‘‘এই মিছিল সব হারার…সব পাওয়ার এই মিছিল..” প্রতিবছর একুশে জুলাই শিয়ালদহ থেকে যখন কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়ের একটা ছোট অংশ হয়ে এস এন ব্যানার্জি রোড ধরে আমরা এগোই, কেন জানি না কানে সলিল চৌধুরীর গানের এই একটা লাইন বারবার বাজে। এই যে চারিদিকে এত মাথা, এখানে তাদের একটাই পরিচয়। কে কোন ধর্মের, কে কোন জাতির, কে কোন জেলার সব ভুলে সবাই ছুটে এসেছে একজন মহিলার টানে। এখানে সবাই তৃণমূল। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি! যে অনুভূতি লিখে বা বলে ঠিক বোঝানো যায় না।
আরও পড়ুন-আজ মা সরদাকে স্মরণ করতেই হবে
একুশে জুলাই ১৯৯৩, কলকাতার রাজপথে গণতন্ত্র বাঁচানোর যে লড়াই তৎকালীন যুব নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে লড়েছিলেন এক ঝাঁক যুবক-যুবতী, তখনও এই নিবন্ধকারের জন্ম হয়নি। পৃথিবীর আলো দেখতে দেখতে আরও বছর দেড়েক বাকি। রাজনৈতিক জ্ঞান বা বোধ প্রথম তৈরি হচ্ছিল ক্লাস নাইন-টেনে এসে। বাংলার রাজনীতিতে সে এক উত্তাল সময়। বাড়ির টিভিতে তখন রোজ দেখছি সিঙ্গুরে জমি আন্দোলন, তার কিছুদিন বাদেই দেখলাম নন্দীগ্রামে নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর গুলি চালাল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। সেই প্রথম দুটো শব্দের সঙ্গে পরিচয় হল। ‘গণহত্যা’ আর ‘গণ আন্দোলন’। মনে আছে, দিদির অনশন মঞ্চ। আর সেখানে কবীর সুমন আর মহাশ্বেতা দেবীর উপস্থিতি। যদিও এসবই কৈশোরে, স্কুলবেলায় দেখা। সেই সুমনকেই অন্যভাবে আবিষ্কার করলাম বহু বছর বাদে এরকমই এক একুশের মঞ্চে। তখন কলেজে পড়ি। জেলা থেকে ট্রেনে যেতে যেতে একুশের মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায় প্রতিবছরই। সেরকমই একবার প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে মিছিলে হেঁটে যখন পৌঁছলাম একুশের মঞ্চ থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে, তখনই সুমন গেয়ে উঠলেন,
‘‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম,
মোরা ঝরনার মতো চঞ্চল।
মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়,
মোরা প্রকৃতির মতো সচ্ছল।”
আরও পড়ুন-বাম আমলে অবহেলিত খাদান-শ্রমিকদের সিলিকোসিস চিকিৎসা, অর্থসাহায্য রাজ্যের
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল সেই মুহূর্তটায়। শেষ লাইনটায় সুমন একটা শব্দ বদলে দিয়েছিলেন। গেয়েছিলেন ‘মোরা মমতার মতো সচ্ছল’! একটা আলাদা তরঙ্গ খেলে গেছিল গোটা শরীরে। এই সুমনকেই তো স্কুলবেলায় দেখেছি, টিভিতে দিদির ধরনা মঞ্চে গাইছেন, ‘‘শাল বল্লার বেড়ায় আগুন, বিরোধী নিশান ওড়া, ল্যাজে যদি তোর লেগেছে আগুন স্বর্ণলঙ্কা পোড়া!” সেই সুমনের গান একুশের মঞ্চে শোনাটা আলাদা উত্তেজনা। এই একুশের মঞ্চেই নচিকেতা গান ধরেছেন, ‘‘বসতি আবার উঠবে গড়ে, আকাশ আলোয় উঠবে ভরে, জীর্ণ পুরাতন সব ইতিহাস হবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে!” লাখ লাখ মানুষ গলা মেলাচ্ছেন সেই গানে! শিহরিত হয়েছি। প্রখর রোদে বসে বা দাঁড়িয়ে কয়েক লক্ষ মানুষ। হঠাৎই নামল প্রবল বৃষ্টি। শ্রাবণের প্রকৃতি যেমন হয়। হঠাৎ করে ঝমঝম বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিল। বেশিক্ষণ না, হয়তো মাত্র ৫ বা ১০ মিনিটের বৃষ্টি, তাতেই পুরো ভিজিয়ে দিল জামাকাপড়। একটু বাদেই আবার কড়া রোদ! ভেজা জামার সঙ্গে মিশছে ঘাম। তবুও লক্ষ লক্ষ মানুষ নড়ছে না। কেউ জায়গা ছাড়ছে না। কোনও এক আশ্চর্য জাদুবলে সবাই যেন এক জায়গায় স্থির। কোনও এক অদৃশ্য হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে দিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে! একটু বাদে দিদি বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলছেন, ‘‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে! এই বৃষ্টি তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য শুভ। ঈশ্বর আল্লাহর আশীর্বাদ হয়ে এই বৃষ্টি ঝরে পড়ছে!” দিদির এই বক্তব্য শুনে যেন আরও দ্বিগুণ উৎসাহ পাচ্ছে ভিড়টা! হাততালিতে ফেটে পড়ছে লক্ষ লক্ষ জনতা। বহুবার ভেবেছি, এটা কী করে সম্ভব? টাকা দিয়ে বা দামি খাবারের লোভ দিয়ে এ জিনিস করা যায় না। এ হল আবেগ। নিখাদ সোনার মতো আবেগ। যেটাকে কেনা সম্ভবই না।
একুশে জুলাইয়ের ধর্মতলা এলাকা আসলে যেন হয়ে ওঠে একটা প্রজন্ম চত্বর। কোনও অষ্টাদশী কন্যা, সদ্য কলেজের ফার্স্ট ইয়ার হয়তো প্রথমবার এসেছে কলেজের বন্ধু-বান্ধবী, সিনিয়রদের সঙ্গে। পুরুলিয়া বা বীরভূম থেকে আসা মেয়েটার প্রথমবার ‘একুশে জুলাই’ দেখে দু’চোখে যেন অপার বিস্ময়! আবার কেউ হয়তো সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ। প্রতিবার লোকাল ট্রেনে করে শিয়ালদহে নেমে, পায়ে হেঁটে এই সভামঞ্চের কাছাকাছি ঠিক চলে আসেন। তারপর ক্লান্ত শরীরে পিচ রাস্তার ওপরেই বসে পড়েন। তিরানব্বইয়ের সেই রক্তাক্ত একুশে জুলাইয়ের দিনেও সাক্ষী ছিলেন, আজও সাক্ষী হলেন এরকম কত প্রবীণ মানুষজন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বদলাতে থাকে, কিন্তু কালীঘাটের টালির চালে থাকা সাদা শাড়ি আর হাওয়াই চটি পরা মহিলাটির ডাকে মানুষের সমাগম বছর বছর বাড়তেই থাকে। একটা ঐশী বিভ্রম হয়। যা দেখছি সঠিক দেখছি তো! ঠিক যেই মুহূর্তে নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সভামঞ্চে ওঠেন, তখন কয়েক লক্ষ মানুষের মধ্যে যে হিল্লোলটা ওঠে, তাকে কী বলা যায়? ‘মেক্সিকান ওয়েভ’? নাকি জনসমুদ্রের উচ্ছ্বাস? ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হয়, এই মহিলাটিকে নিয়ে আপনি সামাজিক মাধ্যমে খিল্লি করতে পারেন! তাঁকে নিয়ে ট্রোল/ মিম বানাতে পারেন।
কিন্তু বাংলার রাজনীতিতে আর দ্বিতীয় আরেকজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে ওঠা অসম্ভব! একজন অজ্ঞাতকুলশীল থেকে ক্রমে ছাত্র নেত্রী, যুব নেত্রী থেকে সাংসদ- কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়ে পশ্চিমবঙ্গের সফলতম মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ওঠার কাহিনিটা যেকোনও দক্ষিণী থ্রিলার ছবিকেও হার মানাবে। যোগমায়াদেবী কলেজের ছাত্র নেত্রী থেকে বাংলা তথা দেশের রাজনীতির অবিসংবাদী নেত্রী হয়ে ওঠার ‘জার্নি’টাই তো আমাদের মতো মফস্বলের বাংলা মিডিয়ামদের আলাদা একটা অনুপ্রেরণা দিয়ে যায়৷ নেত্রীর একটা ডাকে কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার মিশে যায় ধর্মতলায়। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে দ্বিতীয় আর এমন কোনও নেতা বা নেত্রী আছেন কি না সন্দেহ, যিনি তাঁর ব্যক্তি ক্যারিশ্মায় এত দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির ময়দানে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রেখেছেন! সম্প্রতি ‘ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিনে’র ১৯৮৫-র অগাস্টে প্রকাশিত একটি বিশেষ সংখ্যা হাতে এসেছিল। সেই বিশেষ সংখ্যাটি ছিল ১৯৮৪’র লোকসভায় নবনির্বাচিত সাংসদের নিয়ে৷ সেখানে বেশ কয়েকজন নতুন সাংসদের সঙ্গে সঙ্গে বছর ২৭-এর এক যুবতীর নাম ও ছবি ছিল। যাদবপুর লোকসভার তৎকালীন সাংসদের। কালের নিয়মে সেই বিশেষ সংখ্যায় বাকি যাঁদের নাম-ছবি প্রকাশিত হয়েছিল তাঁরা প্রত্যেকে রাজনীতির ময়দান থেকেই হারিয়ে গিয়েছেন। রয়ে গিয়েছেন কেবল একজনই— তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এরকম প্রবল জনপ্রিয়তা ধরে রাখা ভারতবর্ষের রাজনীতিতে আর কোনও ব্যক্তিত্ব নেই! তিনি একজনই।
একুশে জুলাইয়ে ধর্মতলায় এলে বোঝা যায়, কেন তৃণমূল এতটা অপ্রতিরোধ্য! কত কত মানুষ। কেউ নেপালিতে কথা বলছেন, কেউ সাঁওতালিতে। কত কত রং। কতরকম সংস্কৃতি। কেউ এসেছেন পুরুলিয়ার লোকজ শিল্পের পোশাকে, কেউ কালিম্পং-কার্শিয়াং থেকে গোর্খাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পোশাকে। বিবিধের মধ্যে ঐক্যের সার্থক রূপ যেন এই একুশের সভাস্থল। সেখানে ঐতিহ্য আছে, পরম্পরা আছে, প্রেম আছে। কলেজের তরুণ-তরুণীদের উচ্ছ্বাস আছে। একুশ মানেই তো বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস! নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে নতুন কিছু গড়ে তোলা! দলনেত্রীর ছাত্র-যুবদের এগিয়ে আসার বার্তা! আর সেই বার্তা শুনে দ্বিগুণ উৎসাহে আমাদের বাড়ি ফেরা। একুশ শেখায় শহিদের তর্পণ। একুশ শেখায় দায়বদ্ধতা। একুশই শেখায় আগামীর ভবিষ্যৎকে! দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতিত্বে এই একুশ আরও একটা মাইলস্টোনের সামনে। প্রতিটা একুশে জুলাই আসলে নতুন ইতিহাস তৈরি করে! নয়া আখ্যান তৈরি করে।