রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জাপানযাত্রীর ডায়েরি’তে উদ্ধৃত করেছিলেন সতেরো শতকের জাপানি কবি মাৎসুও বাশোর হাইকু। তাঁর একটি তিন লাইনের সরল অথচ আশ্চর্য গভীর কবিতা এরকম : ‘পুরোনো পুকুর/ ব্যাঙের লাফ/ জলের শব্দ।’ এই কবিতায় বর্ণিত ছবিটি পাঠককে চোখের দেউড়ি পার করে পৌঁছে দেয় এক গভীরতম দার্শনিক বোধে। এই নীরবতা ও সরবতার মধ্যবর্তী পথের সদর-অন্দর মঞ্চে প্রকট হয়ে উঠল পৃথ্বীশ রাণা পরিচালিত প্রয়াত ঔপন্যাসিক রবিশংকর বলের রচনা অবলম্বনে নির্মিত নাটক ‘চন্দ্রাহতের কুটির’-এ। একটি মানসিক সংশোধনাগার, ‘লুনাটিক’স হাট’-এর বাংলা ‘চন্দ্রাহতের কুটির’, যেখানে ডিটক্সিফিকেশনের জন্য ভর্তি হয়েছে কিছু তথাকথিত ‘পাগল, আমাদের সভ্য, সুস্থ সমাজ যাদের ‘এক্সক্লুড’ করেছে, ‘অপর’ বানিয়েছে।
আরও পড়ুন-ব্যর্থ ব্যাটিং, ০-১ পিছোল ভারত
এই উন্মাদাগারে বাড়ির আত্মীয়েরাই রেখে গিয়েছে মনোতোষকে। যে এখানে বসে মাৎসুও বাশোর ভ্রমণকাহিনি ‘দূর প্রদেশের সঙ্কীর্ণ পথ’ অনুবাদ করে চলে। আরও আশ্চর্য, পৃথ্বীশের নাটক চূড়ান্ত ম্যাজিক রিয়ালিটির জন্ম দেয় যখন খোদ বাশো এই ‘লুনাটিকস হাটে’র একজন অন্যতম চরিত্র হিসেবে ঢুকে পড়েন এবং মনোতোষের সঙ্গে তাঁর রীতিমতো ভাববিনিময় হতে থাকে। একটা সম্পূর্ণ ক্যায়োটিক উন্মাদশালায় এই সতেরো শতকের জাপানি কবি আসেন ক্যাথারসিস হয়ে, যিনি সম্পূর্ণ দিশাহীন ও ঘেঁটে যাওয়া লোকগুলোর জীবনের অন্তর্গত রক্তের ভিতর এক সমান্তরাল স্বপ্ন-পরিষেবা হয়ে ওঠেন। ফলত, স্বপ্ন আর বাস্তব মিলেমিশে যায় এই নাটকে। বাস্তব জীবনে ধ্বস্ত, পরাজিত, কোণঠাসা এই মানুষগুলোর কেউ কেউ এতটাই একা যে তাদের প্রত্যেকটা কথা বলা আসলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্বগতোক্তির মতো। কাউকে বউ বা প্রেমিকা ছেড়ে চলে গেছে, কারও ভাই সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এবং সে এসে আশ্রয় নিয়েছে এই চন্দ্রাহতদের জঙ্গলে। একটি চরিত্রের ছেলে তাকে একলা ফেলে বড় চাকরি নিয়ে চলে গেছে আমেরিকায়, বাবাকে সে একটা সামান্য ফোনও করে না, অথচ তার ধার্মিক বাবা ছেলের স্মৃতি মুছে ফেলতে পারে না, তার চোখের জল যেন এক অসমাপ্ত জীবনের কাব্য, যে জীবনের মীমাংসা হবে না কোনওদিন। এই যে নিয়তিতাড়িত শূন্যতার অস্বাভাবিক চাপ, তা এদের ক্রমশ আরও বেশি কিনারবাসী করে তুলেছে। এই নাটকের আর একটি চরিত্র কেবল বলে ওঠে— ‘সমস্ত খোলা কল থেকে জল পড়ে নষ্ট হচ্ছে। এইভাবে পৃথিবীর সব জল একদিন ফুরিয়ে যাবে।’ এ-কেবল অজান্তে বা জ্ঞাতসারে আধুনিক ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যাওয়া নয়। এ এক গূঢ় বিপন্নতা, যা মানবপ্রজাতির অনিবার্য ও অন্তিম
ধ্বংসের দিকটি সম্পর্কে অমোঘ চেতাবনি দিয়ে যায়।
আরও পড়ুন-অসহযোগের নামে হাসিনার পদত্যাগ চেয়ে উত্তাল বাংলাদেশ
প্রতিটি চরিত্রের জীবনের এক ও অন্তিম অভিজ্ঞান হল নেশা, নারীপুরুষ নির্বিশেষে সেই তরল বা শুকনো নেশার দ্বারা তাড়িত। নেশা এখানে এক অত্যাবশ্যক গন্তব্য, যার সাপেক্ষে চরিত্রগুলির হাসিকান্নার মহাকাব্য রচিত হয়। এরা একে অপরের সঙ্গে কুকুরের মতো ঝগড়া করে, আবার অন্ধকার রাতে ততোধিক অন্ধকার মনের সুড়ঙ্গে পথ খুঁজতে খুঁজতে একে অপরের শরীরে শরীর মিশিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে কী পরম আহ্লাদে। আর এদের সেই যৌথ যাপনে ম্যাজিক হয়ে ধরা দেয় অভ্র দাশগুপ্তের অসামান্য আলোর ব্যবহার। নীলরং-কে যে স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা করে তোলা যায়, আর সেই সীমান্তের কিনারে দাঁড়িয়ে স্বয়ং বাশো এই বিচিত্র চরিত্রাবলির মিছিলকে নিয়ন্ত্রণ করেন এক ভ্রমণপথ হিসেবেই, সেই উদ্ভাবনী খেলা অথবা ম্যাজিক সফল হয়েছে পৃথ্বীশ ও অভ্রর যুগলবন্দির সাপেক্ষে।
আরও পড়ুন-লন্ডভন্ড ওয়েনাড়, পশুদের প্রাণ বাঁচাতে বিশেষ কন্ট্রোল রুম
এই চরিত্রেরা বুঝিয়ে দেয় মানুষ এই পৃথিবীতে এক অনিকেত মেদুর আত্মার শরণার্থী, যার অস্তিত্ব আসলে পোকামাকড়ের মতোই তুচ্ছ ও দীনাতিদিন। এদের চোখের জল তাই আমাদের এই ক্ষয়িষ্ণু ও মুমূর্ষু পৃথিবীর এক অনিবার্য রেপ্লিকা যার কোনও পরিণতি নেই, কোনও ডেস্টিনিও নেই। সেই উন্মার্গের পথেই মুনওয়াক করতে করতে এগিয়ে চলে এরা, গড়ে ওঠে চির-আগন্তুকদের এক নিঃসীম মহাকাব্য। বঙ্কিম ব্লেড গিলে ফেলার অভিনয় করে দেখায়, রক্তাক্ত হয়, তার জীবনে ওই ব্লেড যেন এই পৃথিবীর খণ্ডবিখণ্ড ক্যাকটাস। কেশব, কপিল, অমিতেশ প্রত্যেকেই এক অসমাপ্ত জীবনের মহাকাব্য যারা মঞ্চ-মায়া ছাপিয়েও আরও অনির্দিষ্ট কবিতার জন্ম দেয়। হাইকু যেমন ক্ষুদ্র পরিসরে আরও বড় কোনও গভীরতার বার্তা বয়ে আনে, এদের এই অতি-ক্ষুদ্র ও সামান্য জীবনের কাব্য যেন সেরকমই অসীম সম্ভাবনায় ভরা। পৃথ্বীশ ও অভ্র সেই খণ্ডকাব্যের ভিতরে মহাজীবন ও মহাজাগতিক পরিসরকে ধরতে চেয়েছেন। তাই মঞ্চে যখন বৃষ্টি নামে, সব ক’টি চরিত্র একইসঙ্গে ছাতা খোলে, মেলে ধরে আশ্রয়ের আকুতি। তাদের এবং প্রসেনিয়ামের প্রতিটি দর্শকের হৃদয়ে ঝরে পড়ে বৃষ্টির দানা। আমরা ভিজি। ভিজতেই থাকি।