আবার বাংলা ভাগের কথা হচ্ছে। যথারীতি এই অলীক প্রস্তাবটি এসেছে বিজেপি সাংসদদের কাছ থেকে। বিজেপির একজন সাংসদ মুর্শিদাবাদ, মালদহ এবং বিহারের ৩টি জেলা নিয়ে কেন্দ্রশাসিত রাজ্য করার প্রস্তাব দিয়েছেন সংসদে। এখানে নাকি মুসলমানরা হিন্দুদের উপর অত্যাচার করছে। সুতরাং ‘হিন্দু বাঁচাও’। আর একজন বিজেপি সাংসদ ও মন্ত্রী প্রস্তাব দিয়েছেন উত্তরবঙ্গকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে। এই দু’টি বক্তব্যের পর বিজেপির সাংসদ ও বিধায়করা নিজের মতো করে যার যে মত পছন্দ অথবা অপছন্দ তার পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আর বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও দিল্লির জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘জল মাপছেন’। মখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন।
আরও পড়ুন-তৈরী বন্যা পরিস্থিতি, ‘আলোচনা ছাড়াই এই জল ছেড়েছে ডিভিসি’, দাবি আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের
বাংলা ভাগের কথা হলেও ১৯০৫ সালের কথা মনে পড়ে। জর্জ কার্জন বাংলা প্রভিন্স ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখনও ‘লর্ড’ হননি। দুটি কারণ দেখালেন বাংলা ভাগের। প্রথম, এলাকা হিসাবে বিশাল বড়। বাংলা, বিহার, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ ও অসমের কিছু অংশ নিয়ে বাংলা ছিল। ১.৭৯ লক্ষ বর্গ মাইল। দ্বিতীয় কারণটি ছিল, বিশাল জনসংখ্যা। প্রায় ৮ কোটি। প্রশাসনিক কারণে বাংলা ভাগ দরকার বলে ইংরেজরা মনে করেছিল। তারা খোলাখুলিভাবে এটা বলেছিল। ভিতরে ছিল অন্যরকম। বাংলা ভাগ হল। সারা বাংলা জুড়ে প্রতিবাদ হল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ রাস্তায় নামলেন। ‘বাংলার জল, বাংলার ফল, বাংলার বায়ু— পুণ্য হউক পুণ্য হউক— হে ভগবান।’ গান গেয়ে তিন রাস্তার ধারের সবাইকে রাখি পরাতে লাগলেন। যাত্রাপথে মুসলমান গাড়োয়ানদের রাখি পরালেন। সবাই অবাক! হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ ঢুকে গেলেন নাখোদা মসজিদে। সেখানকার ইমাম সাহেবকে রাখি পরাতে গেলেন। প্রথমে ইমাম একটু ইতস্তত করলেও পরলেন। রবীন্দ্রনাথের শোভাযাত্রায় তখন উৎসাহের বন্যা বইছে। বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে গড়ে উঠল হিন্দু-মুসলমান ঐক্য। সেই সময় বাংলার মুসলমান নেতাদের বড় অংশ নবাব সলিমুল্লাহ, ব্যারিস্টার আব্দুর রসুল, খাজা আতিকুল্লাহ, ইউসুফ বাহাদুর, লিয়াকত হোসেন বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিলেন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্যে প্রতিবাদ সভা হয় বরিশালে। উদ্যোক্তা ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল। বাঙালির ঐক্য ও বিদ্রোহ দেখে কার্জন সাহেব প্রমাদ গুনলেন। তিনি পৌঁছে গেলেন ঢাকাতে। আহাসান মঞ্জিলে সভা করলেন নবাব মল্লিমুল্লাহর সঙ্গে। একটার পর একটা টোপ। ঢাকাকে নতুন শহর হিসাবে গড়ে তোলা হবে। ঢাকাতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হবে। মুসলমানদের সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে। টোপটা গিললেন নবাব সাহেব। যোগ দিলেন বঙ্গভঙ্গের পক্ষের আন্দোলনে। ভাগ করা ও শাসন করাতে ইংরেজ বরাবর পটু। এক্ষেত্রেও সফল হল তারা। তাদের পরামর্শেই ১৯০৬ সালে ঢাকার সম্মেলন থেকে মুসলিম গর্বিত হল। ঠিক ওই সময়েই তৈরি হল হিন্দু মহাসভা।
তবু বৃহত্তর বাঙালি বঙ্গভঙ্গ মানেনি। ১৯১১ সালে আবার বাংলা যুক্ত হল। তবে ভূগোল অনেকটা পাল্টে গেল। আর দেশের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লি চলে গেল। বাংলার প্রতিবাদ, আন্দোলন দেখে ইংরেজ ভয় পেয়েছিল তা বলাই বাহুল্য।
আজকের পরিস্থিতি একেবারে আলাদা। দেশ স্বাধীন। আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। বাংলার মানুষের গর্জন দিল্লির মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছে, এ ব্যাপারে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপির সাংসদদের কথাগুলো ভাবা যায়। বাংলাতে যে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য আছে সেটা তাদের পছন্দ হচ্ছে না। এই কারণে বাংলায় তারা আসর গেড়ে বসতে পারছে না। সুতরাং প্রধান কাজ হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করো। হিংসা ছড়াও। যেমন অতীতে ইংরেজ শাসকরা করেছিল। সেই কারণে ৫টি মুসলমান অধ্যুষিতকে নিয়ে কেন্দ্রীয় শাসিত রাজ্য করার প্রস্তাব আছে। মুর্শিদাবাদ মালদহের মানুষ ব্যাপকভাবে ভোট দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে বিধানসভা, পুরসভা, পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদে ৩টি তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে। মালদহে তৃণমূল কংগ্রেস আসন পায়নি কিন্তু প্রচুর মানুষের সমর্থন পেয়েছে। মালদহে তৃণমূল কংগ্রেস আসন পায়নি। কিন্তু প্রচুর মানুষের সমর্থন পেয়েছে। মুসলমান অধ্যুষিত দুটি জেলাতে মুসলমানরা তৃণমূলকে ভোট ব্যাপকহারে দিয়েছে বলেই এমন ফলাফল হয়েছে। বিজেপির কাছে এটাই শিরঃপীড়ার কারণ। সুতরাং ভাগ করো। হিংসা ছড়াও। মুসলমানদের প্রান্তিক কর ফেল। যেমন বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে তারা করতে শুরু করেছে। যেমন করেই হোক তৃণমূলের অগ্রগতি ঠেকাতে হবে। এই লোকসভা নির্বাচনেও আসন বাডি়য়ে ২৯টি হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের। বিজেপির হাফডজন কমে হয়েছে ১২টি। আর ভূগোলের কথা বলা খুবই উচিত হবে। উত্তরবঙ্গকে উত্তর-পূর্ব দিকে রাজ্যগুলির মতো দেখতে। এখানে আছে বিজেপির হিন্দু-মুসলমান খেলা। কারণ মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর ৩টি মুসলমান আধিক্যের জেলা সেই ফাঁকে পডে় যাবে। বিজেপি’র শাসনে ও শোষণে সুবিধা হবে।
আরও পড়ুন-জলে ভাসছে ২০ হাজার কোটির সংসদ ভবন! ফের কেন্দ্রকে তোপ তৃণমূলের
বিজেপি বরাবর রাজ্য ভেঙে ছোট রাজ্য করার পক্ষে। তাতে তাদের সুবিধা হবে। তারাই উদ্যোগ নিয়ে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহারকে দু’টুকরো করেছে। দেশের প্রচলিত সমস্ত সভ্যতা ভব্যতা এবং সংবিধানকে পদদলিত করে এই কাজটা করা হয়েছে। রাজ্য ভেঙে সুফল হয়েছে কেউ বলতে পারে না। বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ তো পাচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশ ও বিহার। তেলেঙ্গানা বা ঝাড়খণ্ডের কথা তো শুনিনি! দুটো রাজ্যই বিজেপি’র হাত ছাড়া। একটা কংগ্রেস, আর একটা হেমন্ত সোরেন।
বাংলায় তাহলে বিজেপি’র উদ্দেশ্য কী? অন্য রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে যেমন এখানেও তাই। দার্জিলিং-এর সাংসদকে দিয়ে বিচ্ছিন্নতার দাবি তোলা হচ্ছে। কোচবিহারে গ্রেটারের গল্প বিজেপি সামনে নিয়ে এসেছে। বাংলা যে শান্তিতে আছে এবং এটা অবশ্যই বিজেপি’র বাড়া ভাতে ছাই পডে় গেছে তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই। তাই তৃণমূল কংগ্রেসের অগ্রগতিকে ঠেকাতে নতুন নতুন কৌশল তাদের আবিষ্কার করতে হচ্ছে। বাংলাভাগ করা এমনই একটা আবিষ্কার। সমস্যা হচ্ছে এই করতে বিজেপি একটা সাম্প্রদায়িক খেলা খেলতে শুরু করেছে। বাংলার ও বাঙালির ঐতিহ্য এবং বাঙালির সংগ্রামী অতীত সম্পর্কে তাদের জানাবোঝা একেবারেই নেই। সেই কারণে অর্বাচীনের মতো অলীক প্রস্তাবগুলো সামনে এনেছে। প্রায় ইংরেজ শাসকদের মতো। যাঁরা ভেবেছিলেন বাঙালিকে হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করলেই কেল্লা ফতে। হয়নি। হতে পারে না। এ-বাংলার আপামর নারী-পুরুষের হাতে রবীন্দ্রনাথের ঐক্য-রাখি বাঁধা আছে। কাজী নজরুলের অগ্নিবীণা হাতে আছে। কুৎসিত চক্রান্ত পরাজিত হবে। কোনও সংশয় নেই।