‘যাঁর দৃষ্টিপাতে কোটি কৃষ্টি মাতে,/ যাঁর পদাঙ্গুলি নেয় সৃষ্টি তুলি,/ তাঁকে ভক্তিপাশে বাঁধো চিত্তাকাশে ।/নাও মন্ত্র গুরুর গাও মন্ত্র গুরুর।’
পূর্ণিমা চাঁদকে ক্ষুধার্ত কবি যতই আক্ষেপে ঝলসানো রুটি বলুন, পূর্ণিমা চাঁদ যেন সান্ধ্য আকাশে নিটোল গোল রুপোর থালা। আর মনের আকাশ জুড়ে আলো দেখানোর জন্য রয়েছেন গুরু। তাই গুরু আর পূর্ণিমা উভয়েই যেন অন্ধকার দূর করার জন্য এক অনন্ত আলোর উৎস। অন্ধকার দূর করে আলোকের ঝরনাধারায় মনকে ধুইয়েছেন গুরু আর বিশ্ব চরাচরকে স্নিগ্ধ আলোকিত করেছে পূর্ণিমার চাঁদ। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমাটি গুরুর নামে উৎসর্গীকৃত, এই পূর্ণিমার নাম গুরুপূর্ণিমা।
আরও পড়ুন-দিঘায় প্রবল জলোচ্ছ্বাস, ঘটছে আবহাওয়ার বদল
গুরুপূর্ণিমা সমাগতপ্রায়। এই প্রসঙ্গে জেনে নেওয়া প্রয়োজন গুরু কে? পূর্ণিমা কী? প্রথমটি যেন উপনিষদের পরাবিদ্যা আর দ্বিতীয়টি যেন অপরাবিদ্যা। পূর্ণিমা কী এক দু-কথায় বলা সম্ভব। যে-রাত্রে আকাশে গোল চাঁদ গোটাটা দেখা যায় সেটা পূর্ণিমা। কিন্তু গুরু কী, কে-ই বা গুরু? সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে একজন মানুষ যিনি অধ্যাত্ম্যবিদ্যায় পারদর্শী, পুজোপাঠ করেন। তিনি লোকের পছন্দমতো ইষ্ট দেবতার বীজমন্ত্র কানে দিলেন আর লোকে সেগুলো জপ করে একটু আধ্যাত্মিক হওয়ার লক্ষ্যে কিংবা শুধুই মন শান্ত রাখতে কিংবা অনেকসময় সংস্কারবশত। এক্ষেত্রে গুরুকরণ অনেকসময় বংশপরম্পরায় হয়— কুলগুরু। গুরুরও বংশ পরম্পরায় হয় শিষ্যকরণ। একই পরিবারের লোক বংশানুক্রমিকভাবে একই প্রতিষ্ঠানকে বেছে নেন দীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে। দীক্ষা হল, গুরুপ্রণামী দান হল, শিষ্য সকাল-সন্ধে জপ করেন। শিষ্য গুরুবাড়ি কিংবা গুরু শিষ্য বাড়ি গেলেন, গুরু পাওনা পাচ্ছেন, শিষ্য পাচ্ছেন মনের শান্তি। এটাই স্থূল অর্থে গুরু।
আরও পড়ুন-তথ্যচিত্রে কোলাজ-শিল্পী
আসলে গুরু শব্দের অর্থ গূঢ়… জীবনে যার গুরুত্ব আছে তিনিই গুরু। গুকারশ্চান্ধকারঃ স্যাদ্রুকারস্তেজ উচ্যতে/অজ্ঞান্ধ্বংসকং ব্রহ্মগুরুরেব ন সংশয়ঃ। গু শব্দের অর্থ অন্ধকার রু শব্দের অর্থ আলো। অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ যাঁর সাহায্যে তিনিই গুরু। গুরু পূর্ণজ্ঞান শিষ্য আধার। পূর্ণ্যস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে। পূর্ণ থেকে পূর্ণ নিলে পূর্ণই থেকে যায়। গুরু তো দিলেন জ্ঞান, কিন্তু আধার সঠিক না হলে সে থাকবে কী করে? গোটা পৃথিবী একজোড়া স্পেশাল গুরু-শিষ্য দেখেছে যাঁরা একে অপরের আদ্যন্ত পরিপূরক। গুরু শিষ্যকে কালী মানিয়ে ছেড়েছেন, শিষ্য গুরুকে বাজিয়ে অর্থাৎ পরীক্ষা করে তবে ছেড়েছে। পূর্ণব্রহ্ম গুরু, অনন্ত আধার শিষ্য।
আবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, ঈশ্বর একমাত্র গুরু, পিতা ও কর্তা। মানুষের কী সাধ্য অপরকে সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত করে! যাঁর এই ভুবনমোহিনী মায়া, তিনিই সেই মায়া থেকে মুক্ত করতে পারেন। সচ্চিদানন্দ গুরু বই আর গতি নাই। সচ্চিদানন্দই গুরু। যদি মানুষ গুরুরূপে চৈতন্য করে, তো জানবে যে, সচ্চিদানন্দ ওই রূপ ধারণ করেছেন। গুরু যেন সেথো, হাত ধরে নিয়ে যান। ভগবানদর্শন হলে আর গুরু-শিষ্য বোধ থাকে না। যদি ব্রহ্মজ্ঞান চাও তো আগে গুরুদক্ষিণা দাও। কেননা, ব্রহ্মজ্ঞান হলে আর গুরু-শিষ্য ভেদবুদ্ধি থাকে না।
গুরুর্ব্রহ্মা, গুরুর্বিষ্ণু, গুরুর্দেব মহেশ্বর/গুরুর্সাক্ষাৎ পরম ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরবে নমঃ। এখানে গুরুকে ব্রহ্ম বলা হল কেন? অজ্ঞান বা মায়া দ্বারা আচ্ছন্ন সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড। মায়ার আবরণ শক্তি আর বিক্ষেপ শক্তিতে চালিত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড। তাই এই অনির্বচনীয় শক্তি হল ব্রহ্মশক্তি। এই মায়া দ্বারা আবদ্ধ সকল মানুষ, তাকে মুক্ত করে কে! তাই যিনি সগুণ রূপে বদ্ধ করেছেন তিনিই জীবের প্রতি করুণাবশত নির্গুণ হয়ে জীবের বন্ধন মোচন করেন। নির্গুণ ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয় কিন্তু গুরুশক্তি সক্রিয়। তিনি গুরুরূপ ধারণ করে নিজে মুক্ত হলেন অন্যকে মুক্ত করবেন বলে।
আরও পড়ুন-উচ্চবর্ণের মত পোশাক পরায় মোদীরাজ্যে দলিত যুবককে বেধড়ক মারধর
এই বন্ধন প্রসঙ্গ ধরে আসে এক মজার গল্প। এক রাজার সংসারে বৈরাগ্য জন্মালে তিনি নিকটবর্তী এক সুপণ্ডিতকে ডেকে ভাগবত শুনতে শুরু করলেন। দুমাস একটানা শুনেও তার কোনও তত্ত্বজ্ঞান লাভ হল না। অথচ তিনি শুনেছিলেন যে মাত্র সাতদিন ভাগবত শুনে রাজা পরীক্ষিতের তত্ত্বজ্ঞান লাভ হয়েছিল। তাই রেগে গিয়ে ব্রাহ্মণের কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন। ব্রাহ্মণ পড়লেন বিরাট চিন্তায়। ব্রাহ্মণকে বিষণ্ণ দেখে তাঁর মেয়ে বাবাকে বলল— আমি কাল রাজাকে এর সঠিক কারণ বুঝিয়ে দেব। পরের দিন কন্যা রাজসভায় গিয়ে রাজার প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য তৈরি হলেন। একটি প্রহরীকে আদেশ করলেন দুটি থামে, একটিতে রাজাকে আর একটা থামে নিজেকে বাঁধতে নির্দেশ দিলেন। বাঁধা হলে কন্যা রাজাকে বললেন, এবার আপনি আমার বাঁধন খুলে দিন। রাজা বললেন এ কী করে সম্ভব! আমি নিজে বদ্ধ, কী করে তোমাকে মুক্ত করব? তখন ব্রাহ্মণকন্যা হেসে বললেন রাজা, এটাই আপনার উত্তর। রাজা পরীক্ষিত মুমুক্ষু শ্রোতা, বক্তা সাক্ষাৎ শুকদেব; সর্বত্যাগী ব্রহ্মপরায়ণ মহাজ্ঞানী। তাই পরীক্ষিত তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেছিলেন, মুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে পাঠক ব্রাহ্মণ সংসারাসক্ত, অর্থের প্রয়োজন শাস্ত্র ব্যাখ্যা করছে। বদ্ধ কেউ অন্যকে মুক্ত করতে পারে না। অর্থাৎ সদগুরু ছাড়া বন্ধন মোচন সম্ভব নয়।
এবার আসে কঠিন প্রশ্নের পালা। গুরু নির্বাচন কীভাবে হবে? গুরু হলেন এক অনন্ত শক্তির আধার। বাস্তবক্ষেত্রে সময় এই ধারণার সঠিক রূপায়ণ হয় না। কুলগুরু, বড় আশ্রমের এক সাধুবাবা সাধারণত হন দীক্ষাগুরু। তাঁর নির্দেশে শিষ্য জপ ধ্যান করে, কিছু শাস্ত্রকথা শোনে। এতে মানুষের মন কিছুটা ঈশ্বরমুখী হয় কিন্তু তত্ত্বজ্ঞানলাভ বা বিশেষ মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। তবে মানুষ কীভাবে গুরুকরণ করবে? এক্ষেত্রে মুমুক্ষু মানুষ ঈশ্বরের শরণাপন্ন হবে— ঈশ্বরের কাছে আকুলভাবে সদসৎ চেনার প্রার্থনা করবে। ঈশ্বর আকাশে পৌঁছবার সিঁড়ি হল গুরু, তাই সে সঠিক গুরু ঈশ্বরের কাছেই চেয়ে নেবে। এই আকুলতা প্রমাণ করবে আধারটির গুণমান। খাঁটি ভাল জিনিসটি চাইছি, রাখার জন্য আধারটিও খাঁটি হওয়া প্রয়োজন। গুরু-শিষ্য ঈশ্বর নির্ধারিত এক সম্পর্ক— তাই তিনি ঠিক আধারের ধারণক্ষমতা এবং গুণাগুণ অনুসারে গুরু নির্ধারণ করে দেবেন। শিষ্যের কাজ গুরুবাক্য অনুসরণ করে এগোনো। ‘যাঁর নির্দেশনা করে সত্যমনা,/ভাঙ্গে সঙ্কোচেরই মোহমুগ্ধ বেড়ি,/ তাঁর নৃত্যে কর তালি নৃত্য করো।/ধরো মন্ত্র গুরুর, স্মর মন্ত্র গুরুর।’
মা-বাবা দিলেন শরীর। তাই গুরুত্বের সিংহভাগ তাঁদের প্রাপ্য। সেই কারণেই মা-বাবা পরম গুরু। গুরু গঠন করলেন মন। যে কোনও বিদ্যা, পরা বা অপরা সবই আমরা শিখি অপরের সাহায্যে— এই শিক্ষদাতা সবাই সে অর্থে গুরু। গুরুবাক্যে বিশ্বাস রাখতে হবে, তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করতে হবে, তাঁর চরিত্র দেখা শিষ্যের কাজ নয়। ‘যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়, তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়’। ঝাড়ু অস্পৃশ্য হলেও সে স্থানকে শুদ্ধ করে।
আরও পড়ুন-মুম্বইয়ে ভেঙে পড়ল বহুতল, মৃত ১
যিনি আমাদের অন্তর শুদ্ধির দায়িত্ব নিয়েছেন, শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁকে উৎসর্গ করা হল আষাঢ়ের পূর্ণিমার দিনটি, গুরুপূর্ণিমা হিসেবে। সকল শিষ্যের এই দিনটি অবশ্য পালনীয়। জাগতিক গুরুর কাছে গিয়ে তাঁর চরণস্পর্শ করা, সাধ্যমতো সেবাদান, ভোগ নিবেদন করা শিষ্যের একান্ত কর্তব্য। কেউ অন্ন ইত্যাদি না খেয়ে, নিরামিষ খেয়ে দিনটি পালন করেন নিষ্ঠার সাথে। গুরুপূর্ণিমায় গুরুর পুজোর মাধ্যমে নিবেদিত হোক অন্তরের শ্রদ্ধা। জাগতিক গুরুর মাধ্যমে এই শ্রদ্ধা সঞ্চালিত হবে পরমগুরুর প্রতি। অন্য প্রান্ত থেকে আসবে মুক্তির নির্দেশ গুরুর মাধ্যমে।
পরমেশ্বর শিবের দক্ষিণামূর্তি রূপকে গুরুমূর্তি বলা হয়, সপ্ত ঋষি ও ব্রহ্মা-বিষ্ণু-সহ সমস্ত দেবতারা এই পূর্ণিমা তিথিতে মহাদেবের কাছে পরমজ্ঞান লাভ করেন, শিবকে আদিগুরু মানা হয়, তাই এটি গুরুপূর্ণিমা বলেই বিখ্যাত। বুদ্ধদেব তাঁর প্রথম এই পাঁচ শিষ্যকে বাণী দান করেছিলেন এক আষাঢ় পূর্ণিমার দিনে। বৌদ্ধগণ অষ্টাঙ্গিক মার্গ পালন করেন। এই দিনে তারা ‘বিপাসনা’ পদ্ধতির মাধ্যমে সাধনা করেন গুরু নির্দেশিত পথে। মহান ঋষি মহর্ষি বেদব্যাসের জন্মদিন এবং এই গুরুপূর্ণিমায় ব্রহ্ম সূত্র লেখা শুরু করেছিলেন। ব্যাস চারটি বেদও সম্পাদনা করেন এবং ১৮টি পুরাণ, মহাভারত এবং শ্রীমদ্ভাগবত রচনা করেন। তাই শিক্ষা জগতের পরম গুরুকে গুরুত্ব দিতে এই দিনটি মনে রাখা।
গুরুপূর্ণিমা পালন হোক সব জায়গায়, সব মানুষের মধ্যে, গুরু প্রণামের সাথে— ‘যখনই আসনে বসি যুক্ত করে/ আকুল ইচ্ছা জাগে ধ্যানের তরে,/ তখনই স্মরণে পড়ে তোমারই সে নাম।/ তোমাকে প্রণাম গুরু, তোমাকে প্রণাম।’