বর্ষায় ডুয়ার্সে ভিলেজ ট্যুরিজম

বর্ষায় জঙ্গলে প্রবেশাধিকার থাকে না। বিকল্প হিসেবে ডুয়ার্সের বিভিন্ন গ্রামে ভিলেজ ট্যুরিজম চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। সমতল, ডুয়ার্স ও পাহাড় দর্শনের পাশাপাশি পর্যটকদের বিভিন্ন পুরনো ঐতিহ্যবাহী মন্দির ভ্রমণের সুযোগ করে দেওয়া হবে। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

দেশ-বিদেশের বহু পর্যটকের পছন্দের জায়গা ডুয়ার্স (Dooars)। বিশেষত যাঁরা জঙ্গল ভালবাসেন। সবুজ বনাঞ্চলের ভিতর ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। চেনা-অচেনা কতরকমের গাছ। নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে। বাতাসে ভেসে বেড়ায় মাটির গন্ধ, গাছের গন্ধ। নেশা জাগায়। জঙ্গলের কোনও অংশ হাল্কা, কোনও অংশ দুর্গম। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে আলো পৌঁছয় না। গা ছমছমে পরিবেশ। রোমাঞ্চ অনুভব করেন বহু মানুষ। আছে বিপদও। জঙ্গলে চরে বেড়ায় বাঘ, চিতাবাঘ, গন্ডার ইত্যাদি বন্যপ্রাণী। এঁকেবেঁকে ঘুরে বেড়ায় বিষধর সাপ। মাঝেমধ্যে পথ আগলে দাঁড়ায় হাতির পাল। তবে সতর্ক থাকলে এড়ানো যায় বিপদ। গাড়িতে থাকলে অনেকটাই সুরক্ষিত থাকা যায়। অতি-উৎসাহীরা জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে অনেক সময় বিপদ ঘটিয়ে ফেলেন। পড়েন বন্যপ্রাণীদের আক্রমণের মুখে। মনে রাখতে হবে, জঙ্গলে বেড়ানোর আগে নিতে হবে সংযমের পাঠ।

সারাবছর ডুয়ার্সের (Dooars) বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায় পর্যটকের ভিড়। গ্রীষ্ম, শীত, বসন্তে। শরত-হেমন্তেও। তবে বর্ষায় কয়েক মাস জঙ্গল বন্ধ থাকে। খোলে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। বৃষ্টির মরশুমে পর্যটকরা জঙ্গলের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত থাকেন। সেই সময় কিছুটা ক্ষতির মুখে পড়ে ডুয়ার্সের পর্যটন শিল্প। যাতে কিছুটা অন্তত ব্যবসা হয়, তার জন্য ভাবনাচিন্তা করে বের করা হয়েছে নতুন উপায়। বর্ষায় ডুয়ার্সের জঙ্গলে প্রবেশাধিকার না থাকলেও, ডুয়ার্সের বিভিন্ন গ্রামে ভিলেজ ট্যুরিজম চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগ নিতে চলেছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। সমতল, ডুয়ার্স ও পাহাড় দর্শনের পাশাপাশি বিভিন্ন পুরনো ঐতিহ্যবাহী মন্দির ভ্রমণের সুযোগ করে দেওয়া হবে পর্যটকদের। এটা বাস্তবায়িত হলে টানা বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় চা-বাগান বা জঙ্গল লাগোয়া রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো যাবে। সুযোগ থাকবে ডুয়ার্সের অপরূপ সৌন্দর্য চেটেপুটে উপভোগ করার। উদ্যোগটি নিয়ে আশাবাদী বিভিন্ন মহল। ট্যুর অপারেটরদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, জঙ্গলের দরজা বন্ধ থাকলেও ইতিমধ্যে পর্যটকদের অনেকেই টেলিফোনে খোঁজখবর নিচ্ছেন। বিকল্প ভ্রমণের দাবি জানাচ্ছেন। তাই পর্যটক টানতে একাধিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন ট্যুর অপারেটররা। ইকো ট্যুরিজম এবং ভিলেজ ট্যুরিজমকে পর্যটনের মানচিত্রে তুলে ধরাই তাঁদের লক্ষ্য। এই উদ্যোগে শামিল করা হচ্ছে বর্ষার মরশুমে পর্যটকদের ডুয়ার্সের গ্রামীণ প্রকৃতিকে চেনানো, ধান চাষ, পাট চাষ, চা-পাতা তোলার মতো দৃশ্য দেখানো, নদীগুলোর সঙ্গে পরিচয় করানো। সেইসঙ্গে পুরনো মন্দিরগুলি দেখানো। কোন কোন মন্দির? ডুয়ার্স অঞ্চলে অবস্থিত উত্তরবঙ্গের একটি বিখ্যাত মন্দির জল্পেশ মন্দির। প্রায় ৩৫০ বছরের প্রাচীন এই মন্দিরে শিবের আরাধনা করা হয়। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, বিশ্ব সিংহ ১৫২৪ সালে জল্পেশ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৫৬৩ সালে মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। আবার ১০০ বছর পর, রাজা প্রাণ নারায়ণ এই মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন। দূর-দূরান্তের মানুষজন আসেন। পুজো দেন। শিলিগুড়ি থেকে দূরত্ব ৬৯ কিলোমিটার। শ্রাবণী মেলা, জল্পেশ মেলা এবং শিবরাত্রির সময় উৎসব হয়। দেখার সেরা সময় জুলাই-অগাস্ট এবং ফেব্রুয়ারি-মার্চ। এই মন্দিরটি দেখানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

আরও পড়ুন- জিএসটি প্রত্যাহারের দাবি, রাজ্যসভায় সুর চড়ালেন ডেরেক

জলপাইগুড়ির জটিলেশ্বর মন্দির ডুয়ার্স অঞ্চলের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। এর যেমন একটি ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে, তেমনই রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্বও। মন্দিরটি জটিলেশ্বর বা ভগবান শিবকে উৎসর্গ করার জন্য নির্মিত হয়েছিল, যা ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের অধীনে রয়েছে। মূল মন্দিরটি বাংলায় গুপ্তদের শাসনামলে ৩২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। শিলিগুড়ি থেকে দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। দেখানো হবে এই মন্দিরটিও।

ভ্রামরী দেবীর মন্দির দেখানোরও পরিকল্পনা রয়েছে। মন্দিরটি জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি ব্লকের তিস্তা নদীর তীরে পুরনো শালবাড়িতে অবস্থিত। নদীর তিন স্রোতের মাঝে অবস্থান করছে বলে একে ত্রিস্রোতা বলা হয়। এই শক্তিপীঠ খুবই জাগ্রত। এছাড়াও মহাকালধাম, পেটকাটি, বটেশ্বর মন্দির দর্শনের ব্যবস্থাও করা হবে। যাতে দ্রুত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যায়, তার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেটা হলে বর্তমান অথবা পরের মরশুমগুলোয় পর্যটকদের বাড়তি সুযোগ থাকবে ডুয়ার্স উপভোগের। থাকা যাবে রিসর্ট, হোমস্টেতে।

আগে ময়নাগুড়ি ব্লকের শেষ প্রান্তে অবস্থিত গরুমারার রামশাই মেদলা নজরমিনার প্রতি বছরই বর্ষায় খোলা থাকত পর্যটকের জন্য। ফলে তখন বৃষ্টির মরশুমে ডুয়ার্সে এসে বন্যপ্রাণীর দেখা পেতেন পর্যটকরা। করোনার পর থেকে বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে বর্ষায় ডুয়ার্সের সব জঙ্গল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাই বিকল্প আকর্ষণ তৈরি করা দরকার ছিল বলে মনে করেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই আশায় বুক বাঁধছেন পর্যটকরা। জঙ্গলে যাওয়া না হোক, বর্ষায় ডুয়ার্স বেড়ানোর সুযোগ থেকে কাউকেই আর বঞ্চিত হতে হবে না।

Latest article