তরুণ মজুমদারের ‘চাঁদের বাড়ি’। মুক্তি পেয়েছিল ২০০৭-এ। প্রায় সতেরো বছর আগে। দেখানো হয়েছিল বাঙালি যৌথ পরিবারের ছবি। তৈরি হয়েছিল সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্তর কাহিনি অবলম্বনে। পেয়েছিল দর্শকদের অকুণ্ঠ ভালবাসা।
বিভিন্ন প্রজন্ম। ছিল ভাবনাচিন্তার তারতম্য। একদল প্রাচীনপন্থী। আরেকদল আধুনিক মনস্ক। ছিল দ্বন্দ্ব। সেইসঙ্গে ছিল পরস্পরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসা। যাঁরা এক ছাদের নিচে থাকতেন, তাঁরা তো বটেই, যাঁরা দূরে থাকতেন, তাঁরাও এক সুতোয় বাঁধা। উৎসব অনুষ্ঠানে মহামিলন ঘটত। প্রাণে জাগত আনন্দের ঢেউ। এই যৌথ পরিবার দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক সভ্যতায় থাবা বসিয়েছে ফ্ল্যাট কালচার। তৈরি হয়েছে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। তার মধ্যে থাকতে থাকতে কখনও যে কারও দমবন্ধ হয়ে আসে না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু উপায় নেই। বদলে গেছে পরিবেশ, পরিস্থিতি। বহু মানুষ নস্টালজিয়ায় ডুব দেন। মনে মনে ফিরে যান, মিশে যান যৌথ পরিবারে। এক সঙ্গে বাঁচা, সুখ ও দুঃখ ভাগ করে নেওয়া। কী সুন্দর ছিল দিনগুলো! ভাবলেই বুকের বাঁদিকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তাই তো বারবার কড়া নাড়তে ইচ্ছে করে ‘চাঁদের বাড়ি’র দরজায়।
যৌথ পরিবারের সেই চিরচেনা ছবি পর্দায় ফুটে উঠবে আবারও। সিনেমায় নয়, এবার টেলিভিশনে। প্রচেত গুপ্তর গল্প নিয়েই তৈরি হচ্ছে নতুন ধারাবাহিক ‘মধুর হাওয়া’ (Madhur Hawa)। এই ধারাবাহিকে কি ‘চাঁদের বাড়ি’র ছোঁয়া পাওয়া যাবে? প্রচেত গুপ্ত জানালেন, ‘অবশ্যই পাওয়া যাবে। গল্প তৈরি হয়েছে আধুনিকতার প্রেক্ষাপটে। দেখানো হয়েছে, এখনকার যৌথ পরিবার ঠিক কীরকম। আছে অনেক মজা। অনেক আনন্দ। টুকরো টুকরো ঘটনা। ছোটখাটো মান-অভিমানের পাশাপাশি আছে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে অনেক কিছুই। তবে সম্পর্কের বাঁধনটা রয়ে গেছে আগের মতোই অটুট।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা ছিল একটা ছোট গল্প। বহুদিন আগে লেখা। আলোচনা করে চিত্রনাট্যে কিছু বদল আনা হয়েছে। মুক্তি পেয়েছে ট্রেলার। আমার বেশ ভাল লেগেছে। আশা করি ধারাবাহিকটি দর্শকদের ভাল লাগবে।’
পরিচালনা করছেন অনিন্দ্য সরকার। গড়িয়ার একটি স্টুডিওয় জোরকদমে চলছে শ্যুটিং। কাজের ফাঁকে তিনি জানালেন, ‘এখন ডিজিটাল যুগ। ওয়েবসিরিজ নিয়ে হইহই হচ্ছে বেশি। দর্শকেরা সিনেমা সিরিয়াল দেখছেন তুলনায় কম। থ্রিলার, উত্তেজনা, রোমাঞ্চকর গল্পই তাঁদের আকৃষ্ট করছে। তবে কেউই মূল শিকড়টা ভোলেননি। এখনও বহু মানুষ পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালবাসেন। দলবেঁধে মেতে ওঠেন দুর্গাপুজোয়। গুরুজনদের প্রণাম করেন। কেউ কেউ আধুনিকতার কথা বলেন। এই আধুনিকতা কিন্তু কৃত্রিম। মনে মনে আজও কিন্তু বহু মানুষ আটপৌরে। তাঁদের মনের কোণে উঁকি দিয়ে যায় যৌথ পরিবার। ছোটখাটো মান-অভিমান, ভালবাসা নিয়েই একটা যৌথ যাপন। সেই যৌথ যাপন, যৌথ পরিবারের আনন্দঘন ছবি দর্শকদের সামনে তুলে ধরার জন্যই প্রচেত গুপ্তর ‘মধুর হাওয়া’ গল্পটি আমরা নির্বাচন করেছি। ঝোড়ো বাতাস নয়, প্রতিটি দৃশ্যে বইতে দেখা যাবে মধুর হাওয়া। পুরনো শিল্পীদের পাশাপাশি এই ধারাবাহিকে দেখা যাবে একঝাঁক নতুন মুখ। সবাই মিলে খুব মজা করে কাজ করছি।’
কী আছে গল্পে? উত্তর কলকাতার সান্যাল বাড়ির কর্তা নীহাররঞ্জন সান্যাল। আশি বছরের মানুষটি রীতিমতো প্রাচীনপন্থী। কানন দেবীর ভক্ত। এখনও ঘরের দেয়ালে কাননের ছবি সাজিয়ে রেখেছেন। বাজান কাননের পুরনো গানের রেকর্ড। তাঁর স্ত্রী কিরণময়ী। কাঁচা বয়সে কিরণময়ীর কণ্ঠে কাননের গান শুনেই মুগ্ধ হয়েছিলেন নীহাররঞ্জন। শুধু কি তাই? ফুলশয্যার রাতে স্ত্রীর নাম বদলে কানন রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিরণময়ী বেঁকে বসেন। নীহাররঞ্জন তখন বাধ্য হয়ে নিজের বাড়ির নাম রাখেন ‘কিরণ কানন’।
আরও পড়ুন-প্রতিবাদে উত্তাল দিল্লি, বন্ধ করা হল মাইক্রোফোন, ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ
বয়স হয়েছে দুজনের। আজও তাঁদের দাম্পত্যজীবনে সতীন-কাঁটা হয়ে রয়েছে কানন দেবী নামটি। নীহাররঞ্জন ও কিরণময়ীর মধ্যে তুমুল ঝগড়াঝাটি হয়। তার মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে এক মিষ্টি-মধুর প্রেমের সম্পর্ক। তাঁদের দুই সন্তান নিরঞ্জন ও নীহারিকা। নিরঞ্জন বাংলার শিক্ষক। তাঁর স্ত্রী কল্যাণী। এঁদের চার সন্তান। বড় ছেলে কুণাল, মেজ ছেলে মনোজ, ছোট ছেলে বিজয় আর একমাত্র মেয়ে বনলতা। নাতনি বনলতা নীহাররঞ্জনের নয়নের মণি। আর আছেন কুণাল ও মনোজের স্ত্রী সুজাতা, পাপিয়া ও দুই খুদে সদস্য সুজাতা-কুণালের মেয়ে ও ছেলে পায়েস আর সন্দেশ। চার প্রজন্ম থাকেন একই বাড়িতে। এক সঙ্গে। যদিও তাঁরা আলাদা আলাদা আদর্শে বিশ্বাসী। তবু সবাই জড়িয়ে থাকেন সুন্দর সম্পর্কে। সবমিলিয়ে এক মিষ্টি যৌথ পরিবার। স্বপ্নের পরিবার।
নীহাররঞ্জনের চরিত্রে অভিনয় করছেন অরিজিৎ গুহ। কিরণময়ীর চরিত্রে গোপা নন্দী। অন্যান্য চরিত্রে দেখা যাবে শুভাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, মৌসুমি চক্রবর্তী, শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈকত দাস, শতাব্দী নাগ, রিয়া দাস, স্বরূপ দে, আয়ুশ্রী মুখোপাধ্যায়, শ্রেয়সী বিশ্বাস, ডেভিড মিত্র, প্রীতম দাস, মন্টু দাস, অর্না ধর, জয়িত্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, শেখর পালকে। চিত্রনাট্য লিখেছেন রাকেশ ঘোষ। আকাশ আট চ্যানেলে, ৫ অগাস্ট থেকে, সোম-শনিবার, সন্ধে সাতটায় সম্প্রচারিত হবে ‘মধুর হাওয়া’ (Madhur Hawa)। এই ধারাবাহিক সপরিবারে দেখার মতো।