দেশের রাজধানীর বুকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত, অবাঞ্ছিত, অপ্রত্যাশিত হয়ত নয় কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয়নীতি বিরোধী।
শনিবার দিল্লিতে নীতি আয়োগের বৈঠকে মাইক্রোফোন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বৈঠক বয়কট করে বেরিয়ে আসেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলার কণ্ঠস্বর আটকাতে চাইছে দিল্লি। একদিকে বাংলাকে আর্থিকভাবে বঞ্চনা করা হচ্ছে, অন্যদিকে বাংলার কথা শুনবে না বলে মাইক্রোফোন বন্ধ করে দিচ্ছে। বাংলার উন্নয়নের জন্য বিজেপি বিধায়কদের বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই। উল্টে বাংলার বিরুদ্ধে চলছে নানাভাবে চক্রান্ত।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের সঙ্গে দেখা করবে দল
সংসদ থেকে নীতি আয়োগ, সর্বত্র মোদি জমানায় গণতন্ত্রের অপর নাম বিরোধীদের মাইক্রোফোন বন্ধ করে দেওয়া! গত মাসেই লোকসভায় এর শিকার হয়েছেন স্বয়ং বিরোধী দলনেতা। নিট কেলেঙ্কারি নিয়ে তাঁর বক্তৃতার সময় মাইক্রোফোন বন্ধ করে দেন স্পিকার ওম বিড়লা। এবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল নীতি আয়োগের বৈঠকে। ‘ইন্ডিয়া’ শরিক দলগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। আর সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সামনে বাংলার বঞ্চনা নিয়ে সরব হওয়ামাত্র বক্তৃতার মাঝপথে তাঁর মাইক্রোফোন বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতিবাদে নীতি আয়োগের বৈঠক থেকেই ওয়াকআউট করেন ক্ষুব্ধ জননেত্রী। তবে তার আগে প্রধানমন্ত্রীর মুখের উপর বলে যান, ‘ইউ আর পলিটিক্যালি বায়াসড’, আপনি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। সত্যি কথা বলতে কী, বিষয়টা এবার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলা-সহ বিরোধী রাজ্যগুলিকে বাজেটে কিছুই দেওয়া হয়নি। স্রেফ দু’টি রাজ্যকে উপহার দিয়েছেন। এরপরেও নষ্টামি থামছে না। এখন বিরোধীদের মধ্যে একমাত্র জননেত্রী বৈঠকে যোগ দিলেও বলতে দেওয়া হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে অপমান করা হচ্ছে।
চন্দ্রবাবু নাইডুকে ২০ মিনিট বলতে দেওয়া হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে পাঁচজন মুখ্যমন্ত্রীকে ১৫-২০ মিনিট কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অথচ বাংলার নেত্রীকে পাঁচ মিনিটও বলতে দেওয়া হয়নি। মাইক বন্ধ করে তাঁকে অপমান করা হয়েছে। এ ধরনের বৈঠকে আর কোনওদিন যোগ দেবেন না বলে জানিয়েছেন বাংলার অগ্নিকন্যা। কিন্তু যে দৃষ্টান্ত স্থাপন হল সেটা নিশ্চিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ইতিবাচক কিছু নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বলেছেন, ‘আমি সব বিরোধীদের হয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম। আমার কথার মাঝে যদি বারবার বেল বাজিয়ে বন্ধ করতে বলো, তবে সেটা অপমান নয়? এখানে গণতন্ত্র কোথায়? বৈঠক ছেড়ে চলে এসে ঠিক করেছি।’ তাঁর বক্তব্য নিঃসন্দেহে যুক্তিপূর্ণ। তাতে কোনও ভুল নেই।
আরও পড়ুন-লজ্জা নেই! ভোটে হেরে ওরা বাংলা ভাগের চক্রান্ত করছে, ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী
কী বলতে চেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাতে মোদির এত গাত্রদাহ?
বৈঠকে আলোচ্য বিষয় ছিল ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭।’ সে সম্পর্কে লিখিত বক্তব্য আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকে সামান্য কিছু কথার পরই তাঁর বক্তৃতায় উঠে আসে বাংলার বঞ্চনার ইস্যু। ১ লক্ষ ৭১ হাজার কোটি টাকা বকেয়া। আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়িকে বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে ইন্দো-ভুটান নদী কমিশনের প্রস্তাব দেন মমতা। তখনই মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটাই কি তবে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো? একজন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কেন এই আচরণ? বাংলায় হারের জ্বালা এখনও ভুলতে পারছে না পদ্মপার্টি?
এই আবহে দাঁড়িয়ে মনে করিয়ে দিই, গ্রহের প্রতিটি গণতান্ত্রিক সভ্যতা বাক স্বাধীনতার ভিত্তির উপর নির্মিত। স্বাধীনভাবে কথা বলার এবং অন্যের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার স্বাধীনতা বাক স্বাধীনতার কেন্দ্রবিন্দু। এটি যুক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রাথমিক মানদণ্ড হিসাবে বিবেচিত হয়। এটিকে অন্যান্য সমস্ত স্বাধীনতার ‘‘মা” হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বা সীমাবদ্ধতা থেকে সুরক্ষিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক স্বাধীনতাগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯(১)(ক) বাক ও মত প্রকাশের এই মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি (ICCPR) অনুসারে, বাকস্বাধীনতার অধিকার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীনে স্বীকৃত, যেখানে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার (UDHR) অনুচ্ছেদ ১৯ মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা চারটি বিস্তৃত বিশেষ উদ্দেশ্যে কাজ করে—
(১) এটি একজন ব্যক্তিকে স্ব-তৃপ্তি অর্জন করতে সক্ষম করে;
(২) এটা বাস্তবতা উদ্ঘাটন এবং দাবির সত্যতা সাহায্য করে; এটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করার জন্য একজন ব্যক্তির ক্ষমতা বাড়ায়; এবং, সত্যের জ্ঞান এবং এর প্রকাশে সহায়তা করে।
(৩) এটা সমর্থন করে এবং একজন ব্যক্তির বিচার করার ক্ষমতা বাড়ায়; এবং
(৪) এটি সামাজিক সংহতি এবং সামাজিক রূপান্তরের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সমঝোতা করার জন্য একটি প্রক্রিয়া সরবরাহ করে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, নীতি আয়োগের বৈঠকে মাইক বন্ধ করে দিয়ে এই চারটি ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতা রচনা করা হল। এই কাজ কার্যত গণতন্ত্রকে হত্যা করার সমতুল্য। ভারতীয় সামাজিক কাঠামোর প্রত্যেককে তাদের নিজস্ব মতামত তৈরি করতে এবং অন্যদের কাছে প্রকাশ্যে প্রকাশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত শনিবার যেটা হয়েছে, সেটা এই সামাজিক পরম্পরার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
বাকস্বাধীনতার ধারণাটি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর শেষ বা ষষ্ঠ শতাব্দীর শুরুতে শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়। এটি ছিল রোমান প্রজাতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক আদর্শ। ইংল্যান্ডের বিল অফ রাইটস ১৬৮৯ বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করেছে। বিচারপতি ভগবতী, মানেকা গান্ধী বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া ১৬-তে বাক-স্বাধীনতার গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে বলেছেন যে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ মৌলিকভাবে নিরবচ্ছিন্ন বিতর্ক, আলোচনা এবং মুক্ত আলোচনার উপর দাঁড়িয়ে আছে, কারণ এটি একমাত্র ‘‘সরকারি পদক্ষেপের সংশোধনী” হিসাবে কাজ করে।
আরও পড়ুন-সন্দেশখালির উন্নয়ন খতিয়ে দেখতে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে যাচ্ছে প্রতিনিধি দল
একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র এবং একটি সুস্থ সমাজ দীর্ঘদিন ধরে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মূল্যায়ন করে আসছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য, এটি মৌলিক এবং অবিভাজ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। এটি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণতন্ত্র বলতে এমন একটি সরকারি ব্যবস্থাকে বোঝায় যা জনগণের জন্য, দ্বারা পরিচালিত এবং ফলস্বরূপ, গণতন্ত্র সাধারণ জনগণের হাতে, এবং স্বাধীন ও মুক্ত মতপ্রকাশের অধিকার রাষ্ট্রের সুস্থ কার্যকারিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাক-স্বাধীনতার অধিকার এমন একটি হাতিয়ার যা মানুষকে নিছক পশু হিসেবে না থেকে মর্যাদায় বাঁচতে দেয়। বলা হয়েছে, স্বাধীন ও নিরবচ্ছিন্ন বাক ও মত প্রকাশের সুযোগ না থাকলে গণতন্ত্র অর্থহীন।
এই কথাগুলো মোদি জানেন না তা নয়। আর জানেন বলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কথা বলতে দিতে ওঁদের এত আপত্তি!