একদিন অ্যালবার্ট হলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাইঝিকে নিয়ে বক্তৃতা করতে এসেছেন। ভাইঝি অসাধারণ সুন্দরী! বক্তৃতার থেকে সেই সুন্দরী গুণবতীকে দেখার আকর্ষণই প্রধান। তিনিই ইন্দিরা। আত্মকথায় এই ঘটনাটির উল্লেখ ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সম্পর্কে সমসাময়িক কালের আগ্রহ এবং কৌতূহলের একটা ছবি ধরা পড়ে৷
প্রমথ চৌধুরীও সেদিন ছিলেন অ্যালবার্ট হলে। তিনি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। আশুতোষ চৌধুরীর ভাই। পাবনার বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারের সন্তান। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় বিলেতে গিয়ে। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের যথার্থ সুহৃদ। রবীন্দ্রনাথের ‘কড়ি ও কোমল’ যথোচিত পর্যায়ে সাজিয়ে তিনিই প্রকাশ করেন। বিলেত থেকে ফিরে রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে তিনি ঠাকুরবাড়ির সান্নিধ্যে আসেন। তাঁর সরল স্বভাব ও সাহিত্যানুরাগ ঠাকুরবাড়ির সকলেরই খুব ভাল লাগল। রবীন্দ্রনাথের দাদা হেমেন্দ্রনাথের প্রতিভাময়ী কন্যা প্রতিভার সঙ্গে আশুতোষের বিয়ে হয়। আশুতোষ ও প্রতিভার বিয়েতে অত্যন্ত সুখী হয়েছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। তাঁর মতে এই জামাই হল এক অর্জন, অনেক সাধনায় প্রতিভা এমন পাত্র পেয়েছে।
একদিন কোনও একটি সভায় দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ও বউদি জ্ঞানদানন্দিনীর কন্যা ইন্দিরাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, পরে সেই একই গাড়িতে উঠেছিলেন আশুতোষ। এই ঘটনা একেবারেই কাকতালীয় কিন্তু হেমেন্দ্রর স্ত্রী নীপময়ী ভয় পেয়েছিলেন, এই বুঝি জামাই হাতছাড়া হয়ে যায়! জ্ঞানদানন্দিনী যদি নিজের মেয়ে ইন্দিরার জন্য এই পাত্রকে ঠিক করে ফেলেন! পরে অবশ্য জ্ঞানদানন্দিনী তাঁকে আশ্বস্ত করেন।
আশুতোষরা ছিলেন সাত ভাই। তাঁদের মধ্যে আশুতোষ ছাড়া আরও তিন ভাইয়ের সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের তিন মেয়ের বিয়ে হয়।
আরও পড়ুন-তৃণমূল সাংসদের প্রশ্নের উত্তরে ফাঁস আসল ঘটনা
প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয় ইন্দিরার। ইন্দিরা খুব ভাল ফরাসি জানতেন এবং প্রমথ চৌধুরী ছিলেন ফরাসি ভাষায় সুপণ্ডিত। বিয়ের আগে লেখা চিঠিপত্রে তাঁদের প্রিয় সম্ভাষণ ছিল ‘Mon Ami’। প্রমথর অসামান্য ব্যক্তিত্বের ছাপ ইন্দিরার ওপর পড়েছিল এবং তাঁদের বিবাহ সুখের হয়েছিল।
বাঙালি আয়নায় নিজের মুখ দেখে বটে কিন্তু আমি কে বা আমরা কে, এই আত্মজিজ্ঞাসায় নিজেকে বড় একটা খোঁচাতে চায় না। একশো বছর আগে ১৩২১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে প্রকাশিত ‘সবুজ পত্র’ নামের সুপরিকল্পিত ছিপছিপে মাসিকপত্রটি সেই চেষ্টা করেছিল। সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ‘সাহিত্য, জাতির খোরপোষের ব্যবস্থা করে দিতে পারে না কিন্তু আত্মহত্যা থেকে রক্ষা কর্তে পারে।’
‘সবুজ পত্র’ প্রকাশিত হল ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। এই সময়ের আগে যাঁরা স্বদেশ-স্বজাতি নিয়ে ভাবতেন তাঁদের অধিকাংশের চিন্তায় ‘পুরনো ভারত’ ও ‘নব্য ইউরোপ’ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। প্রমথ চৌধুরীর মনে হয়েছিল, ‘আমরা বর্তমান ইউরোপ ও অতীত ভারতবর্ষ, এই উভয়ের দোটানায় পড়ে বাঙ্গলা প্রায় ভুলে গেছি।’ ‘সবুজ পত্র’ এই ভুলে যাওয়া বাংলার সঙ্গে আধুনিক বাঙালির যোগসূত্র স্থাপন করতে চেয়েছিল।
‘সবুজ পত্র’ যে তার লক্ষ্যে পুরোপুরি সফল হয়েছিল, তা বলা যাবে না। তবে চেষ্টাটি ছিল খুবই অভিনব। এই সবুজ পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের বিতর্কিত ও বহু আলোচিত গল্প ‘স্ত্রীর পত্র’ মৃণাল নামের মেয়েটির চিঠি। চিঠিটি সংস্কৃতায়িত বাংলায় লেখা নয়। দুর্গম পাড়াগাঁয়ের মেয়ের পক্ষে যে চলিত বাংলা লেখা সম্ভব চিঠিটি সে ভাষাতেই লেখা। স্বামীর ঘর ছেড়েছে সে। এসেছে শ্রীক্ষেত্রে। তার সামনে সমুদ্দুর। আর ফিরবে না কলকাতার মাখন বড়াল লেনের গলিতে। কেন ফিরবে? ও বাড়িতে তার কথার কোনও দাম নেই। কথাহারা গুরুত্বহীন পুরুষের পায়ের তলার জীব হয়ে সংসারে অচলা সতী হয়ে থাকতে চায় না মৃণাল। সে কথা ক’টা জানাতেই মৃণালের এই চিঠি।
আরও পড়ুন-আগামীর পদক্ষেপ, বৈঠকে ইন্ডিয়া জোট
অনেকেরই মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ নব্য ইউরোপের নারী মুক্তির বাসনাকে বাংলা ভাষায় বুঝি চালান করছেন। জাতীয়তাবাদী বাঙালি নেতা চিত্তরঞ্জন দাশের ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের এই গল্পটি সমালোচিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের মৃণাল অবশ্য ইংরেজি পড়ে নারী স্বাধীনতা শেখেনি। পুরনো ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতে স্বামীর ঘর ছাড়া মেয়েদের কথা ছিল। গঙ্গা তো শান্তনুর গৃহত্যাগ করতে দ্বিধা করেনি। মৃণাল কিন্তু পুরনো ভারতের দোহাই দেয় না। সে লেখে মীরার কথা। ‘মীরাবাঈ তার গানে বলেছিল, ছাড়ুক বাপ, ছাড়ুক মা, ছাড়ুক যে যেখানে আছে, মীরা কিন্তু লেগেই রইল, প্রভু তাতে তার যা হবার হোক।’ মীরা পুরনো ভারতের মেয়ে নয়, নব্য ইউরোপের সঙ্গেও তার সম্বন্ধ নেই। সে তুলনায় অর্বাচীন, মধ্যযুগের মেয়ে। পঞ্চদশ ষোড়শ শতাব্দীর মীরা তার পদে যে ভাষা ব্যবহার করত তাও প্রাকৃত জনের ভাষা, নানা উপাদানের মিশেলে তৈরি। বাঙালি মৃণালের কানে এই প্রাকৃত মীরার গান ও কাহিনি ভেসে আসা খুবই সম্ভব।
সম্রাট আকবরের দরবারে নবরত্নর একজন ছিলেন বীরবল। বাংলা সাহিত্যে প্রথম চৌধুরীও তেমনই এক রত্ন। প্রমথ চৌধুরীকে বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি প্রবন্ধ রচনা ও সাহিত্য সমালোচনার পাশাপাশি কবিতা, গল্প, চুটকি রচনায় খুব পারদর্শী ছিলেন। ব্যঙ্গাত্মক রচনাতেও তাঁর জুড়ি নেই। তাঁর কবিতাগুলো ছিল খুবই বাস্তববাদী। ছোটগল্পগুলো ছিল অসাধারণ। ছোটগল্প লেখার ক্ষেত্রে তিনি বাস্তবতার নিরিখে সুগভীর উপলব্ধিকে সাবলীল ভাষায় লিখতেন, যেন পাঠক লেখাটি পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এই ধাঁচটি পরে তাঁর প্রবন্ধগুলোয়ও দেখতে পাওয়া যায়। তিনি মূলত সাধারণ পাঠকদের কথা মাথায় রেখে সাহিত্য রচনা করতেন। পাঠকের মনোভাব উপলব্ধি করে তাদের অব্যক্ত কথাগুলো তিনি তাঁর ছোট গল্প ও প্রবন্ধে লিখেছেন। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।’ তিনি রবীন্দ্র যুগে নিজেকে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং প্রশংসিতও হয়েছেন।