নারী জাগরণে সারদামণি

তিনি ছিলেন নীরব কর্মী। এই জগৎকে দেখিয়েছিলেন নারীশক্তির জাগরণই সভ্যতার মূল স্তম্ভ। দেড়শো বছর আগে তাঁর চিন্তা-ভাবনা, কাজকর্ম সবই ছিল সে-যুগের তুলনায় যথেষ্ট আধুনিক। তিনি আমাদের শ্রীশ্রী মা সারদা। সেই যুগে দাঁড়িয়ে মায়ের দৃঢ় সমর্থন মেয়েদের আলোর দিকে চলার পথ মসৃণ করেছিল। আজ মায়ের প্রয়াণদিবস উপলক্ষে লিখছেন চৈতালী সিনহা

Must read

উপক্রমণিকা
‘কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো, রূপকথা নয় সে নয়’। বলা ভাল রূপকথার চাইতে অনেক বেশি সে অপরূপ কথা। বাঁকুড়ার এক গণ্ডগ্রামের অতি সাধারণ পল্লিবালা কিংবা হুগলি জেলার এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের বধূর স্নিগ্ধ দীপ্তিটি এক অনন্ত জ্যোতি শিখা হয়ে তাঁর গ্রাম পেরিয়ে শহর ছাড়িয়ে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে তখন তিনি হয়ে ওঠেন এক মহাজাগতিক বিস্ময়। অবগুণ্ঠন ভেদ করে সামনে এসে দাঁড়ায় এক চিরন্তন মাতৃমূর্তি। জানিয়ে যান অনাদিকালের উৎস থেকে তাঁর বিপুল কর্মভার নিয়ে ক্ষণিক মর্ত্য ভ্রমণ— কাজ শেষে ফিরেছেন সেই অসীম চিরন্তনে, রেখে গেছেন এক দীপ্ত নারী জাগরণ শিক্ষা, সমাজ চেতনা যা শুধু যুগ নয়, পেরিয়ে যাবে যুগান্তরও।
পটভূমিকা
সে কোন সময়ের কথা! মানুষ তখন মাইলের পর মাইল হেঁটে যাতায়াত করে, ডাকাতের দল পথে-ঘাটে মানুষকে আক্রমণ করে, লোকে নৌকা করে গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতা যায়, বাবুরা বিলাসিতায় বেড়ালের বিয়েতে টাকা খরচ করে, দেশে তখন কোম্পানির রাজত্ব আর তার মাত্র কিছুদিন আগে বাঙালির রাম আগুন গ্রাস থেকে বাঁচিয়েছে বাঙালি বিধবাকে। এই সামাজিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বাংলায় ঘটে এক মহাজাগতিক বিস্ফোরণ। ১৮৫৩ সালে জগন্মাতার মৃন্ময়ী রূপে আবির্ভাব বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটি গ্রামে মুখোপাধ্যায় পরিবারে। বাবা রামচন্দ্র, মা শ্যামাসুন্দরীর প্রথম সন্তান ক্ষেমঙ্করী কিংবা ঠাকুরমণি অথবা সারদামণি মুখোপাধ্যায়।
গৌরচন্দ্রিকা
১৮৩৬ সালে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব এলেন অবতার রূপে বিশেষ পৃথিবী পরিক্রমায়। সেই সম্ভবামি যুগে যুগের ভাষণ সত্যি প্রমাণ করতে। উনি এলেন, প্রস্তুত করলেন ক্ষেত্র, তৈরি করলেন প্রয়োজন, তাই অগ্নির দাহিকা শক্তির মতোই মা এলেন ঠাকুরের শক্তি রূপে। ভাবাবিষ্ট যুবক গদাধর অভিভাবকদের জানালেন জয়রামবাটির রামচন্দ্র মুখুজ্যের বাড়িতে বিয়ের কনে কুটো বাঁধা আছে। আর এর কয়েক বছর আগেই মামাবাড়ি শিহড়ে কীর্তনের আসরে মা শ্যামাসুন্দরী দেবীর কোলে শিশু সারদা হাত তুলে বর দেখিয়ে ছিলেন সেই গদাধরকেই। এভাবেই তাঁরা এক এবং অচ্ছেদ্য ও অবিভাজ্য।

আরও পড়ুন-রোমানিয়ার পার্লামেন্টে ভালুক হত্যার অনুমতি

বীজ বপন
রাম এবং কৃষ্ণের ঐশ্বর্য ছেড়ে রামকৃষ্ণদেব এলেন ঐশ্বর্যবিহীন লীলায় তাই মাও অবগুণ্ঠিতা, লজ্জাপটাবৃতা। পাহাড়-পর্বতে তপস্যা নয়, বক্তৃতা নয়, গ্রন্থাদি রচনা নয় এমনকী ত্যাগী শিষ্যদের সাথে সামনে সামনে কথাটি পর্যন্ত নয়— তবু লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে তিনি জগতের কাছে রেখে গেলেন মহা জীবনের আদর্শ। মুখ ঢেকে, নীরবে করলেন অসামান্য সব বিপ্লব। যে বিপ্লবের ক্ষুদ্র এক অংশের আধুনিক নাম নারীবাদী আন্দোলন।
প্রাণপ্রতিষ্ঠা
যুগে যুগে মানুষ নির্ভর করেছে ঈশ্বরের করুণার, যুগে যুগে ঈশ্বর নির্ভর করেছে মানুষের পুজোর। পল্লিবালা সারু থেকে সারদামণি হয়ে মা হলেন অবতারের স্ত্রী। চোদ্দো বছরের স্ত্রী শুনলেন স্বামী পাগল হয়ে গেছে। আনচান প্রাণ করে স্ত্রীর কর্তব্য, ছুটে চলেন দক্ষিণেশ্বরে। ঐশ্বরিক ভাবের ঘোরে থাকা স্বামীকে চিনলেন। ঈশ্বরপাগল স্বামীর উপযুক্ত স্ত্রীর মতো জবাব দিলেন— ‘তোমাকে ইষ্টপথে সাহায্য করতে এসেছি’। যোগ্য আধার দেখে অবতার তাঁকে শক্তিরূপে করলেন সংস্থিতা। সেই ফলহরিণী কালীপুজোর রাতে মা পূজিতা হলেন ষোড়শী রূপে, ঠাকুর মায়ের চরণে সমর্পণ করলেন তাঁর জপের মালা, সাধনার ফল। বিপ্লবের উদ্বোধন হল সে রাতে— সাধন জগতের ইতিহাসে এটি এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

আরও পড়ুন-সংঘর্ষে ফের মৃত্যু, ঢাকা যেন উপদ্রুত নগরী

সংঘজননী
মা নীরব কর্মী। কাজের মধ্যে মায়ের বাণী। ঠাকুর বলছেন শিষ্যকে সাধন ভজনের জন্য কম খেতে। মা মৃদু স্বরে বলছেন, ছেলেদের কম খেতে দিতে পারব না। ঠাকুর ওতে সাধনার ক্ষতি হবে বলাতে মা বলেছিলেন, ওদের সাধন-ভজনের ভার আমি নিলাম। মা তাই কথা রেখেছিলেন। জগন্মাতা, গুরুপত্নী, পাতানো মা নয়, মা হয়ে উঠেছিলেন সত্যিকারের মা। মায়ের একান্ত ইচ্ছেয় শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী পার্ষদদের সংঘবদ্ধ করে, রামকৃষ্ণ আদর্শকে বিশ্বজনীন করে তোলা সম্ভবপর হয়েছিল। মা ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছেন প্রতিনিয়ত, ‘ঠাকুর, তোমার নামে যারা বেরুবে তাদের মোটা ভাত-কাপড়ের অভাব যেন না হয়। ওরা সব তোমাকে, আর তোমার সব ভাব, উপদেশ নিয়ে একত্রে থাকবে। আর এই সংসারতাপদগ্ধ লোকেরা তাদের কাছে এসে তোমার কথা শুনে শান্তি পাবে। এই জন্যই তো তোমার আসা। ওদের ঘুরে বেড়ানো দেখে আমার প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে।’ এভাবে মায়ের একান্ত ইচ্ছায় গড়ে ওঠে শ্রীরামকৃষ্ণ সংঘ। মা হয়েছিলেন সংঘজননী। মায়ের দৃঢ়তায় একবার রক্ষা পেয়েছিল বেলুড় মঠ। সেবাকাজের টাকা জোটাতে স্বামীজি বেলুড় মঠ বিক্রি করতে চাইলে, মা মনে করিয়ে দিলেন, মঠ মায়ের নামে সংকল্প এবং ঠাকুরের নামে উৎসর্গীকৃত। একটা মাত্র সেবাকাজের জন্য বেলুড় মঠ নিঃশেষ হয়ে যাবে না— এ অনন্ত, অক্ষয়। স্বামীজি বললেন— মা ঠাকুরানি ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী মৈত্রেয়ী জন্মাবে।
শক্তিরূপেণ সংস্থিতা
ঠাকুরের দেহ ছাড়ার পর ঠাকুরের নির্দেশ পেয়ে মা লাল পাড় কাপড় পরতেন সবদিন, হাতে রেখেছিলেন অলংকার। মায়ের চুলও ছিল স্বাভাবিক ভাবে, বৈধব্য রীতিতে ছাঁটা নয়। মায়ের সেযুগের কথা ভাবলে এ অসম্ভব বোধ হবে। এমনকী এখন এই সিলিকন যুগেও বিধবাদের লাল রং পরা সামগ্রিক ভাবে প্রচলিত নয়। তাই দেড়শো বছর আগে সমাজকে তোয়াক্কা না করে অন্তরের আবেগকে প্রতিষ্ঠিত করাটা রীতিমতো বৈপ্লবিক বলা যায়।
ক্ষীরোদবালা নামক এক বাল্যবিধবা রমণীকে মা শিক্ষা দিচ্ছেন— বাছা অনেক কঠোর করেছে। আমি বলছি, আর কোরো না। দেহটাকে একেবারে কাঠ করে ফেলেছ। দেহ নষ্ট হলে কী নিয়ে ভজন করবে, মা?
আরেক বাল্যবিধবা শবাসনা দেবীকে নিরম্বু উপবাস করতে দেখে মায়ের আদেশ— আত্মাকে কষ্ট দিয়ে কী হবে? আমি বলছি, তুই জল খা। যান্ত্রিকভাবে পালিত কোনও আচার-অনুষ্ঠানই মা পছন্দ করতেন না। তাই ভক্তদের বলতেন— খেয়েদেয়ে দেহটা ঠান্ডা করে নিয়ে ভগবানকে ডাকো।
শ্রীমা জানতেন জোর করে ছড়ি ঘুরিয়ে সংযম শেখানো সম্ভব নয়। অতি স্বচ্ছ অথচ শক্তিময়ী এই জীবন দৃষ্টি। জাতের নামে বজ্জাতি সব।

আরও পড়ুন-ফের বিপুল কর্মসংস্থান রাজ্যে! শূন্য প্রধান শিক্ষক পদে দ্রুত নিয়োগ

ব্রাহ্মণের বিধবার অব্রাহ্মণের ছোঁয়া খাবার খাওয়া এখনও অনেকেই ভাবতে পারেন না। অব্রাহ্মণ সেবকের রান্না ডাঁটা-চচ্চড়ি মাকে খেতে দেখে গোলাপ মা স্তম্ভিত, প্রতিবাদ করলেন। মা জানালেন ভক্তের কোনও জাত নেই। সংস্কার বিমুক্ত হলে তবেই তো ব্রহ্মপদ প্রাপ্তি। যা চিত্তকে ছোট করে, মনকে যা আবদ্ধ করে, তা কখনও ধর্ম হতে পারে না। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে এই উদার স্বচ্ছ মানবিক দৃষ্টির ফলেই অন্ধ কুসংস্কার, জাতপাত, ছুঁতমার্গ, দেশাচার ও যুক্তিহীন প্রথার বিরুদ্ধে মায়ের ছিল এক সংগ্রামী ভূমিকা। এদিকে বিচার করলে মা ছিলেন এক আত্মশক্তিতে বলীয়ান বিপ্লবী। একবার জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভক্তকে ডেকে এনে একপাত্রে মুড়ি জিলিপি খাইয়ে ছিলেন মা নিজে।
তুঁতে চাষি ডাকাত তায় মুসলমান আমজাদকে মা স্বহস্তে খাইয়ে দিয়েছেন। সমাজের বক্রোক্তিকে তোয়াক্কা না করে দৃঢ় কণ্ঠে মাতৃবাণী ঘোষিত হল, আমার শরৎ যেমন ছেলে, এই আমজাদও তেমন ছেলে।
মায়ের কাকা নীলমাধব মুখুজ্যের মৃত্যুর পর শববাহকদের মধ্যে একজন ছিলেন শূদ্র। গোলাপ মা একে অশাস্ত্রীয়, অবৈধ আখ্যা দিলে মা এক যুগান্তজয়ী উক্তি করলেন— শুদ্দুর কে, গোলাপ? ভক্তের জাত আছে কি? জাগতিক দৃষ্টিতে এক অজগ্রামের অশিক্ষিত, বিধবা রমণী দেড় শতক আগে এই সব যুগান্তকারী চিন্তা ভাবনা তাঁকে বিশ্ব মাতৃকাতে উন্নীত করেছে সন্দেহ নাই।
প্রাচ্য পাশ্চাত্য
মা সারদা জানতেন প্রাচ্যের একদা গৌরব রবি অস্তমিত, তাকে ফেরাতে পাশ্চাত্যের হাত ধরতেই হবে। তাই তখনকার দিনে নিষিদ্ধ তাও সমুদ্র পেরিয়ে আমেরিকা যেতে অনুমতি দিয়েছিলেন নরেনকে। নরেন বিশ্বজয় করে ফেরার পর তাঁর অনুগামিনী সিস্টার নিবেদিতা, মিসেস বুল, ভগিনী দেবমাতাকে গ্রহণ করেছিলেন কন্যাজ্ঞানে। যে যুগে খ্রিস্টানের ছায়া স্পর্শ করলে জাত যেত, সে যুগে মা অহরহ দিতেন সমাজকে ঝাঁকুনি। নিবেদিতা ছিলেন মায়ের আদরের খুকি। চিবুক স্পর্শ করে আদর করা, একসাথে আহার আর নিবেদিতার সেবা নিয়ে মা তদানীন্তন সমাজকে একটি সুবৃহৎ কাঁচকলা দেখিয়েছিলেন। অবশ্যই মা এসব করেছিলেন তাঁর অন্তরের অন্তস্তল থেকে উঠে আসা গভীর মাতৃত্ব ও ভালবাসার বোধ থেকে। সমাজের বিরোধিতা করে প্রচারের আলো পাওয়ার কথা ভাবার কোনও প্রয়োজন মায়ের ছিল না। যে মা শরৎ মহারাজের কাছেও লম্বা ঘোমটা দিয়ে থাকতেন, সেই মা আবার তাঁর বিদেশিনি কন্যাদের আবদারে অপরিচিত সাহেব ফটোগ্রাফারের সামনে মুখ খুলে ফটো তুলিয়েছেন। সঙ্গীদের প্রবল আপত্তিতেও শ্রীমা অনেকদিন নিবেদিতাকে নিজের কাছে রেখেছিলেন। নিবেদিতার সাথে মা একসাথে খেতেন। নিবেদিতার প্রতিটি কর্মপ্রয়াসের পশ্চাতে ছিল মায়ের উৎসাহ ও সমর্থন। এক সময় মা ব্রহ্মচারীদের জ্ঞানার্জনের জন্য ইংরেজি লেখাপড়া শিখতে বলেছিলেন। মায়ের কর্ম মায়ের বাণী, মায়ের নীরবতা মায়ের সোচ্চার অস্ত্র, কোমলতা মায়ের দৃঢ়তারই রূপভেদ মাত্র।

আরও পড়ুন-তুঙ্গে প্রস্তুতি, ফিরলেন অভিষেক

মাতৃভাব : মহাভাব
সাধনার সেরা ভাব মাতৃভাব। শ্রীশ্রী সারদা মায়ের মধ্যে সেই মহামাতৃভাব সব সময়। অক্ষয়কুমার সেন একজন মহিলাকে জয়রামবাটি পাঠালেন মায়ের জন্য কিছু জিনিস দিয়ে। মায়ের কাছে এসে সে তেল মেখে স্নান করে পেট ভরে প্রসাদ পেয়ে খুব খুশি। অবেলায় মা তাকে ছাড়লেন না, রাতে সে রয়ে গেল মায়ের ঘরের বারান্দায়। মা ভোর রাতে উঠে দেখেন মেয়েটির জ্বর, আর সে অজান্তেই বিছানা নোংরা করে ফেলেছে। অন্যেরা টের পেলে বেচারির লাঞ্ছনাগঞ্জনা হবে তাই মা তাকে মুড়িগুড় দিয়ে রোদ ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়তে নির্দেশ দিলেন। সে প্রণাম করে বিদায় নিলে মা স্বহস্তে সব পরিষ্কার করলেন! রাখাল বালক গোবিন্দ খোসপাঁচড়ায় কষ্ট পাচ্ছিল। তাকে মা নিজের হাতে নিমপাতা হলুদ বেটে লাগিয়ে সুস্থ করে তোলেন। মুসলমান ডাকাত কলা এনেছে দ্বিধায়, মা নেবেন কি? মা নিলেন। একজন সেখানে প্রতিবাদ করছে, চোরের জিনিস ঠাকুরকে দেওয়া কেন? মা বললেন, দোষ তো মানুষের লেগেই আছে। কী করে তাকে ভাল করতে হবে তা জানে ক’জন?
মহাকরুণাময়ী মাতৃভাবে মাতৃশক্তিকে জাগ্রত করে মা জগতের কাছে দেখালেন নারীশক্তির জাগরণ সভ্যতার মূল স্তম্ভ।
মায়ের ভাবনায় মেয়েরা
সে-যুগে মেয়েদের কাজের জায়গা মাত্র দুটো— রান্নাঘর আর আঁতুড়ঘর। সেই যুগে দাঁড়িয়ে মা এমন কিছু সাহসী বার্তা দিয়েছেন সেটা সমকালীন চিন্তা-ভাবনাতেও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। এক স্ত্রীভক্ত মেয়ের বিয়ে দিতে না পারায় আক্ষেপ করলে মা বলছেন— বে দিতে না পারো, এত ভাবনা করে কী হবে? নিবেদিতার ইস্কুলে রেখে দিও। লেখাপড়া শিখবে বেশ থাকবে। মায়ের নিজের জ্ঞানস্পৃহা ছিল প্রবল। লেখাপড়া করার অপরাধে একবার ঠাকুরের ভাগ্নের কাছে গঞ্জনা শুনেছিলেন কত! মা নিবেদিতা বিদ্যালয়ে গিয়ে কত খুশি হয়েছেন মেয়েদের কাজ দেখে। আফসোস করেছেন— আহা, তারা কেমন সব কাজকর্ম শিখেছে! আর আমাদের! এখানে পোড়া দেশের লোকে কি আট বছর হতে না হতেই বলে, পরগোত্র করে দাও, পরগোত্র করে দাও। আহা! রাধুর যদি বিয়ে না হত, তাহলে কি এত দুঃখ দুর্দশা হত? অধিক সন্তান নিয়ে মায়ের সাহসী মন্তব্য— একটা দেহ হতে পঁচিশটা ছেলে বেরুচ্ছে, ওরা কি মানুষ! সংযম নেই কিছু নেই— যেন পশু। বিবাহ প্রসঙ্গে মায়ের উক্তি— সংসারে সবই দুটি দুটি। এই দেখো না চোখ দুটি, কান দুটি, হাত দুটি— তেমন পুরুষ ও প্রকৃতি। এইভাবে নারী-পুরুষের সমান চিন্তা ভাবনাকেই তো আজকের সমাজ বলে নারীবাদ। যদিও এটাই আসলে মানবতাবাদ। নারীবাদী ভাবনা মানেই শুধু সংঘাত নয়। মায়ের ইচ্ছেতেই গড়ে উঠে ছিল ঠাকুর ও মায়ের আদর্শ প্রচারে সন্ন্যাসিনীদের জন্য সারদামঠ। মায়ের থেকে পাওয়া শিক্ষা : নিজের কাজের প্রতি ভালবাসা, সকলকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষা আর কাজ তুচ্ছ হোক আর বৃহৎ হোক, তার সম্পর্কে মূল্যবোধ আর নিষ্ঠা— এটাই তো কর্মযোগের মূল শিক্ষা।

আরও পড়ুন-কোটা বিরোধী আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ, নিহত ৩২

সরস্বতী— জ্ঞানদায়িনী
দেড়শো বছর আগেকার বাংলার পটভূমিকায় মায়ের চিন্তা-ভাবনা কাজকর্ম— সবই ছিল সে-যুগের তুলনায় যথেষ্ট আধুনিক। মা দেশাচারকে মেনে, নিজের কর্তব্য কর্ম করে, ভারতীয় নারীর শাশ্বত ভাবধারাটি বজায় রেখেছেন যেমন আবার নতুন চিন্তাভাবনা আলোকেও প্রবেশ করতে দিয়েছেন স্ব-ছন্দে। সেই যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মায়ের উৎসাহে শুরু হয়েছিল নিবেদিতার বালিকা বিদ্যালয়। সেই যুগে দাঁড়িয়ে মায়ের দৃঢ় সমর্থন মেয়েদের আলোর দিকে চলার পথ মসৃণ করেছিল নিঃসন্দেহে। আজ দেড়শো বছর পেরিয়ে এসে নানা অনুকূল পরিবেশে আজ মেয়েরা সোচ্চারে অর্ধেক নয়, সমগ্র আকাশের জন্য লড়াই করছে— তার পোশাকি নাম নারীবাদ হলেও সেই যুগ সন্ধিক্ষণে মায়ের কাছ থেকে যে আত্মশক্তি জাগরণের শিক্ষা মানুষ পেয়েছে সেটাও নীরব নারীবাদ।
পরিশিষ্ট : মাতৃকথামৃত
ভগবানলাভ হলে আর কী হয়, দুটো শিং বেরোয়? না, মন শুদ্ধ হয়! শুদ্ধ মনে জ্ঞান, চৈতন্য, আনন্দ লাভ হয়। ভগবানে ভক্তি ভালবাসা, অনুরাগ বাড়ে। সর্বদা একটা টান থাকে।
যার আছে সে মাপো, যার নেই সে জপো।
সাধন বলো, ভজন বলো, প্রথম বয়সেই করে নেবে। শেষে কি আর হয়? যা করতে পারো, এখন।
আমি সতের ও মা অসতেরও মা
যদি শান্তি চাও, মা, কারও দোষ দেখো না, দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার।

Latest article