কুণাল ঘোষ: এই ঘটনা আগে একাধিকবার লেখা। মাননীয় বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় কমিশনের সাক্ষ্যতেও উল্লিখিত। তবু, মনে হল একটু লিখি।
১৯৯৩, ২১ জুলাই। রাজ্য যুব কংগ্রেস সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণ অবরোধ ডেকেছেন। আমি তখন একপ্রস্থ ছাত্র-যুব রাজনীতির পর সাংবাদিকতায়, সেসময় ‘আজকাল’ কাগজে। সেদিন এক চমৎকার ডিউটি পড়ল। চিফ রিপোর্টার শুভশঙ্কর ভট্টাচার্য আর আমার অ্যাসাইনমেন্ট সকাল থেকে মমতাদির সঙ্গে, তাঁর সারাদিন। কম বয়স, পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে, আমি বেশ উত্তেজিত।
আরও পড়ুন-আন্দোলনের ধাত্রীভূমি, একুশের ধর্মতলা
ঘটনার দিন সকাল সকাল ৩০বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে পৌঁছলাম শুভদা আর আমি। তখন তো মিডিয়ার সংখ্যা এত না। মমতা তখনও নিজের ঘরে। অফিস সামলাচ্ছেন অধুনা প্রয়াত একমেবাদ্বিতীয়ম মানিক মজুমদার। ল্যান্ডলাইন বাজছে অবিরাম। মানিক জরুরি খবর ইন্টারকমে জানাচ্ছেন মমতাদিকে।
উত্তেজনার আবহ ছিলই। সময় এগোতে দু’রকম খবর বাড়ল— ১) অবরোধের সব ক’টি পয়েন্টেই প্রচুর ভিড় বাড়ছে। ২) পুলিশ ও শাসক দল বহু জায়গায় বাধা দিচ্ছে, গন্ডগোল হচ্ছে। পুলিশই সমাবেশ ভেঙে দিতে নেমেছে।
একসময়ে বেরিয়ে এলেন ক্রুদ্ধ মমতাদি। রওনা হলেন কর্মসূচিতে।
প্রথমে মেয়ো রোড। একপ্রস্থ গোলমাল হয়ে গেছে, তবে রক্ত ঝরেনি। বিশাল জনতা। সমুদ্রে মোচার খোলার মতো ভাসমান একটি ম্যাটাডর মঞ্চ থেকে মানুষকে শান্ত থাকতে বলছেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। রয়েছেন মদন মিত্র। মমতাদিকে দেখে উত্তেজিত নেতা-কর্মীরা পুলিশের বিরুদ্ধে প্ররোচনা, গোলমালের নালিশ করলেন। জনতা-পুলিশ প্রায় মুখোমুখি। মমতাদি সভা চালিয়ে যেতে বলে অন্য স্পটগুলি ঘুরে আসতে গেলেন।
গন্তব্য ব্রেবোর্ন রোড, টি বোর্ড। পুরো যেতে হল না। গাড়ি তখন কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটে, উল্টোদিক থেকে একটি স্কুটারে চেপে এসে রাস্তা আটকালেন সৌগত রায়। বিধ্বস্ত, ধুতি প্রায় খোলা, মুখে আতঙ্ক। জানালেন, টি বোর্ডে তুলকালাম চলছে। সভা ভেঙে গেছে। সমর্থকরা মার খাচ্ছে।
উত্তেজিত মমতাদি গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলেন।
আরও পড়ুন-২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফল উপভোগ করার, কিন্তু আত্মতুষ্টি নয়: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
সে এক দৃশ্য। গাড়ি বন্ধ। মানুষ তাকিয়ে। খবর আর গুজবে অফিসপাড়া কাঁপছে। বাঁহাতে জিপিও আর ডানহাতে রাইটার্সকে রেখে মমতাদি নেতাজি সুভাষ রোড হয়ে ব্রেবোর্ন রোডের দিকে ঢুকলেন।
সামনে তখন রণক্ষেত্র। প্রবল হল্লা, আর্তনাদ। পুলিশ এবং সাদা পোশাকের কিছু লাঠিধারীর তাণ্ডব, গর্জন। ইটবৃষ্টি। মমতাদি তার মধ্যে গিয়ে পড়লেন। পরিস্থিতি হাতের বাইরে। পুলিশের একটা ঘেরাটোপ মমতাদিকে যেন টেনে নিয়ে গেল দলছুট করে, ফুটপাথের দেওয়ালের দিকে। ধস্তাধস্তি। মমতাদির চিৎকার। হঠাৎ এক পুলিশ বন্দুক তুলতে যেতেই মমতার তৎকালীন দেহরক্ষী, তিনিও পুলিশেরই, রিভলভার বার করে পাল্টা হুমকি দিলেন। কাজ হল। তখন দেহরক্ষী মাইতিদা রিভলভার বার না করলে ওরা মমতাদিকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিত। মমতাদিকে ঘেরাটোপ থেকে বার করে এনে শোয়ানো হল ট্রাফিক পুলিশের স্ট্যান্ডে। তিনি তখন প্রায় অচৈতন্য। তাঁকে ঘিরে সৌগত, অশোকা মণ্ডলরা।
এলাকা রণক্ষেত্র। ক্রমশ পুলিশের নিয়ন্ত্রণ। নানারকম শব্দ। সমর্থকরা ছত্রভঙ্গ। এপাশে পুলিশের বেতারবার্তায় নানা নির্দেশ। পুলিশ চারপাশ ব্যারিকেড করেছে। এলাকায় যেন বনধ।
১৯৯৩, ২১ জুলাই। রাজ্য যুব কংগ্রেস সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণ অবরোধ ডেকেছেন। আমি তখন একপ্রস্থ ছাত্র-যুব রাজনীতির পর সাংবাদিকতায়, সেসময় ‘আজকাল’ কাগজে। সেদিন এক চমৎকার ডিউটি পড়ল। চিফ রিপোর্টার শুভশঙ্কর ভট্টাচার্য আর আমার অ্যাসাইনমেন্ট সকাল থেকে মমতাদির সঙ্গে, তাঁর সারাদিন। কম বয়স, পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে, আমি বেশ উত্তেজিত।
ঘটনার দিন সকাল সকাল ৩০বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে পৌঁছলাম শুভদা আর আমি। তখন তো মিডিয়ার সংখ্যা এত না। মমতা তখনও নিজের ঘরে। অফিস সামলাচ্ছেন অধুনা প্রয়াত একমেবাদ্বিতীয়ম মানিক মজুমদার। ল্যান্ডলাইন বাজছে অবিরাম। মানিক জরুরি খবর ইন্টারকমে জানাচ্ছেন মমতাদিকে।
উত্তেজনার আবহ ছিলই। সময় এগোতে দু’রকম খবর বাড়ল- ১) অবরোধের সব ক’টি পয়েন্টেই প্রচুর ভিড় বাড়ছে। ২) পুলিশ ও শাসক দল বহু জায়গায় বাধা দিচ্ছে, গন্ডগোল হচ্ছে। পুলিশই সমাবেশ ভেঙে দিতে নেমেছে।
একসময়ে বেরিয়ে এলেন ক্রুদ্ধ মমতাদি। রওনা হলেন কর্মসূচিতে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
প্রথমে মেয়ো রোড। একপ্রস্থ গোলমাল হয়ে গেছে, তবে রক্ত ঝরেনি। বিশাল জনতা। সমুদ্রে মোচার খোলার মতো ভাসমান একটি ম্যাটাডর মঞ্চ থেকে মানুষকে শান্ত থাকতে বলছেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। রয়েছেন মদন মিত্র। মমতাদিকে দেখে উত্তেজিত নেতা-কর্মীরা পুলিশের বিরুদ্ধে প্ররোচনা, গোলমালের নালিশ করলেন। জনতা-পুলিশ প্রায় মুখোমুখি। মমতাদি সভা চালিয়ে যেতে বলে অন্য স্পটগুলি ঘুরে আসতে গেলেন।
গন্তব্য ব্রেবোর্ন রোড, টি বোর্ড। পুরো যেতে হল না। গাড়ি তখন কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটে, উল্টোদিক থেকে একটি স্কুটারে চেপে এসে রাস্তা আটকালেন সৌগত রায়। বিধ্বস্ত, ধুতি প্রায় খোলা, মুখে আতঙ্ক। জানালেন, টি বোর্ডে তুলকালাম চলছে। সভা ভেঙে গেছে। সমর্থকরা মার খাচ্ছে।
উত্তেজিত মমতাদি গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলেন।
সে এক দৃশ্য। গাড়ি বন্ধ। মানুষ তাকিয়ে। খবর আর গুজবে অফিসপাড়া কাঁপছে। বাঁহাতে জিপিও আর ডানহাতে রাইটার্সকে রেখে মমতাদি নেতাজি সুভাষ রোড হয়ে ব্রেবোর্ন রোডের দিকে ঢুকলেন।
সামনে তখন রণক্ষেত্র। প্রবল হল্লা, আর্তনাদ। পুলিশ এবং সাদা পোশাকের কিছু লাঠিধারীর তাণ্ডব, গর্জন। ইটবৃষ্টি। মমতাদি তার মধ্যে গিয়ে পড়লেন। পরিস্থিতি হাতের বাইরে। পুলিশের একটা ঘেরাটোপ মমতাদিকে যেন টেনে নিয়ে গেল দলছুট করে, ফুটপাথের দেওয়ালের দিকে। ধস্তাধস্তি। মমতাদির চিৎকার। হঠাৎ এক পুলিশ বন্দুক তুলতে যেতেই মমতার তৎকালীন দেহরক্ষী, তিনিও পুলিশেরই, রিভলভার বার করে পাল্টা হুমকি দিলেন। কাজ হল। তখন দেহরক্ষী মাইতিদা রিভলভার বার না করলে ওরা মমতাদিকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিত। মমতাদিকে ঘেরাটোপ থেকে বার করে এনে শোয়ানো হল ট্রাফিক পুলিশের স্ট্যান্ডে। তিনি তখন প্রায় অচৈতন্য। তাঁকে ঘিরে সৌগত, অশোকা মণ্ডলরা।
এলাকা রণক্ষেত্র। ক্রমশ পুলিশের নিয়ন্ত্রণ। নানারকম শব্দ। সমর্থকরা ছত্রভঙ্গ। এপাশে পুলিশের বেতারবার্তায় নানা নির্দেশ। পুলিশ চারপাশ ব্যারিকেড করেছে। এলাকায় যেন বনধ। ততক্ষণে খবর এসে গেছে মেয়ো রোড আর ধর্মতলা রক্তাক্ত। মৃত্যুর সংখ্যা মুখে মুখে বাড়ছে।
হঠাৎ দেখি একটি সাদা অ্যাম্বাসাডর অতি ধীরে ব্যাক করে মমতাদির দিকে যাচ্ছে। ডিসি এসবির গাড়ি, তখন মনে হয় কিরীটি সেনগুপ্ত। মনে হল, ওঁকে তুলে নিয়ে যাবে। শুভদাকে বললাম। একবার বেরিয়ে গেলে আর ধরা যাবে না। পুলিশ রাস্তা আটকে।
আরও পড়ুন-আজ জনসমুদ্র ধর্মতলা, সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিতেই হবে: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
অনুমানে জোর দিয়ে ছুটে বেরিয়ে আমাদের গাড়িটা উল্টোদিক থেকে ঢুকিয়ে নজর রাখতে রাখতেই তীব্র গতিতে বেরিয়ে এল সাদা গাড়ি, মমতাদিকে তুলে নিয়ে। সেটি রাইটার্স, জিপিও হয়ে গঙ্গার দিকে ছুটল। পেছনে শুধু আমাদের গাড়ি। পুলিশের দ্বিতীয় গাড়িও নেই। পুলিশ কোথায় নিয়ে যেতে চায়, জানি না। দলের কেউ গাড়িতে উঠতে পেরেছে কি না, বুঝছি না।
বাঁহাতে ফোর্ট উইলিয়ামকে রেখে গঙ্গার ধারে মারাত্মক কাণ্ড! সামনের সাদা গাড়ি এলোমেলো। চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে মমতাদি নামতে চাইছেন। কেউ টেনে ধরছে। ভিতরে স্পষ্ট ধস্তাধস্তি। এক সময়ে ব্রেক কষল গাড়ি। আলুথালু শাড়ির বিধ্বস্ত মমতা কোনওভাবে নামলেন। দেখি সৌগতদারা সঙ্গে, আর পুলিশ।
মমতাদি পুলিশের গাড়িতে যাবেন না। বলছেন, ওরা মেরে ফেলবে। এদিকে ওয়্যারলেসে খবর পেয়ে এসে পড়ছে আরও পুলিশ। হাতে সময় নেই।
এক পুলিশের বারণ সত্ত্বেও মমতাদিকে তুলে নিলাম আমাদের গাড়িতে। সামনে আমি। পিছনে শুভদা, সৌগতদাদের কোলে শায়িত প্রায় অচৈতন্য মমতাদি।
সৌগতদা বললেন, হাসপাতাল চলো।
মমতাদি ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, আমাকে মেয়ো রোড নিয়ে চলো।
গেলাম সেদিকে।
এবার আমাদের গাড়ি সামনে, পিছনে ক্রমবর্ধমান সংখ্যার পুলিশের গাড়ি।
মেয়ো রোড গিয়ে দেখি ভয়ানক অবস্থা। ততক্ষণে গুলিতে হতাহত বহু। পুলিশের লাঠিতে জখম অনেকে। আর্তনাদ চলছে। মমতার গাড়ি বুঝে জনতা এগিয়ে এল। অভিযোগ, উত্তেজনা, আর্তনাদে মমতাদি অচেতন হয়ে গেলেন। আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে পিজি হাসপাতাল রওনা হলাম। তার আগে গাড়িতে তুলে নিলাম লাঠি কিংবা ইটে মাথা ফাটা মিনতি অধিকারীকে। আমার পাশে বসালাম তাঁকে। ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। সেই রক্তে আমার কাঁধের দিকের শার্ট ভিজে লাল।
আরও পড়ুন-গুরু ও পূর্ণিমা
পিজিতে তখন হতাহতদের দেহ ঢুকছে। সামনে প্রবল উত্তেজনা। পিছনে উডবার্ন ওয়ার্ডের পাশের মাঠে মমতাকে নামানো হল। সোনালি রইলেন মমতাকে আগলে। সৌগত ছুটলেন সুপারের অফিস। আমি ছুটলাম বাবার কাছে, ডাঃ কল্যাণ কুমার ঘোষ তখন পিজির বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রধান। বাবা বললেন, এখানে ওঁকে রাখা ঠিক হবে না। প্রাইভেট হাসপাতালই এখন সবদিক থেকে ভাল। ফিরে এলাম। সৌগতদাও ফিরে এলেন সুপারের ঘর থেকে। একই বক্তব্য। এদিকে মমতাকে ওইভাবে দেখে ভিড় বাড়ছে। এখানে থাকা যাবে না।
অতঃপর আবার মমতাকে গাড়িতে তুলে রওনা হলাম উডল্যান্ডস। ততক্ষণে খবর পেয়ে আসতে শুরু করছেন নেতা-কর্মীরা, এবং বাড়ছে পুলিশও। শেষপর্যন্ত উডল্যান্ডসে যুব কংগ্রেস সভানেত্রীকে ভর্তি করা হল। ডাক্তাররা একটু স্থিতিশীল বলার পর অফিস ফেরার পালা।
………………………………….
আমি প্রত্যক্ষদর্শী। ঘটনাস্থলে ছিলাম। এতটাই কাছে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু, এবং শেষে পুলিশের গাড়ি থেকে ওঁকে আমাদের প্রেসের গাড়িতে নিয়ে উডল্যান্ডস হাসপাতালে ভর্তি করা পর্যন্ত ছিলাম।
বিচারবিভাগীয় কমিশন আমাকে ডেকেছিলেন। ২০১৩ সালে আমি সাক্ষ্য দিয়েছি সবিস্তার। বিচারপতি সেদিন নজিরবিহীনভাবে আমার সাক্ষ্যের প্রশংসা করেছিলেন প্রকাশ্যে।
এবার সামগ্রিক ঘটনার কারণ, পরিস্থিতি ও উপসংহারে কিছু কথা।
………………………………….
১) মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন যুব কংগ্রেস মহাকরণ অবরোধ ডেকেছিল। ভোটে সচিত্র পরিচয়পত্র চালু-সহ বেশ কিছু দাবিতে সমাবেশ। একাধিক পয়েন্ট থেকে মহাকরণমুখী পথ অবরুদ্ধ। সবচেয়ে বেশি গোলমাল মেয়ো রোড, ধর্মতলা, ব্রেবোর্ন রোডে। পুলিশের গুলিতে পরের পর মৃত্যু। লাঠি, গুলিতে জখম অনেক।
২) ঘোষিত ও বহু আলোচিত কর্মসূচি। এতে এত মানুষ আসবেন, আগাম অনুমান ও খবরে ব্যর্থ পুলিশ। স্পেশাল ব্রাঞ্চ এবং ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ায় সঠিক ব্যবস্থা ছিল না ভিড় সামলানোর। সরাসরি দায়ী ডিসি এসবি, আইবির কর্তা, নগরপাল, ডিজি, স্বরাষ্ট্রসচিব।
৩) সব জায়গায় মঞ্চ হলেও মেয়ো রোডে মঞ্চ করতে দেয়নি পুলিশ। যেকোনও বড় কর্মসূচিতে মঞ্চ একটা কৌশলী পথ। তাতে জনতা আর পুলিশের মাঝে মঞ্চ থাকে, সিনিয়র নেতারা থাকেন। মেয়ো রোড অত চওড়া রাস্তা। মঞ্চ দরকার ছিল। বারবার বলা সত্ত্বেও পুলিশ সেটা করতে দেয়নি। মাইকও ছিল না। একটি ম্যাটাডর মঞ্চ করা হয়, তা কোনও কাজে লাগেনি। পিছন দিকে ভিড় বাড়লে সেই চাপে জনতা এগোতে বাধ্য হয়। পুলিশ বাধা দেয়। মঞ্চ না থাকায় জনতা পুলিশ মুখোমুখি হয়ে যায়। মাইক না থাকায় পিছনের লোক কিছু বুঝতে না পেরে এগোতে যায়। চাপে সামনের ভিড় এগোতে বাধ্য হয়। পুলিশ লাঠি চালাতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একাধিক দফায় অশান্তি। এর জন্য দায়ী পুলিশের মঞ্চ করতে না দেওয়া। সরাসরি দায়ী পুলিশ কমিশনার, ডিসি হেড কোয়ার্টার, ডিসি সেন্ট্রাল। তাঁদের ভুল সিদ্ধান্ত, অন্যায় সিদ্ধান্ত, অপরিণামদর্শিতায় জনতাকে পড়তে হয়েছে পুলিশের মুখে।
৪) ব্রেবোর্ন রোডে ভিড় প্রত্যাশার থেকে বাড়ার পর নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে প্রথম লাঠি চালিয়ে উত্তেজনা ছড়ায় সিভিল ড্রেসে থাকা লাঠিধারী হেলমেটওয়ালা বাহিনী। এরা ডিডি থেকে আসা। মমতাদি আসার আগেই একপ্রস্থ গোলমাল হয়। মঞ্চ ভেঙে মাইকের তার কাটা হয়। মমতা যখন হেঁটে আসছিলেন, তখন এরা যে ভয়ঙ্কর চেহারায় মাটিতে ব্যাটিংয়ের ভঙ্গিমায় লাঠি ঠুকে অশ্রাব্য ভাষায় মমতাদিকে গালমন্দ করে না এগোনোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ভাবা যায় না। মমতা বাধা না মেনে গিয়ে পৌঁছলে তাঁকে ঘিরে ধস্তাধস্তি। দেওয়ালের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ তখন এমনভাবে মমতাকে মারার চেষ্টা করে যে তখন মমতার দেহরক্ষী মাইতিবাবু, তিনিও পুলিশেরই কর্মী, রিভলভার বার করে বাকি পুলিশদের হুমকি দেন। প্রায় অচৈতন্য মমতাকে টি বোর্ডের সামনে ট্রাফিক পুলিশ স্ট্যান্ডে এনে শোয়ানো হয়। ততক্ষণে দু’পক্ষের ইটবৃষ্টি, অন্য শব্দ আসছে। জনতা এসেছিল মমতার ভাষণ শুনতে। সেটা হলে কোনও গোলমাল হত না। তার আগেই সব ভেস্তে দেওয়া হল। সরাসরি দায়ী নগরপাল, ডিসি ডিডি, ডিসি সেন্ট্রাল।
৫) ধর্মতলাতেও গুলি, মৃত্যু। প্রত্যাশার বেশি লোক। লাঠি চালিয়ে সামাল দিতে গিয়ে বিপত্তি বাড়িয়েছে পুলিশ। দায়ী ডিসি ডিডি, ডিসি সেন্ট্রাল।
৬) পুলিশকর্তারা মহাকরণের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। স্বরাষ্ট্রসচিব সক্রিয় ছিলেন।
৭) সেদিন বোমা, বন্দুক নিয়ে মহাকরণ দখলের চেষ্টা সর্বৈব মিথ্যা। এর ন্যূনতম ভিত্তি নেই। এমনকী স্বয়ং মমতা যখন কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট হয়ে জিপিও বাঁদিকে রেখে নেতাজি সুভাষ রোডের দিকে হেঁটে গেছেন, চিৎকার করে বলেছেন, ‘‘ডানদিকে মহাকরণের দিকে কেউ তাকাবেন না। ওদের আমরা ঘেন্না করি।’’ বাস্তব হল, সেদিন তখন মমতা মহাকরণে ঢুকতে চাইলে আটকানো অসম্ভব ছিল। কিন্তু মমতা বা কেউ যাননি। পরে সরকার ও সিপিএম এই গল্প ছড়ায়।
৮) যুব কংগ্রেস কর্মীরা বোমা, গুলি চালায়নি। পুলিশ হাসপাতালে সেদিন এমন কোনও জখমের রেকর্ড নেই। গুলি, লাঠির মুখে জনতা ইট, বোতল ছুঁড়েছে। সেটা পুলিশও ছুঁড়েছে।
৯) পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা না নিয়ে সরাসরি শরীর লক্ষ্য করে গুলি চালায়। মৃতেরা কেউ সমাজবিরোধী নন। রাজনৈতিক কর্মী। গুলির জন্য দায়ী স্বরাষ্ট্রসচিব, নগরপাল, ডিসি সেন্ট্রাল, ডিসি সাউথ, ডিসি আরএফ এবং সংশ্লিষ্ট পয়েন্টে দায়িত্বে থাকা অফিসাররা। ধর্মতলায় ফায়ারিং অর্ডারের জন্য অপেক্ষা না করেই স্থানীয় সিদ্ধান্তে গুলি চলে। দায়ী পয়েন্ট ইনচার্জ, ডিসি সাউথ, ডিসি সেন্ট্রাল।
১০) জনতা সেদিন সংঘর্ষের মেজাজে ছিল না। পুরোদস্তুর রাজনৈতিক রোমাঞ্চ উপভোগের মুডে ছিল। মমতাদির প্ল্যান ছিল ঘুরে ঘুরে সব পয়েন্টে বক্তৃতা করা। বিশাল জমায়েতে উৎসাহিত ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর কর্মসূচি সফল না হতে দেওয়ার মারমুখী প্ররোচনা ছিল সকাল থেকে। মমতাদি বাড়ি থেকে বেরনোর আগে থেকেই ফোন আসতে থাকে সমাবেশমুখী জনতার গাড়ি, ট্রেন বাধা পাচ্ছে। অর্থাৎ সমাবেশে বিঘ্ন ঘটানোর পরিকল্পনার প্রতিফলন ছিল সকাল থেকেই। এই কাজে পুরোপুরি ব্যবহৃত হয় পুলিশ। এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। রাজনীতি ও প্রশাসনের সমন্বয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় স্বরাষ্ট্রসচিব, যিনি তাঁর রিপোর্টে আন্দোলনকারীদের উপরই দোষ চাপান, যা পুরোপুরি ভিত্তিহীন।
১১) গুলিতে গণহত্যার দায়িত্ব কেউ নিতে চাননি। কিন্তু কোন অফিসার কোন পয়েন্টের দায়িত্বে ছিলেন, বা মহাকরণ, লালবাজার থেকে কে কোঅর্ডিনেট করেছেন, সেটা স্পষ্ট। ফলে দায় তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন না। এটা লোকসংখ্যা না বুঝে পরিস্থিতি সামলাতে না পারা ; নাকি পরিকল্পিতভাবে দমনপীড়নে তখন উজ্জীবিত যুব কংগ্রেসকে ভয় পাইয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টা, তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে।
১২) সেদিন যদি সবক’টি সভা চলত ঠিকভাবে, কোনও গোলমাল হত না। সভা চলতেই দেওয়া হয়নি। মাইকের তার কাটা হয়েছে। মঞ্চের উপর দখল নিয়েছে ডিডির বাহিনী। প্রথমেই গোলমাল পাকিয়ে মাইকের তার কাটা হয়। ফলে নেতাদের কোনও কথা কেউ শুনতে পাননি। পিছনের ভিড় সামনে আসতে চেয়েছে। বিশৃঙ্খলা হয়েছে। নেতাদের আবেদন কাজ করেনি। পুলিশ বেধড়ক মেরে ভিড়কে ছত্রভঙ্গ করেছে। মেয়ো রোডে ম্যাটাডর মঞ্চ সমুদ্রে মোচার খোলার মতো হয়ে গেছিল। কর্মীদের প্রতি শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশ কেউ শুনতে পাচ্ছিলেন না। ভিড়ের চাপে জনতা এগিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশের মার শুরু। প্রথমে জনতার দিক থেকে আক্রমণ হয়নি কোনও পয়েন্টে। পরে ইট মেরেছে তারা। ব্রেবোর্ন রোড, ধর্মতলায় কিছু বোতল। অনুমান, স্থানীয় দোকান থেকে সংগ্রহ। আগে থেকে প্রস্তুতি ছিল না। ব্রেবোর্ন রোডে বোমার মতো শব্দ শোনা গেছে কিছু। সেটা কয়েকদফা গোলমালের পর। কোনও পুলিশের বোমার আঘাতের রেকর্ড নেই।
১৩) পুলিশের ভূমিকা হিংসাত্মক, আগ্রাসী, প্রতিহিংসাপরায়ণ। পুলিশ শুধু জনতাকে ছত্রভঙ্গই করেনি, পলায়নমান আতঙ্কিত জনতাকে তাড়া করে গিয়ে মূল জায়গা থেকে দূরেও গুলি, লাঠি চালিয়েছে। এটা পরিকল্পিত বা নির্দিষ্ট নির্দেশ ছাড়া হতে পারে না। গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে বা ময়দানে মাঠের মধ্যে যা হয়েছে, তা ভয়ঙ্কর।
১৪) মমতা বন্দোপাধ্যায়কে সভা করতে না দেওয়াটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। প্রতিটি জায়গায় গোলমাল হয়েছে মমতা যাওয়ার আগেই। মমতা প্রথম যান মেয়ো রোড। তখন একপ্রস্থ গোলমাল হয়ে গেছে। মমতা শান্তি রাখতে বলে রওনা দেন ব্রেবোর্ন রোড। ততক্ষণে গোলমাল, মঞ্চ তছনছ। পরে মমতা যান মেয়ো রোড। ততক্ষণে পুলিশের গাড়ি থেকে আমাদের গাড়িতে। পিছনে শোয়া, প্রায় অচৈতন্য। জেদ করে গেলেন। মেয়ো রোড তখন রক্তাক্ত, গুলিতে হত্যাপর্ব সাঙ্গ। এরপর পিজি হয়ে ওঁকে নিয়ে উডল্যান্ডস পৌঁছই। মমতা সেদিন সব মঞ্চে ঘুরে বক্তৃতা করে আগামী কর্মসূচি ঘোষণার প্রস্তুতি রেখেছিলেন। অথচ কোনও সভাই করতে পারেননি। এটি একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, যাকে কার্যকর করেছে পুলিশ।
১৫) কলকাতার বুকে এটি ছিল গণহত্যা। নন্দীগ্রামের থেকে কম না। অথচ, এর বিচার হল না। উল্টে বলা হল সমাজবিরোধীরা সশস্ত্র হামলা করে মহাকরণ দখল করতে যাচ্ছিল। মহাকরণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, পুরো মিথ্যা। এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারিগর স্বরাষ্ট্রসচিব মণীশ গুপ্ত। মমতা তো হাসপাতালে ভর্তি। বাইরে হাহাকার। নিহতদের পরিবার, আহতদের অসহায় পরিস্থিতি। সেদিন একজন বুদ্ধিজীবীও এগিয়ে আসেননি। তাঁরা বামঘেঁষা ছিলেন। অনেক পরে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের সময় তাঁদের একাংশের দেখা মিলল। অনেকে মমতাপন্থী হলেন পরিবর্তনের পর। সেদিন প্রকাশ্যে কলকাতায় এতবড় গণহত্যার পরেও নীরব দর্শক ছিলেন নাগরিক সমাজের বিদ্বজ্জনরা। আজ তাঁরা মমতাঘনিষ্ঠ। কেউ ছবি আঁকেন, কেউ অধ্যাপক, কেউ নাটক করেন, কেউ গান শোনান। সেদিন যখন গণহত্যা ধামাচাপা দিয়ে পাল্টা মহাকরণ দখলের গল্প ছাড়া হচ্ছিল, শহিদদের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ প্রতিবাদ করেননি। বিচারের দাবি তীব্রতর হয়নি। একা মমতাদি লড়ে গিয়েছেন, শহিদ পরিবারের জন্য যথাসম্ভব ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেছেন, আজও ২১ জুলাই শহিদ তর্পণ করে চলেছেন।