সরকার! তোর ছাদ ফুটো…

রামমন্দিরের ছাদ থেকে সংসদ ভবন কেবল নয়, রাজধানী এক্সপ্রেসের ছাদেও ছিদ্র, তা দিয়ে ঝরনার মতো জল ঝরছে যাত্রীদের গায়ে। এরই মধ্যে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার সেই ছেলেটিকে খুঁজছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতার সেই ছেলেটাকে মনে পড়ে? “সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও/ সবাই হাততালি দিচ্ছে।/ সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!/ কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;/ কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;/ কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ/ কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;/ কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম, চোখে/ পড়ছে না যদিও, তবু আছে,/ অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।”
সেই ছেলেটা কিন্তু বলেছিল। যা দেখেছিল সেটাই বলেছিল। কারণ, সে ছিল ‘সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু’।
এখানেও এখন সেই একই হাল।

আরও পড়ুন-গরু নয় তবুও নাম তার নীলগাই

১২০০ কোটি খরচ করে তৈরি নতুন সংসদ ভবন। ২০২৩ এর ২৮ মে এই ভবনের উদ্বোধন করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেপ্টেম্বর থেকে সেখানে অধিবেশনের সূচনা। আর একটা সেপ্টেম্বর আসার আগেই ২০২৪ এর অগাস্ট মাসে দেখা যাচ্ছে, সংসদের লবিতে ছাদ থেকে সমানে চুঁইয়ে পড়ছে জল। মেঝেতেও সর্বত্র জল থইথই! পরিস্থিতি সামাল দিতে কোনওমতে বালতি দিয়ে সেই জল ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। দিন দিন পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে উঠছে। ভবনের মেঝেই কখনও কখনও স্রোতস্বিনী! সমাজমাধ্যমে একাধিক সাংসদের পোস্ট করা ভিডিওতে সেকথার প্রকাশ।
লোকসভা সচিবালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, সংসদ ভবনে কাচের গম্বুজ (ডোম) থেকেই ওই বিপত্তি! যে আঠালো পদার্থ ব্যবহার করে গম্বুজের কাচ জোড়া হয়েছিল, তার ফাঁক থেকে জল চুঁইয়েই এই ঘটনা ঘটেছে।

আরও পড়ুন-সরকার! তোর ছাদ ফুটো…

লা জবাব ব্যাখ্যা!
একই ভাবে মোদির উদ্বোধন করা অযোধ্যার রামমন্দিরও বর্ষার গোড়ায় বিপত্তির শিকার হয়েছিল। প্রথম বৃষ্টিতেই রামলালার গর্ভগৃহের ছাদ থেকে বৃষ্টির জল চুঁইয়ে পড়তে শুরু করে। তখনও শোনানো হয় এক মজাদার ব্যাখ্যা। রামমন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে মানের সঙ্গে কোনও আপস করা হয়নি। কিন্তু মন্দিরের বিদ্যুতের লাইনগুলি বেয়ে জল ভিতরে চলে আসছে। সেটাই চুঁইয়ে পড়ছে।
সাম্প্রতিকতম ঘটনা আরও ‘রোমাঞ্চকর’!
দেশের অন্যতম এলিট ট্রেন ‘রাজধানী’তেই সফররত যাত্রীদের বৃষ্টি জলে স্নান করার বিরল অভিজ্ঞতা! রাজধানী এক্সপ্রেসের ছাদ ফুটো। বাইরে বৃষ্টির ধারা ছাদ বেয়ে নাগাড়ে পড়েছে। মোদির রেলের সৌজন্যে জলে ভেজা অবস্থাতেই ওই জার্নি শেষ করতে হল যাত্রীদের। রেলের বিভিন্ন বিভাগে অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা মেলেনি।
ধারাবাহিক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেট। নিম্ন মানের খাবার। বিকল এসি। এসবের সঙ্গে এবার ট্রেনে বসে বৃষ্টির জলে স্নান করার বিরল অভিজ্ঞতা।
বন্দে ভারতীয় রেল! সৌজন্যে মোদি জমানা। গত কয়েকবছরে পরিষেবার মান ক্রমেই নামছে। এজন্য ট্রেনের টিকিট বুকিংয়ের আগে বুক কাঁপছে বহু যাত্রীর।
এক যাত্রীর অভিজ্ঞতা, রাতে ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ ঝরনার মতো জল পড়তে আরম্ভ করল। কিছু বোঝার আগেই কাকভেজা হয়ে গেলাম। মহিলা যাত্রীদের দশা আরও অস্বস্তিকর। গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় শাওয়ারের ঢঙে গা ভেজানো নিজের জীবদ্দশায় ঘটেনি। ঘটনাটিকে ট্রেন পরিচালনায় ভারতীয় রেলের চূড়ান্ত ব্যর্থতার নিদর্শন বলেই ব্যাখ্যা করেন ক্ষুব্ধ ওই যাত্রী।
আর এক যাত্রী বলেন, রাতে খাবারের মান অত্যন্ত খারাপ ছিল। পরিমাণ নিয়েও বহু যাত্রীর মুখে অনুযোগ শোনা গিয়েছে। কিন্তু কোনও প্রতিবাদ করিনি। জরুরি প্রয়োজনে কলকাতায় ফেরার তাড়া ছিল। তাই পুরো পেট না ভরলেও চুপচাপ শুয়েই পড়ি। কিন্তু রাজধানী এক্সপ্রেসের ছাদ ফুটো থাকবে, এমনটা স্বপ্নেও ভাবিনি। সবে চোখ লেগে এসেছে, আচমকাই দেখি পুরো ভিজে গেলাম! বাইরে বৃষ্টির ধারা ছাদ বেয়ে নাগাড়ে পড়ছিল। এভাবেই রেলের সৌজন্যে জলে ভিজে অবস্থাতেই ওই জার্নি শেষ করতে হল। রেলের বিভিন্ন বিভাগে অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা মেলেনি।

আরও পড়ুন-নীরজ আজ অলিম্পিক অভিযানে

কী বলবেন! ধন্য মোদি ধন্য হে!
যখন কেউ মোদিকে পাগল বলে, তার প্রতিবাদ করে বিজেপি। যখন মানুষ তাঁকে খ্যাপা বলে, ধন্য যে হয় সে খ্যাপামি। পাগল বিজেপির জন্য যে! আর আমরা ভারতের আমজনতা তখন বলতে বাধ্য হই, ধন্য আমরা ধন্য হে / দুঃখী মোদির জন্য যে!’
পরপর এমন ঘটনাতে একটা বিষয় পরিষ্কার, মোদি জমানায় করদাতা সাধারণ মানুষের টাকায় ছেলেখেলা চলছে। জনসাধারণ তাই জানতে চাইতেই পারে, বিজেপি সরকারের আমলে তৈরি সব কিছুতেই জল চুঁইয়ে পড়া বিজেপির সুচিন্তিত নকশার অংশ কি না!
নাকি যে নতুন সংসদ ভবন ছিল নরেন্দ্র মোদির অহংকার, সেই অহংকারের আসন যে ২০২৪ লোকসভা ভোটের পর টলে গেছে, এবার সেটাই আস্তে আস্তে স্পষ্টতর হচ্ছে। যে রাজধানী এক্সপ্রেস ছিল ভারতীয় রেলের গর্ব, তার ছাদ থেকেও জল পড়ছে। যে রামমন্দির বিজেপির হিন্দুত্বের অহংকার, তার ছাদও ফুটো।
বর্ষার জলে ‘বানভাসি’ হওয়ার মধ্যেই সংসদের নতুন ভবনে আর এক কাণ্ড। রামচন্দ্রকে নিয়ে নয়, অনুমানকে নিয়ে। এক সাংসদের পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সংসদ ভবনের অন্দরে বানর ঘুরে বেড়াচ্ছে। বানরটি জলমগ্ন দিল্লি থেকে সম্ভবত নিজেকে বাঁচাতে সংসদ ভবনে পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু, সেখানে গিয়েও জল পড়তে দেখেছে সংসদের ছাদ থেকে। মনে আছে তো, দিল্লির ডেপুটি মেয়র পদে থাকাকালীন বিজেপি নেতা সুরেন্দ্র সিংহ বাজওয়া বানরের আক্রমণে ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলেন! কয়েক বছর আগেই অবশ্য লোকসভা সচিবালয় সাংসদ এবং সংসদের কর্মীদের উদ্দেশে একটি নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল— ‘‘বানর দেখে দাঁড়িয়ে পড়বেন না। ওরা বিরক্ত না করলে ওদের একাই ছেড়ে দিন। … কখনও বাঁদরের গায়ে হাত তুলবেন না। বড় লাঠি দিয়ে আপনার বাড়ির মেঝেতে মারলেই আপনা-আপনি বানরটি চলে যাবে।’’ কে জানে, কথাগুলো আসলে মোদি বিরোধী আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে বলা হয়েছিল কি না! হয়তো কথাগুলোর নিহিতার্থ, কখনও মোদিজিকে ওঁর ব্যর্থতার কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে যাবেন না… সমালোচনার ঝড় উঠলে উনি আপনা-আপনি চলে যাবেন, ওই বানরের মতো আর কী! “শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো/ পাহাড়ের গোপন গুহায়/ লুকিয়ে রেখেছে?/ নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে/ ঘুমিয়ে পড়েছে/ কোনো দূর/ নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের/ ছায়ায়?/ যাও, তাকে যেমন করেই হোক/ খুঁজে আনো।/ সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে/ নির্ভয়ে দাঁড়াক।”
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে ওকে উঠুক, রাজা, তোর ছাদ ফুটো…

Latest article