‘সেদিন সুরেন ব্যানার্জি রোডে নির্জনতার সঙ্গে দেখা হল।
তাকে বলি : এই তো তোমারই ঠিকানালেখা চিঠি, ডাকে দেব, তুমি
মনপড়া জানো নাকি? এলে কোন ট্রেনে?’
(রাক্ষস / উৎপলকুমার বসু)
আরও পড়ুন-ইজরায়েলে ভারতীয়দের প্রতি সতর্কবার্তা
কোনও এক ঘোরতর অসুখের দিনকালে এই কবিতার সঙ্গে পরিচয়। উৎপলদা, কবি উৎপলকুমার বসুর সঙ্গে পরিচয় আরও আগে। লেখালেখির, বিশেষত কলকাতায় থিতু হওয়ার গোড়ার দিকে। কবিতা পড়া, শোনা, অথবা নিছকই আড্ডার লোভে কলকাতার কাছে-দূরে ঘুরে বেড়াচ্ছি যখন, ঠিক মনে নেই, সম্ভবত চন্দননগরে দেখি প্রথম উৎপলদাকে। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ আর সেই বিখ্যাত ঢোলা পাজামা, যার টেলরের নাম ও ধাম নিয়ে গোটা বাংলাবাজার দ্বিধাবিভক্ত ছিল একসময়। মনে আছে, বনগাঁয় ‘বাল্মিকী’ নামে একটা ছোট পত্রিকা করতেন লালমোহন বিশ্বাস। মাঝেমধ্যেই কবিতা পড়তে ডাকতেন। আমরা দল বেঁধে যেতাম। তখন কখনও দেখা হত উৎপলদার সঙ্গে। একসঙ্গে চা খাওয়া, গল্প হত। যত না কবিতা নিয়ে, আরও বেশি আটপৌরে কথাবার্তা, কোথায় থাকি, কীভাবে ফিরব, এসব। কখনও বা একদম চুপ। একা একাই ঘুরে বেড়াতেন। ভারি আশ্চর্য লেগেছিল আমার এই সদাহাস্যময় মানুষটিকে। বইমেলায় দেখতাম ঘুরে বেড়াচ্ছেন লিটল ম্যাগাজিনের স্টলে, আড্ডা দিচ্ছেন অসমবয়েসি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। তখনও পড়িনি তাঁকে সেভাবে। শুধু জানি, বড় কবি। খুব বড় কবি। পরে পড়তে বসে এটুকু বুঝেছি, এই ‘বড়’ শব্দটা আমার নিতান্ত সাধারণ, অপরিণত পাঠক-মনের সামনে কী অতলান্ত অর্থ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘আসলে ও নির্জনতা নয়। ফুটপাতে কেনা শান্ত নতুন চিরুনি। দাঁতে এক স্ত্রীলোকের দীর্ঘ কালো চুল লেগে আছে।’ (রাক্ষস)
নির্জনতা যেখানে শান্ত নতুন চিরুনি, যার দাঁতে এক স্ত্রীলোকের দীর্ঘ কালো চুল। এই কবিতার ইমেজারি আমাকে বারবার পঠনেও অস্থির করে রাখে। বারবার আমি বুঝতে চাই, কেন এই কবিতার নাম ‘রাক্ষস’। সেই স্ত্রীলোকের কী হল, যার চুল এই চিরুনিটিকে শান্ত করে দিয়েছে? এই চিরুনি, যে নির্জনতার অন্য এক রূপভেদ, যে মন পড়তেও জানে হয়তো, যেভাবে আমি পড়তে চেষ্টা করি এই কবিতার মন, একটি দীর্ঘ কালো চুলের কনসেপ্ট।
‘তুমি বিবাহিত, না-কি আনুষ্ঠানিক’ এই প্রশ্ন করেছিল প্রেত। আমি বরাবর রাস্তার উপরে হেঁটে দেখেছিলাম পথ শেষ হয়ে যায় গাছের বিচূর্ণ রঙিন জালে যেখানে সমাধি আর প্রসূতির হাসি আর রক্তমাখা প্রেত, তার ভয়াবহ প্রশ্ন ও বিচার—
(ভোর থেকে দেখেছি আগুন)
বিবাহ ও আনুষ্ঠানিকতার মাঝখানে বর্শার ফলার মতো এক দ্বিধাদীর্ণ পথ। তার ওপরে ঝুঁকে আছে এই মানবজন্ম। যে জন্ম ‘আমার ব্যক্তিগত বিছানা ও দুধের বোতল’। তারপরেই সেই প্রেত চোখ রাখে এক চমৎকার সাদা দেওয়ালের প্রতি। সাদা দেওয়াল, জন্ম নাকি মৃত্যুর প্রতীক? মৃত্যুর ব্যাপারে একটাই দৃশ্য যার নাড়িনক্ষত্র আমার মনে আছে, একটা সাদা দেয়াল আর অসম্ভব সাদা আলো। তখন আমি হসপিটালে। অপারেশন টেবিলে, নিজের ভেতরের অন্ধকারের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। আমার একেবারে ব্যক্তিগত সেই দেয়ালের কথা উৎপল জানলেন কী করে? তবে কি আমাদের ‘টানা রাত্রি আর দিন’ একইরকম ‘আলোছায়াময়’! এরপরেই তিনি লিখছেন, ‘রাঁধুনি-নির্ভর আছি। তার নাম কূট মহসিন’। (মধু ও রেজিন) যেন ঈশ্বর-নির্ভরতার কথা বলছেন। যেন ‘উঁচু অশোকের ডালে’ কেউ ‘সেলাইমেশিন’ রেখে গেছে। এমনই আশ্চর্য সব সম্ভাবনার জন্ম আমি ঘোরগ্রস্তের মতো দেখে যাই উৎপলের কবিতায়।
‘মূক তুমি তাকিয়ে রয়েছ ঠাণ্ডা ভাতের থালার দিকে
কী দেখছ তুমি জানো আর জানে আধ-হাতা ডাল’
(সই লুডো-খেলা)
তারপরই দেখি, ওই ভাতের থালার ওপরে তৈরি হচ্ছে ‘এক তুখোড় ছক্কাদান’-এর সম্ভাবনা। যেখানে ‘গ্রাসের আগের মুহূর্তে ঠিক যে যার মতন / নিজস্ব বিশ্বাসে কাঁপছে-ভাত, ঝোল, নুনের আঙুল, / যে বিশ্বাসে কাঁপে নীল গুটিগুলি লাল খেলাঘরে।’
বনগাঁর রাস্তায় একবার একসঙ্গে এক ভাতের হোটেলে খেতে বসেছিলাম আমরা। থালায় ‘মাছটুকু ঘিরে’ গড়িয়ে আসা লাল ঝোল। যেমন ‘লাল গুটি এগিয়ে চলেছে তার মরুভূমি দিয়ে’। তখন প্রশ্ন করতে জানি না, মুগ্ধতার সেইসব দিনকালে। পাঠক হিসেবেও তৈরি হয়ে ওঠার অনেক বাকি। কবিতা যে যা বোঝায়, তাই বুঝি। কোনও কোনও কবিতার ট্র্যাপেও পড়ে যাই। ভাবি, এই হল লেখা, এমনই লিখতে হবে। লিখতে লিখতে লিখতে একদিন মনে হয়, এসব কী লিখলাম! এখানে আমি কই? এ কার ভাষায় কথা বলছে আমার কবিতা? এইভাবে একের পর এক ফাঁদ কেটে বেরিয়ে আসতে আসতে, নিজস্ব ভাষার একটা প্রতিমা অথবা খড়ের পুতুল তৈরি হয় একদিন হয়তো। জানি, আমার তা আজও হয়নি। প্রতিমুহূর্তে সন্দেহ হয় নিজের ওপর। বিশেষ করে যখন পড়ি, ‘প্রতি গল্প বিশ্বরূপ, মাথামুণ্ডু না বুঝেই কাঁদি, / হায়, অবিদ্যায় ঢাকা থাকল ঋজু পাঠ- যেন তারা / হিমের কুটুম, ঐ অস্বচ্ছ মানুষজন, গাছপালা, রণক্ষেত্র- কেন, এর বেশি, সবটা বুঝিনি?’ কী এক হাহাকার উঠে আসে ভেতর থেকে। একটা জীবন কীভাবে কেটে যায় যে! ‘বোকার মতন বাঁচি’। না জেনে, না বুঝে, এঁড়ে তর্ক করে যাই আমরা। ‘মহাভারতের মাঠে, হোমরের উপকূলে, এজিদ-কান্তারে, দেখি, / যুদ্ধ শুরু হল, শেষ হল, নায়ক নিহত, রাজ্য শ্মশান—’। মিথ আর ইতিহাস যেন জড়োয়ার হারের মতো, ‘সলমা-জরির কাজ’-এর মতোই গেঁথেছেন উৎপলকুমার, তাঁর কবিতায়। এর মধ্যে ঢুকে পড়েছে ‘নীল অববাহিকার তৃণ ও ত্যাগের গান’, ‘যে সৌন্দর্য অবলুপ্ত’, ‘যে সুরসুন্দরীদের একজন, / শেষ দেখা ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি’।
‘সিঁধ কাটা হয়েছিল— সেই দাগ; / ফাঁক ও ফোকর, আকাশ দেখার জন্য, বটগাছ / জন্মিয়ে-ওঠার জন্য হাঘরে ফাটল— / আমার কবিতা হয় ঐ মতো। ও-রকম বাবু সেজে থাকে। (সুখ-দুঃখের সাথী)
নিজেকে, নিজের কবিতাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করা, মিথ গড়ে তুলতে তুলতে ভেঙে ফেলা, যে উৎপলকুমারের কাছে প্রায় খেলাধুলার মতোই ছিল, তাঁর সম্পর্কে একটি মিথ ভেঙে দেওয়া যাক তাহলে। আমরা জানি, ১৯৩৭ সালের ৩ আগস্ট উৎপলদার জন্মদিন। কিন্তু এর মধ্যে তাঁর বাবা প্রফুল্লকুমার বসুর হাতে লেখা একটি কাগজ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ছেলেমেয়েদের জন্মের দিনক্ষণ লিখে রেখেছিলেন তিনি। সেই কাগজের বয়ান অনুযায়ী, উৎপলকুমার বসুর জন্ম ২৪ অগাস্ট ১৯৩৬, রাত তিনটে বেজে পঞ্চান্ন মিনিটে। তবে দিনক্ষণের হিসেবে কী-ই বা আসে যায়? কবি নিজেই তো লিখে গেছেন, ‘ফিরে এসো লেখার টেবিলে। এইখানে জন্মেছিলে। / এখানেই শেষ দেখে যেও।’ (সৌরলতা)
লেখার টেবিলে, স্মরণ করতে বসেছি তাঁকে, যাঁর ‘পানীয় ছিল সারাৎসার’, আর যাঁর ‘সৌভাগ্য ছিল অরন্তুদ ভাগ্যবিপর্যয়’, এই তাঁর জন্মের আলো-বৃষ্টি-হাওয়া। এক স্বপ্নে-পাওয়া আঙুলের উত্তরাধিকারীর।