প্রতিবেদন : মিথ্যার বেসাতি প্রধানমন্ত্রীর। বিভ্রান্তি ছড়ানোর নিরলস অপচেষ্টা। বাজেটের প্রশংসা করতে গিয়ে বলে বসলেন, দেশের সর্বস্তরের মানুষ আরও শক্তিশালী হবে। মঙ্গলবার বাজেট ঘোষণার পরই নিজের পিঠ বাঁচাতে জাতির উদ্দেশে মিথ্যাচার শুরু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। তাঁর দাবি, এই বাজেট নতুন সুযোগ ও নয়া উৎসাহের। মধ্যবিত্তকে আরও শক্তিশালী করবে। গরিব মানুষের রোজগার বাড়বে। পাশাপাশি এই বাজেটে তরুণ প্রজন্মের সামনে আরও সুযোগ তৈরি হয়েছে। মোদির এই মিথ্যাভাষণের পর্দা ফাঁস করে দিয়েছেন বিরোধীরা।
এদিন বাজেট ঘোষণার পর বিরোধীদের চরম সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে মোদিকে। সেকারণেই বাজেট ঘোষণার পর তড়িঘড়ি ভাষণ দিয়ে নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর। যদিও বাজেট নিয়ে ভাঁওতাবাজি সামনে আসতেই এদিন সংসদে রীতিমতো বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা। আসল বিকাশের পর্দাফাঁস করে বিরোধীদের ক্রমাগত সাঁড়াশি চাপে প্রায় দিশাহারা অবস্থা মোদির। একযোগে মোদি সরকারের গাজোয়ারির প্রতিবাদ করে বুধবার থেকেই সংসদের উভয়কক্ষে ঝড় তোলার আগাম পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে তৃণমূল-সহ বিরোধীদের পক্ষ থেকে। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক এদিন বাজেট নিয়ে বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া—
আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় গণতন্ত্র হত্যা
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় : নীতীশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডুকে খুশি করার জন্যই এই বাজেট। যার ফলে অর্থনৈতিক বরাদ্দের যে অংশ ঘোষণা করা হয়েছে তার সিংহভাগই চলে যাচ্ছে বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশের দিকে। কিন্তু বাংলার ভাগ্যে মেলেনি কিছুই। পাশাপাশি আয়কর পরিকাঠামোয় যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তাতে গরিব মানুষদের লাভের লাভ কতটা হবে বলা মুশকিল কিন্তু বড়লোকদের সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে।
ডেরেক ও’ব্রায়েন : জিরো গ্যারান্টি, ব্যর্থ বাজেট। মূলত নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুর সমর্থন অক্ষুণ্ণ রাখতেই বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য দরাজ প্রধানমন্ত্রী। মোদি সরকারের লক্ষ্য কোনওভাবেই তাঁরা যেন ক্ষুব্ধ না হন, এতে আখেরে লাভ হবে বিজেপিরই।
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : এই বাজেট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অবস্থান বাঁচানোর লক্ষ্যে। এটি এনডিএর বাজেট, ভারতের জন্য নয়। গতবার এরা ওড়িশাকে অনেক প্রকল্প দিয়েছে। এখন সেখানে বিজেপি জিতেছে বিধানসভা নির্বাচনে, তাই ওড়িশার জন্যও কিছুই নেই। বাংলার জন্যও কিছুই নেই।
সুখেন্দুশেখর রায় : এই বাজেটের বেশি টাকাই চলে যাচ্ছে বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশে। কারণ দুটো গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নাহলে সরকার পড়ে যাবে। বিহার ও অসমে বন্যা পরিস্থিতি সামলাতে ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলা প্রতিবছর প্লাবিত হলেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সেদিকে নজর দিতে নারাজ মোদি সরকার। বিভিন্ন রাজ্যের কথা এদিন অর্থমন্ত্রী নির্মলার গলায় শোনা গেলেও বাংলার জন্য একটি শব্দও শোনা যায়নি অর্থমন্ত্রীর গলায়।
আরও পড়ুন-ফের বাজেটে ব্রাত্য চা-বলয়
সাকেত গোখেল : বাজেটে বাংলাকে বঞ্চনা করে একটি খোলাখুলি বৈষম্য সামনে আনা হয়েছে। কেন্দ্র বন্যা, ত্রাণ ও পুনর্গঠনের তহবিল থেকে শুধুমাত্র বাংলাকেই বাদ দিয়েছে! ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করে বাংলার মানুষকে আলাদা করে অন্য রাজ্যকে তহবিল দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে বিজেপির খারাপ ফলের জন্য এটি প্রতিশোধ ছাড়া আর কিছুই নয়।
সুস্মিতা দেব : বাংলার প্রায় ১.৬ লক্ষ কোটি টাকা গায়ের জোরে আটকে রেখেছে কেন্দ্র। আদমশুমারি না করে কীভাবে বাজেট অনুশীলন করা হল? এরপর মোদির বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলেন, বাজেটকে ঐতিহাসিক বলছেন, কিন্তু তিনি জানেন না জনসংখ্যা কত। ২০১১ সাল থেকে কোনও আদমশুমারি হয়নি। আপনি যদি সঠিক সংখ্যা না জানেন, তাহলে আপনি কীভাবে বাজেট তৈরি করবেন?
শত্রুঘ্ন সিনহা : বিহারকে যা দেওয়া হয়েছে, একজন বাসিন্দা হিসাবে ভাল লাগল৷ বিহারের জন্য এটির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাব এবং পশ্চিমবঙ্গের জন্য কী করেছেন? মোদিকে পাল্টা প্রশ্ন তৃণমূল সাংসদের।
শতাব্দী রায়: এদিনের বাজেটকে বিবিবি- বলে কটাক্ষ করেছেন শতাব্দী রায়। তিনি বুঝিয়েছেন এই বাজেট বিজেপি বিহার বাজেট। বাংলার জন্য কিছুই ঘোষণা হয়নি। এমনকী একবারের বেশি বাংলার নাম উচ্চারণও করেননি বলে মত শতাব্দীর।
ব্রাত্য বসু : জনবিরোধী সরকারের জনবিরোধী বাজেট। তার মধ্যে লক্ষণীয় হল বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকল্পকে ‘টুকলি’ করে পড়ুয়াদের উচ্চশিক্ষার জন্য ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রকল্পকে নকল করে করতে হয়েছে। টুকেছেন টুকুন, কিন্তু ঋণস্বীকারের সাহসটুকু দেখালে ভাল হত।
কুণাল ঘোষ : এটা দেশের বাজেট নয়, শরিকি দ্বন্দ্ব মেটাতে বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশকে ভোট দেওয়ার বাজেট। দেশের যে মূল সমস্যা, বেকারত্ব থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান, কৃষিক্ষেত্র, এই বাজেটে তার কোনও দিশা নেই। বাংলার যে প্রকল্পগুলো তার জন্য কোনও বরাদ্দই নেই। এই বাজেট যে রাজ্যগুলোর জন্য জোড়াতালি দিয়ে মোদি সরকার চলছে, তাদের খুশি করার বাজেট। বেকারত্ব ঘুচিয়ে কর্মসংস্থানের কোনও দিশা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এই বাজেটে দেখাতে পারেননি। শুধুই কথার জাগলারি, শব্দের জাগলারি আর সংখ্যার জাগলারি দিয়ে তিনি এটা ঢাকার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মোকাবিলা করা হবে, কীভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমানো হবে, তার কোনও দিশা এই বাজেটে নেই।
লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী, রাজ্যসভায় কংগ্রেস দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়্গে এবং অন্য বিরোধী সদস্যরাও মুখর হয়েছেন বাজেটের সমালোচনায়।
রাহুল গান্ধী: বিরোধী দলনেতা এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, এই বাজেট কুর্সি বাঁচাও বাজেট। শরিক দলগুলিকে খুশি রাখার বাজেট। রাহুল বলেন, বাজেটে ফাঁপা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মোদি সরকার। যার মূল্য চোকাতে হবে অন্য রাজ্যগুলিকে। কংগ্রেস সাংসদের অভিযোগ, শিল্পপতিদেরও মন রাখা হয়েছে এই বাজেটে ৷ সাধারণ মানুষের জন্য কোনও ছাড়ের কথা উল্লেখ নেই।
মল্লিকার্জুন খাড়গে : এটি একটি হতাশাজনক বাজেট। শুধুমাত্র সরকারের চেয়ার বাঁচানোর প্রচেষ্টা। ফসলের এমএসপি এবং কীটনাশক ভরতুকির জন্য যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ হয়নি। রেলে অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে, কিন্তু রেলপথের উন্নতি বা যাত্রী নিরাপত্তার দিকে নজর দেওয়া হয়নি।
শশী থারুর : তিরুবনন্তপুরমের কংগ্রেস সাংসদ বলেন, বাজেট দিশাহীন। সাধারণ মানুষের কোনও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুই এই বাজেটে নেই। ১০০ দিনের কাজ, সাধারণ মানুষের আয় সংক্রান্ত কোনও উল্লেখ নেই সেখানে। থারুর জানান, মোদি সরকার কর মকুবের নামে ভাঁওতাবাজি শুরু করেছেন৷
বাজেটে বাংলাকে বঞ্চিত করার প্রতিবাদে এদিন তৃণমূল সাংসদরা ওয়াক আউট করেন রাজ্যসভা থেকে। রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন, প্রবীণ সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় সহ তৃণমূল সাংসদরা মোদির বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। তারপরই একযোগে সভা ছেড়ে বেরিয়ে যান তাঁরা।