জেলে বসে লিখেছিলেন গীতার ভাষ্য। তাঁর নিজের কথায়, ‘জেলে আমি স্বামী কৃষ্ণানন্দ, তিলক মহারাজ, বঙ্কিমবাবু এবং আরো অনেকের গীতার অনুবাদ পাঠ করিয়াছি। তাঁহারা গীতাভাষ্যে পাণ্ডিত্য দেখাইয়াছেন খুব, কিন্তু আমার পছন্দ হয় নাই। আমি গীতার শঙ্করভাষ্যও দেখিয়াছি। আমার মনে হইল, আমিও আমার মনোমত গীতার ভাষ্য লিখিব, আমি গীতার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা করিলাম। গীতা আমাদের দেশে সকলেই পড়েন, এমনকি গীতা পাঠ না করিলে হিন্দুর শ্রাদ্ধ কার্য সমাপ্ত হয় না। আমার মতে গীতার প্রকৃত অর্থ বুঝিতে হইলে প্রথমত দেখিতে হইবে, কোন সময় গীতার সৃষ্টি হইয়াছে এবং শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ শুনিয়া অর্জুন কী করিলেন।… আলিপুর জেলে আমি গীতার চারিটি অধ্যায়ের ব্যাখ্যা করি। আমি গীতার শ্লোকে সাধারণ ব্যাখ্যা লিখিয়া ‘ভাবার্থে’ আমার মত গীতার মধ্য দিয়া, অর্থাৎ ‘শ্রীকৃষ্ণের এই শ্লোক বলার এই অভিপ্রায় ছিল’ এইভাবে চালাইয়া দিয়াছি।’
ইনি ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (Trailokyanath Chakraborty)। ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের সংগঠক, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক। তাঁর লেখা বই ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’। নাতিদীর্ঘ ও বহু আদৃত গ্রন্থ। নিঃসন্দেহে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সেখানেই উল্লিখিত কথাগুলি লিখেছেন তিনি। ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ১৯২৪ সালের নভেম্বরে গ্রেফতার হয়ে প্রায় চার বছর জেল খেটে ছাড়া পান ১৯২৮ সালে।
এর পরেও বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, কারাগারে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কারাবিধিতে ছিল এমন কোনও শাস্তি বাদ নেই, যা মহারাজ ভোগ করেননি। নিজেই লিখে গেছেন, “আমি ভারতবর্ষের মধ্যে, ভারতবর্ষ কেন সম্ভবত পৃথিবীর মধ্যে রাজনৈতিক কারণে সর্বাপেক্ষা অধিকবার যাঁহারা রাজনৈতিক কারণে সর্বাপেক্ষা অধিক বৎসর কারাগারে কাটাইয়াছেন, তাঁহাদের অন্যতম”।
আরও পড়ুন- প্রথম দ্বিতীয় সেমিস্টারের প্রশ্ন করতে হবে শিক্ষকদেরই, কড়া নির্দেশ সংসদের
১৯১৪ সালের দিকে সেবার তৃতীয়বারের মতো আটক হলেন বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলায়। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বরিশাল জেল থেকে প্রেসিডেন্সি জেলে বদলি হলেন। হাতে হাতকড়া, পায়ে বেড়ি, কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্থায় চালান দেয়া হল। প্রেসিডেন্সি জেলে পৌঁছার পর তাঁকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হল এবং ৪৪ ডিগ্রিতে বন্ধ করল। ক্ষুদ্র একটি সেলের মধ্যে দিন-রাত সময় কাটাতে হত তখন। কারও সঙ্গে কথা বলা যেত না। কারও সঙ্গে কথা হয়েছে, এটি প্রমাণিত হলে শাস্তির পরিমাণ আরও বেড়ে যেত। পাথরসমেত নিম্নমানের চালের ভাত পরিবেশন করা হত নিত্যদিন। ১৯১৬ সালের মাঝামাঝি মহারাজকে আন্দামান জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। আন্দামানে জেল খাটা মানে দুর্বিষহ যন্ত্রণা ভোগ করা। একবার গেলে সেখান থেকে আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা খুব কঠিন। জেলার সাহেব বলেছিলেন, তুমি আন্দামানেই মরবে। ওদিকে সেলের ভেতর দেওয়ালে সুড়কি দিয়ে মহারাজ লিখলেন,
‘বিদায় দে মা প্রফুল্ল মনে যাই আমি আন্দামানে,
এই প্রার্থনা করি মাগো মনে যেন রেখো সন্তানে।
আবার আসিবো ভারত-জননী মাতিব সেবায়,
তোমার বন্ধন মোচনে মাগো যেন এ প্রাণ যায়।
বিদায় ভারতবাসী, বিদায় বন্ধু, বান্ধবগণ,
বিদায় পুষ্প তরুলতা, বিদায় পশু, পাখিগণ।
ক্ষমো সবে যত করেছি অপরাধ জ্ঞানে অজ্ঞানে,
বিদায় দে মা প্রফুল্ল মনে যাই আমি আন্দামানে।’
মহারাজ! হ্যাঁ, মহারাজ তিনি। ওড়িশার পুরীতে থাকার সময় ছদ্মনাম নিয়েছিলেন, ‘শশীকান্ত’। ময়মনসিংহ জেলার তখনকার মহারাজের নাম ছিল শশীকান্ত রায় চৌধুরী। লোকে তাঁকে শশীকান্ত রায় চৌধুরী মনে করে ‘মহারাজ’ বলে ডাকতেন। এভাবেই তিনি হয়ে যান ‘মহারাজ’। পরে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (Trailokyanath Chakraborty) বললে কেউ না চিনলেও মহারাজ নামে সকলেই তাকে চিনতেন।
সুদর্শন পঞ্জিকা ও মাসিক সমাজ দর্পণ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শিবশঙ্কর চক্রবর্তী একবার স্মৃতিচারণা করতে বসে বলেছিলেন, ‘আমি যখন পুঁথিঘরে চাকরি করি তখন আমাদের কাছে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী মহাশয় যাওয়া-আসা করতেন। তো একদিন আমাদের পাশে বসে সচিবালয়ে ফোন করছেন। কে যেন ফোন ধরেছে এবং বলছে- আপনি কে? মহারাজ উত্তর দিচ্ছেন— “তুমি কে? আর তুমি যেই হও, গিয়ে বল ‘মহারাজ’ ফোন করেছে।” তাঁর এ কথাতেও বুঝা যায় ‘মহারাজ’ হিসেবে তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন।
স্কুলে পড়ার সময়ই ত্রৈলোক্য (Trailokyanath Chakraborty) মহারাজ স্বদেশি আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। পুলিনবিহারী দাসের কাছে স্বদেশি মন্ত্রের দীক্ষা গ্রহণ। অনুশীলন সমিতির সদস্য হলেন। ১৯০৮-এ নৌকা চুরি করে ডাকাতি করতে যাবে এই অভিযোগে প্রবেশিকা পরীক্ষার ঠিক আগে নারায়ণগঞ্জে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। সেবার ১২ মাস কারাভোগ। ১৯১২-তে ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায় পুলিশ কর্মচারী রতিলাল রায়কে হত্যার অভিযোগে আবার গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। ১৯০৮ থেকে ১৯৪৬ স্বদেশপ্রেমিক মহারাজের জীবনের ৩০ বছর ইংরেজদের জেলে কেটে গেছে। ৫ বছর কেটেছে আত্মগোপন করে।
১৯৪৮-এ বরিশালে পাকিস্তান সোশ্যালিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করে সভাপতিরূপে স্বাধীন দেশে তাঁর কাজ শুরু করেন। হিন্দুরা যাতে দেশ ত্যাগ না করে, পূর্ব পাকিস্তানের জেলায় জেলায় ঘুরে তিনি তার জন্য চেষ্টা করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ওই অশীতিপর দেশপ্রেমিক মানুষটিকে পাকিস্তান সরকার দু’বছর কারারুদ্ধ করে রাখেন।
১৯৭০-এর ২৪ জুন দেশ-আনন্দবাজার পত্রিকার এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন— দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন না হয়ে ভারত চলে গেলেন না কেন? আপনার সহকর্মীরা অনেকেই তো পশ্চিমবাংলায় চলে গেছেন। চিরবিপ্লবী মহারাজ দীপ্তকণ্ঠে জবাব দেন, “প্রকৃত বিপ্লবীরা কোন সম্প্রদায়ে বিশ্বাস করে না একমাত্র মানব সম্প্রদায় ছাড়া। আপনারা কি মনে করেন যে, ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত বিপ্লবীরা কেবলমাত্র হিন্দুদের স্বাধীনতার জন্যই জীবন উৎসর্গ করেছেন? তারা ভারতের মুক্তি কামনায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন; কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য তারা গৃহত্যাগ করেন নি। দেশত্যাগ বিপ্লবীর ধর্ম নয়। সর্বভারতের মুক্তিকামী হয়েও মুসলমানদের দুঃখ দুর্দশাই একদিন আমাকে বিপ্লবী রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আজও এখানে দুই সম্প্রদায় বর্তমান। এদের দুঃখ দুর্দশার অবসান আজও হয় নি।’’
বিপ্লবী এই মহারাজের কথা আমাদের প্রজন্মের জানা উচিত বলে মনে হয়।