সরকার রেলপথকে পরিত্যাগ কবেছে। এটা নিঃসন্দেহে অপরাধমূলক কর্ম।
আরও পড়ুন-ইউরোপের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় উত্তরপাড়ার শুভমের
লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, ১৯৫৬ সালে, এবং ১৯৯৯ সালে নীতীশ কুমার, ভারতের একমাত্র রেলমন্ত্রী যারা বড় দুর্ঘটনার পরে পদত্যাগ করেছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেশ প্রভু এবং রাম বিলাস পাসওয়ান তাদের পদত্যাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীরা গ্রহণ করেননি। ২০২৩ সালের জুন থেকে, দুটি উচ্চ-হত্যাকারী বিপর্যয় ঘটেছে। ২০২৩ সালের ২ জুন ওড়িশার বালাসোরে একটি তিনটি ট্রেনের সংঘর্ষে ২৯৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। সেই বছরেই ২৯ অক্টোবর, অন্ধ্রপ্রদেশের ভিজিয়ানগরামে দুটি ট্রেনের সংঘর্ষে ১৭ জনের মৃত্যু হয়।
সব মিলিয়ে রেলে ভ্রমণ ক্রমশ অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ এবং সমস্যাজনক হয়ে উঠছে৷ বারবার এই ধরনের ঘটনা ভারতের রেলওয়ে ব্যবস্থার যা লক্ষ লক্ষ মানুষের সেবা করে সেটার প্রতি মোদি সরকারের ঢিলেঢালা মনোভাব প্রকাশ করে।
সুতরাং, গত ১০ বছরে, মোদি সরকার কীভাবে রেল মন্ত্রকের সম্পূর্ণ অব্যবস্থাপনায় লিপ্ত হয়েছে, কীভাবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে রেল মন্ত্রককে ‘ক্যামেরা চালিত’ স্ব-প্রচারের একটি প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত করেছে তা সকলের সামনে তুলে ধরা আমাদের বাধ্যতামূলক কর্তব্য! সেই কাজটাই আজ ব্যথিত ও রাগত চিত্তে করতে বাধ্য হলাম।