জ্ঞান হওয়ার পর বাবাকে দেখেননি। সংসারে ছিল না সচ্ছলতা। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন মা। মগরাহাট থেকে যেতেন দূর শহরে। শাকসবজি বিক্রির উদ্দেশ্যে। উপার্জন হত সামান্যই। তাই দিয়েই কোনওরকমে চলত পেট। সাত-আট বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে প্রথমবার কলকাতায় যান। ঘটনাক্রমে মুখোমুখি হন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, বিখ্যাত চিত্রশিল্পী বলদেব রাজ পানেসরের। এই আশ্চর্য মানুষটি ফুটপাথে পথশিশুদের সঙ্গে সহজেই মিশে যেতে পারতেন। তাদের খেতে দিতেন। পড়াশুনার ব্যবস্থা করতেন এবং কারওর মধ্যে সামান্যতম শিল্পের সম্ভাবনা থাকলে তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন। একদিন এইভাবেই ফুটপাথে ঘুরছেন পানেসর। সবজি বাজারে মায়ের পাশে চুপটি করে বসে মেয়েটি। ছোট্ট মেয়েটিকে দেখে তাঁর দিকে চকোলেট বাড়িয়ে দেন পানেসর। মেয়েটি প্রথমে নিতে চাননি। লজ্জা পান। পানেসর জানতে চান, তোমার নাম কী? মেয়েটি বলেন, ‘শাকিলা’।
আরও পড়ুন-সংঘর্ষে ফের মৃত্যু, ঢাকায় কার্ফু, নামল সেনা
একরত্তি মেয়েটির মায়ামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে গভীর স্নেহ জন্মায় পানেসরের। তিনি কাগজ, রং পেনসিল এগিয়ে দেন। নিজের ইচ্ছেমতো কিছু একটা আঁকতে বলেন। শাকিলা আঁকেন। তাঁর হাতের আঁকা দেখে মুগ্ধ হন পানেসর। দায়িত্ব নেন মেয়েটির। স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু জীবনের চিত্রনাট্য লেখা হয়েছিল একটু অন্যভাবে। বারো বছর বয়সে সবজি বিক্রেতা আকবরের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় শাকিলার। এই খবর শুনে অসন্তুষ্ট হন পানেসর। তিনি চেয়েছিলেন মেয়েটা নিজের পায়ে দাঁড়াক। কিছু একটা করুক। তারপর সংসার। কিন্তু আর তো কিছুই করার নেই। বিয়ে হয়ে গিয়েছে। রাগ সংবরণ করেন পানেসর। তিনি শাকিলাকে সাহায্য করার জন্য কিছু রঙিন কাগজ দেন। উদ্দেশ্য ঠোঙা তৈরি করে যাতে মেয়েটার আর্থিক সুরাহা হয়। সেই রঙিন কাগজ নিয়ে সংসারের কাজের ফাঁকে শাকিলা ঠোঙা তৈরি করতে থাকেন। পাশাপাশি অবসর সময়ে রঙিন কাগজ হাতে ছিঁড়ে বোর্ডের ওপর জুড়ে জুড়ে তৈরি করতে থাকেন কোলাজ। এইভাবেই নিভৃতে মেতে ওঠেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। শাকিলার এই অহেতুক সৃষ্টি একদিন নজরে আসে তাঁর স্বামীর। তিনি স্ত্রীকে উৎসাহ দেন। একদিন স্বামী-স্ত্রী কলকাতায় আসেন। চুপিচুপি। চিত্র প্রদর্শনী দেখে গ্রামে ফিরে যান। এরপর এক রবিবার শাকিলা একটি কোলাজ নিয়ে উপস্থিত হন পানেসরের কাছে। চিত্রপট সমানভাবে চারভাগে ভাগ করা। মুলো, বেগুন, টমাটো, কাঁচালঙ্কা। এক-এক ভাগে এক-একটি সবজি। যেভাবে বাজারে মাটির ওপর চটের বস্তা পেতে সাজিয়ে রাখেন সবজি বিক্রেতারা। এই কোলাজ দেখে মুগ্ধ হন পানেসর। তিনি দেখান তাঁর চিত্রশিল্পী বন্ধুদের। জানান শাকিলার জীবনবৃত্তান্ত। এরপর ঘটে যায় এক অভাবনীয় ঘটনা। ১৯৯১ সালে চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে আয়োজিত হয় শাকিলার কোলাজের প্রদর্শনী। তাঁর হাতের কাজ গৃহীত হয় কলকাতার বিদগ্ধ সমাজে। পানেসরের হাত ধরে আরও অনেকেই এগিয়ে এলেন শাকিলার শিল্পচর্চাকে আলোকিত করতে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম সিমা আর্ট গ্যালারির রাখি সরকার। তাঁর উদ্যোগে ১৯৯৪ সালে দিল্লিতে আয়োজিত হয় শাকিলার প্রদর্শনী। এনে দেয় জাতীয় সম্মান। দেশ-বিদেশের শিল্প রসিকদের কাছে পৌঁছে যায় শাকিলা শেখের নাম। গ্রাম্য, নিরক্ষর, প্রান্তিক মানুষ তিনি। কোনওরকম প্রকৌশল না জেনে, কোনও বিদ্যানিকেতন কিংবা শিল্পমন্দিরে পাঠ গ্রহণ না করেও নানান প্রতিকূলতার মধ্যে সৃষ্টিতে মুখর থাকেন। তাঁর কোলাজের বিষয় হয়ে ওঠে বাবরি মসজিদ ধ্বংস। মুসলমান ঘরের বউ হয়েও হিন্দু দেবী কালীকে তিনি তাঁর কোলাজে বারবার বিভিন্ন প্রেক্ষিতে আবিষ্কার করেন। এছাড়াও গ্রামের ঘরদোর, মাটির দাওয়া, পুকুর, হাঁস-মুরগি, সবজি, গ্রামের বাজার ইত্যাদি হয়ে ওঠে শাকিলার শিল্পের বিষয়বস্তু। বর্তমানে তাঁর কাজ আন্তর্জাতিক। তাঁর কাজ পৌঁছে গিয়েছে ফ্রান্স, জার্মানি, নরওয়ে, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে। ইতিমধ্যেই পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। তাঁকে নিয়ে চলছে হইচই। এই সবকিছু সম্ভব হয়েছে পানেসরের জন্য। এই মানুষটি না থাকলে কিন্তু অসাধ্যসাধন হত না। তিনি আবিষ্কার করেছেন এক শিল্পীকে। শাকিলা পানেসরকে ‘বাবা’ ডাকেন। শাকিলার উপর তৈরি হয়েছে একটি তথ্যচিত্র, ‘শাকিলা : দ্য কোলাজ অফ স্ট্রাগল’। পরিচালনা করেছেন শুভাশিস চক্রবর্তী। ইন্ডাস্ট্রিতে এই পরিচালকের এক দশকেরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তিনি আরও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ২০১৫ সালে তিনি শুরু করেন ‘শাকিলা : দ্য কোলাজ অফ স্ট্রাগল’ ছবির চিত্রগ্রহণের কাজ। শেষ হয়েছে ২০২২-এ। মোট সাত বছর ধরে। তুলে ধরা হয়েছে শাকিলার জীবনসংগ্রাম এবং আশাতীত সাফল্যের কথা। ইতিমধ্যেই ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে কয়েকটি জায়গায়। পেয়েছে প্রশংসা। সম্প্রতি, ছবিটি ১৫তম আন্তর্জাতিক ডকুমেন্টারি ও শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অফ কেরালা এবং ২৫তম মাদুরাই ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি এবং শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ দেখানো হয়েছে৷ পাশাপাশি নবম আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভালে ফেস্টিভ্যাল মেনশন ডকুমেন্টারি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে। এই ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়েছে সিমলায়। ছবিটি আগামিদিনে আরও কয়েকটি জায়গায় দেখানো হবে। এর মধ্যে দিয়ে এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাদপ্রদীপের আলোয় আলোকিত হওয়া এক কোলাজ শিল্পীর জীবন, সংগ্রাম ও সাফল্যের কথা জানতে পারবেন দর্শকরা।