রাস্তা দিয়ে কাঁওয়ারযাত্রীরা যাবেন বলে স্থানীয় দু’টি মসজিদ ঢেকে দেওয়া হল সাদা কাপড়ে। একটি মাজারেও একই জিনিস করা হল। উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারের এই ঘটনায় রাজ্যের এক মন্ত্রীর সাফাই ‘সতর্কতা’র কারণেই কাঁওয়ার যাত্রার সময় ওই মজসিদ-মাজার সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। তবে এ নিয়ে আপত্তি জানান খোদ মসজিদ কর্তৃপক্ষ। সমালোচনার মুখে পড়ে ওই সাদা কাপড় পরে সরিয়েও নেওয়া হয়। মাঝেমধ্যে কাঁওয়ারযাত্রীরা এ সব ধর্মস্থানে বসে বিশ্রামও নেন। হরিদ্বারে মুসলিমরা বরাবর কাঁওয়ারযাত্রীদের স্বাগত জানিয়েছেন। এই সময় হরিদ্বারে মুসলিম এবং হিন্দুদের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় থাকে। এই প্রথম মুসলিমদের ধর্মস্থান এ ভাবে ঢেকে দেওয়া হল।
এটাই একমাত্র কুনাট্যদৃশ্য নয়। এই যাত্রাকে ঘিরে নাটক চলছে কিছুদিন ধরেই।
আরও পড়ুন-নীতি আয়োগের বৈঠকে কণ্ঠরোধ বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর! প্রতিবাদ তৃণমূলের
কিছুদিন আগে পর্যন্ত নাম ছিল ‘সঙ্গম শুদ্ধ ভোজনালয়’। যোগী আদিত্যনাথের পুলিশের নির্দেশের পর শনিবার থেকে সেই নাম বদলে ‘সেলিম শুদ্ধ ভোজনালয়’। ঘটনাস্থল মুজফ্ফরনগর, উত্তরপ্রদেশ।
খাতাউলি বাইপাসের ধারে লোকেশ ভারতীর ধাবা। নাম ‘সাক্ষী টুরিস্ট ধাবা’। সরকারি আধিকারিকরা ধাবায় এসে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তাঁর নাম ও ফোন নম্বর সমেত একটি ব্যানার ঝোলাতে হবে ধাবার বাইরে। সেই সঙ্গে ধাবার সব মুসলমান কর্মচারীকে ছাঁটাই করতে হবে অবিলম্বে। কাঁওয়ার যাত্রা চলবে ২২ জুলাই থেকে ২ অগাস্ট। ততদিন এই আদেশ কার্যকর থাকবে। নিটফল আগামী ১৫-২০ দিনের জন্য কাজ হারাতে হবে বেশ কিছু কর্মচারীকে। স্রেফ ধর্ম পরিচয়ের কারণে।
মহম্মদ ফুলবাহার মুজফ্ফরনগরে একটা ক্যাফে চালান। নাম ‘এনজয় ক্যাফে’। তাঁকে সরকারি আধিকারিকরা বলে গেছেন, অবিলম্বে ক্যাফের সামনে একটা ব্যানার ঝোলাতে হবে। তাতে তাঁর নাম লেখা থাকবে হিন্দিতে। তাঁর আশঙ্কা, এতে ‘ভাইচারা প্রভাবিত হোগা’। কিন্তু কীভাবে? ফুলবাহার বলছেন, এতদিন এসব বালাই ছিল না। এখন এসব ঝোলালেই লোকের মনে সন্দেহ জাগবে। তাঁরা ভাববেন, নির্ঘাৎ ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। তাই ক্যাফে মালিকের নাম পরিচয় অমন প্রকটভাবে বিজ্ঞাপিত করার প্রয়াস। এই আশঙ্কা থেকেই কাঁওয়ার যাত্রীরা আর ভিড় করবেন না তাঁর ক্যাফেতে।
ফি বছর কাঁওয়ার যাত্রার সময় বাবলি বেগম চলে আসেন হরিদ্বারের জওয়ালাপুরে। তাঁর বাড়ি কিন্তু উত্তরাখণ্ডে নয়, উত্তরপ্রদেশে। মিরাটের বাসিন্দা তিনি। ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান কিন্তু, শ্রাবণ মাসের কাঁওয়ার যাত্রার সময় যাত্রীরা দলে দলে কাঁওয়ার কেনেন তাঁর কাছ থেকে। এক একটা কাঁওয়ারের দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। তবে যাত্রীকে দেখে যদি গরিবগুর্বো মানুষ বলে মনে হয়, তবে তিনি ১০০ টাকাতেও বেচে দেন কাঁওয়ার। এবার আর অত বিক্রি হবে না। বিক্রিতে ভাটা পড়তে বাধ্য তাঁর ধর্ম পরিচয়ের কারণে। তাঁর মতো উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের অগণিত গ্রামীণ হস্তশিল্পী কাঁওয়ার তৈরি করে এই মরসুমে বিক্রি করে দুপয়সা বাড়তি রোজগার করেন। এবার সে পথ বন্ধ। সবারই ওই একই আশঙ্কা সরকারি নির্দেশিকার কারণে।
বাবলি বেগমের বয়স এখন ৪২ বছর। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ২০০৪-এ গঙ্গায় ডুবতে বসা ছয়জন বাচ্চাকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। সেজন্য রাজ্য সরকার তাঁকে সম্মানিতও করেছিল। বর্তমান রাজ্য সরকারের জারি করা ফতোয়াকে ঘিরে তাঁর আশঙ্কার কথা বলতে গিয়ে সে কথাটাও জানিয়ে দিতে ভুলছেন না বাবলি।
আরে ধর্ম তো অন্তরের শ্রদ্ধা ভক্তির বিষয়। কার দোকানে খেলাম, তাতে কী এসে যায়! মুসলমান দোকানদারদের অনেকের মাথাতেই ফেজ টুপি থাকে। দোকানের বাইরে পরিষ্কার করে লেখা থাকে ওই দোকানে কী ধরনের খাবার পাওয়া যায়, সেটা। সেই বিক্রীত খাবার ‘বিশুদ্ধ নিরামিষ’ হতে পারে, ‘ঝটকা’ হতে পারে, ‘কোশের’ হতে পারে, ‘হালাল’ হতে পারে। সুতরাং, কাঁওয়ার যাত্রীর পছন্দমতো খাবার বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা নেই। খাবার প্রস্তুতকারী বা পরিবেশনকারী হিন্দু না মুসলমান, মাংসাশী না নিরামিষভোজী, সেটা জানা না-জানায় কী আসে যায়! ভারতে সবচেয়ে বেশি মাংস রফতানি তো নিরামিষাশী হিন্দুরা করেন। তাঁরা ডাল ভাত খান বলে কি আমদানিকারী হিন্দুরা আপত্তি জানান? এসব যুক্তি দিচ্ছেন মুসলমান খাদ্য বিক্রেতারা, যাঁদের আশঙ্কা ধর্মীয় বিভাজনে উসকানি দিতেই বিজেপি সরকার ওই নির্দেশিকা জারি করেছে।
আরও পড়ুন-ফেডারেশনকে ভুল বুঝবেন না, বৈঠক শেষে বললেন স্বরূপ
এইসব বিতর্কিত ধর্মীয় বিভাজন মূলক পদক্ষেপের কারণে সুপ্রিম কোর্ট এর আগে জানিয়েছিল, কাঁওয়ার যাত্রার পথে কেউ যদি সদিচ্ছায় নিজের দোকানের বাইরে নাম-পরিচয় লিখতে চান, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু কাউকে জোরপূর্বক সরকারের নির্দেশ মানতে বাধ্য করা যাবে না। কাঁওয়ার যাত্রাকে কেন্দ্র করে উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড সরকারের নির্দেশিকা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। দুই রাজ্যের সরকারের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কাঁওয়ার যাত্রাপথে রাস্তার দু’ধারে যে সব খাবারের দোকান রয়েছে, সেই সব দোকানের বাইরে টাঙানো সাইনবোর্ডে দোকান মালিকের নাম-পরিচয় স্পষ্ট করে লিখতে হবে।
কাঁওয়ার যাত্রীরা গঙ্গা থেকে জল নিয়ে নিজ নিজ এলাকার শিব মন্দিরে গিয়ে বাবা ভোলনাথের মাথায় সে জল ঢালেন। বাঁকে করে জল নিয়ে যান তাঁরা। শিবভক্তদের কাঁধের বাঁকটাকে বলে কাঁওয়ার বা ভোলে। বাবলি বেগমদের মতো মুসলমান হস্তশিল্পীরা ওই কাঁওয়ার তৈরি করেন। মহম্মদ খলিল কিংবা ফুলবাহারের মতো মুসলমানরা কাঁওয়ার যাত্রীদের খাওয়া দাওয়ার জন্য পসরা সাজান। আসিফ রাহিররা ক্যাম্প বসিয়ে তাঁদের থাকার বন্দোবস্ত করেন। বহু মুসলমানকাঁওয়ার যাত্রীদের রাত কাটানোর জন্য তাঁবু ঘাটানোর কাজ করে দেন। শিবের ভক্তদের সহায়তার জন্য শৈব বা হিন্দু হওয়ার দরকার পড়ে না। থুড়ি, এতদিন পড়ত না।
কাঁওয়ার যাত্রা সংক্রান্ত সরকারি পদক্ষেপ যে কতখানি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য তুলে ধরা যেতে পারে একটি ঐতিহাসিক তথ্য। নাৎসি জার্মানি ও নাৎসি অধিকৃত ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর সময় জারি করা একটি ফতোয়ার কথা। হিটলার আদেশ দিয়েছিলেন ইহুদিদের পোশাকে ‘স্টার অব ডেভিড’ লাগাতেই হবে। হলুদ রঙের সেই তারকা চিহ্ন দিয়েই ভিড়ের মধ্যে চিনে নেওয়া যাবে ইহুদিদের। হলোকাস্টের আগে ইহুদিদের সনাক্ত করার জন্য এটাই ছিল হিটলারি চাল। হিটলার শাসিত জার্মানিতে এভাবেই ইহুদি ব্যবসাদারদের ভাতে মারার জন্য চালু হয়েছিল জুডেন বয়কট। সমাজের সর্বস্তরে ইহুদিদের কোণঠাসা করে ফেলাই ছিল সেসব পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য।
বর্ণবৈষ্ণম্য ও অস্পৃশ্যতার সামাজিক স্বীকৃতি এই ধরণের নির্দেশিকা। সে কথাটা ভালো করে বোঝার, চিৎকার করে বলার ও রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে বোঝানোর সময় কিন্তু এসে গেছে। এখনও যদি প্রতিবাদ না-করে গুটিয়ে থাকি, তাহলে বোধহয় বড্ড দেরি হয়ে যাবে।