বাঙালির বিয়ের ভোজবাদ

ভোজ ছাড়া বিয়েই অসম্পূর্ণ। আর বাঙালি-বিয়ে মানেই হল মাছ, মাংস, কালিয়া, পোলাও— হরেক মেনু। সময়ের নিয়মে নানাবিধ পরিবর্তন এসেছে বাঙালি-বিয়ের ভোজপর্বে। ছাদে ম্যারাপ বেঁধে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন থেকে এলিট ক্লাস কেটারিং সার্ভিস— বিয়ের ভোজের বিবর্তন নিয়ে লিখলেন সৌরভকুমার ভূঞ্যা

Must read

শুরুর কথা
সময়ের নিয়ম মেনে বদল এসেছে বিয়ের আয়োজন, আচার-অনুষ্ঠান রীতিনীতি— সবকিছুতে। সবচেয়ে বেশি যে বদলটা নজরে পড়ে তা হল বিয়ের ভোজ। প্রাচীন, মধ্যযুগের কথা বাদই দিলাম, আমরা যদি বিগত দুই তিন দশকের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে বিয়ের ভোজের বিবর্তন স্পষ্টভাবে দেখতে পাব।
বিয়ের ভোজে ভাত
বিয়ের ভোজের কথা বললে প্রথমেই এসে যায় ভাতের কথা। প্রাচীনকাল থেকে আজকের পোলাও হোক বা ফ্রায়েড রাইস, নানা রূপ রঙে ভাত কিন্তু পড়েই অতিথিদের পাতে। প্রাচীনকালে সময়ে সরু চালের ঘিয়ে ভাজা ঝরঝরে ভাতেরও উল্লেখ রয়েছে। শ্রীহর্ষ রচিত ‘নৈষাধ চরিতে’ নল-দময়ন্তীর বিয়ের ভোজে ধোঁয়া-ওঠা গরম ভাতের কথা বলা হয়েছে। আজকের সময়েও বিয়ের মেনুতে ভাত অনেক বৈচিত্রে উপস্থিত।

আরও পড়ুন-বাইরের দরজা

প্রাচীন ভোজে মাছ-মাংস
প্রাচীনকালে আর্য সমাজে ব্যবস্থায় বিয়ের ভোজ শুরু হত মাছের নানাবিধ পদ দিয়ে। মাংসের মধ্যে ছিল হরিণ, ছাগল, ভেড়া, পাখির মাংস। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়—
‘‘মাংসেতে দিবার জন্য ভাজে নারিকেল
ছাল খসাইয়া রান্ধে বুইড়া খাসির তেল।’’
অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে বিয়ের ভোজে মাছ-মাংসের প্রচলন ছিল না। তখন যা পরিবেশন করা হত তাকে ‘ফলার’ বলা হত। ময়দার প্রচলনে বিয়ের ভোজে পরিবর্তন শুরু হয়। তখন থাকত লুচির সঙ্গে আলু কিংবা কুমড়োর তরকারি। ক্রমে বিয়ের মেনুতে মাছ-মাংসের প্রচলন হতে থাকে। এমনিতেই বাঙালি ভোজনরসিক ফলে আয়োজনও এলাহি। বিয়েতে বর এবং কনেপক্ষ উভয়ই নানান পদের আয়োজন করতেন। অতিথি অভ্যাগতরা ভূরিভোজের মজা নিতেন। সেই পদ গুনে শেষ করা যাবে না। সাদাভাতের পাশাপাশি ঘিভাত, পোলাওভাত দেওয়া হত। সঙ্গে আলু, বেগুন, পটলের ভাজা। নানারকম সবজি ও মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল। মাছ দিয়ে থাকত নানারকম পদ। মাছের চপ, ভাজা, চিংড়ির কাটলেট, কালিয়া প্রভৃতি। তার সঙ্গে মুরগি, পাঁঠা কিংবা খাসির মাংস। তারপর চাটনি, পাঁপড় ভাজা। খাওয়াদাওয়ার শেষপাতে মিষ্টিমুখ চিরাচরিত রীতি। ডেজার্ট তখন কোথায়? শেষপাত মানেই রকমারি মিষ্টি। গোল্লা, সন্দেশ, ছানার পায়েস, রাবড়ি, চমচম, মিষ্টি, দই, রসেবশে শেষ হত ভোজপর্ব। বিত্তবান বাড়ির বিয়ে মানে এককথায় এলাহি আয়োজন। যাদের আর্থিক সচ্ছলতা তেমন ভাল ছিল না, তাঁরাও বিয়ের ভোজে ভালই আয়োজন করতেন।

আরও পড়ুন-ধনকড়-ইন্ডিয়া জোট বিরোধ, ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনার প্রস্তুতি বিরোধী শিবিরের

বাড়ির বিয়ে
তখনকার দিনে বিয়ে মানেই বাড়ির ছাদে বা সামনের বড় দালানে হইহই আয়োজন। ভেনু বলে কিছু ছিলই না। বিয়ের অনেক আগে থেকেই বাড়িতে সাজ-সাজ রব পড়ে যেত। আশীর্বাদ, গায়ে হলুদ, বিয়ে, বউভাত— সব মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান বাড়িতেই। প্রীতিভোজও তাই। অনেকদিন আগে থেকে বাড়িতে প্যান্ডেল বাঁধার কাজ শুরু হত। তখন খাবার পরিবেশনে থাকতেন বাড়ির সদস্যরাই আর খাবার পরিবেশন করতেন কলাপাতা কিংবা পদ্মপাতায়। তাই বিয়ের বেশ কিছুদিন আগে থেকে ওই পাতা সংগ্রহের ব্যস্ততা পড়ে যেত। বাড়িতে বড় বড় উনুন তৈরি করা হত। বিয়ের দই বাড়িতেই বসানো হত। বসত ভিয়েন যেখানে হালুইকররা বাড়িতে এসে মিষ্টি তৈরি করতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মানুষের রুচি পছন্দ। পুরনো মেনুর পরিবর্তে অনেক নতুন পদ নতুন মেনু ঢুকে পড়েছে। বেড়েছে বৈচিত্র।

বর্তমানে বিয়ের ভোজ
এ-যুগে বাঙালি-বিয়ের মহাভোজে বিরিয়ানি হচ্ছে শো-স্টপার। এই খাস মোগলাই পদটি ছাড়া বাঙালি অসম্পূর্ণ। স্বাভাবিকভাবে বিয়ের মেনুতে আজকাল ভাতের পরিবর্তে বিরিয়ানি থাকলে সেই বিয়ের মানটাই যেন পাল্টে যায়। বিত্তশালী এলিট ক্লাস থেকে সাধারণ মধ্যবিত্ত একমাত্র পুত্র বা কন্যার বিয়ের মেনুতে বিরিয়ানি রাখবেনই। এরপর চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল, সাউথ ইন্ডিয়ান, নর্থ ইন্ডিয়ান, তন্দুরি, কাবাব তো রয়েছেই। পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে থাকে মাছের নানা আইটেম। ফিশ ওরলি, ফিশ মুনিয়ে, ফিশ ব্যাটার ফ্রাই, ফিশ পসিন্দা, ফিশ ফ্রাই, ফিশ কাটলেট, ফিশ রোল। মূল পদে দইমাছ, ইলিশ পাতুরি, ভেটকি পাতুরি, সরষে পাবদা, চিংড়ি মালাইকারি— কী নেই। এরপর আধুনিক বিয়ের ভোজের নতুন সংযোজন ডেজার্ট। শেষপাতে মিষ্টিরও ভোলবদল ঘটেছে— বেকড রসগোল্লা, বেকড মিহিদানা, রাবড়ি উইথ জিলিপি, ভ্যানিলা আইসক্রিম উইথ হট গুলাব জামুন, আম দই, মাখাসন্দেশ কত কী! শেষ পাতে ডেজার্টের সঙ্গে আইসক্রিম ছাড়া আজকের দিনে কোনও বিয়েবাড়ির কথা ভাবাই যায় না।

আরও পড়ুন-জহরের প্রশ্নে অস্বস্তিতে রেলমন্ত্রী

স্টার্টার
বিয়ের মেনুতে ফ্রায়েড রাইস, পোলাও, বিরিয়ানি, চিলি চিকেন, মটনকষা, নান, রুমালি রুটি, পনির, ছোলে, ফিশফ্রাই, কাটলেট, পাবদা, পারশে, চিংড়ির আগে বাঙালির রসনাকে উসকে দিতে হাজির হয়েছে স্টার্টার।
ভোজনরসিক বাঙালির বিয়ের মেনুর চেয়ে এই স্টার্টারের প্রতি প্রেম অকল্পনীয়। খাবারের আগে তাঁদের অর্ধেক পেট ভরে যায় স্টার্টারেই। স্টার্টার কোনও নতুন কনসেপ্ট নয়, জমিয়ে পেটপুজোর আগে একটু মুখশুদ্ধি। বিয়েবাড়িতে সেই স্টার্টারের বৈচিত্রেও এখন তাক লেগে যায়। চা, কফি, কোল্ডড্রিঙ্কস, ফুচকা, পাপড়িচাট, ভেলপুরি, দইবড়া, চিকেন পকোড়া, ভেজ পকোড়া, পনির পসিন্দা, ফ্রায়েড বেবি কর্ন, সসেজ, সালামি, প্যাটিস, রোল, চপ— কী চান? পছন্দের সব পাবেন এই স্টার্টারে। বিয়ের ভোজ সেরে নিজের পছন্দের পুরভরা সুগন্ধী পান যত খুশি মুখে আর পকেটে পুরে রওনা বাড়ি।
শুধুমাত্র খাবার নয়, বিয়ের আয়োজন এবং পরিবেশনেও এসেছে বিবর্তন। কলাপাতা কিংবা পদ্মপাতার বদলে এসে গেছে কাগজ, শোলা কিংবা শালপাতার প্লেট। কাচ কিংবা চিনামাটির বাসনকোসন। ছাদে, দাওয়ায় মাটিতে বসে খাবার যুগ শেষ। এখন চেয়ার-টেবিলের যুগ। চেয়ার-টেবিল এবং খাবার জায়গা সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হয়। প্লেটে থাকে টিস্যু পেপার। জলের বোতল। থাকে হাত ধোয়ার আলাদা করে সাবান-মেশা হালকা গরম জল। সেই সঙ্গে যাঁরা পরিবেশন করেন তাঁরাও একেবারে ধোপদুরস্ত হয়ে ইউনিফর্ম পরে হাজির হন অতিথি আপ্যায়নে। আজকাল আবার ‘আপনা হাত জগন্নাথ’। এসে গেছে বুফে। টেবিলে পরপর সমস্ত খাবার সাজানো থাকে। নিজের পছন্দমতো খাবারটি তুলে নিন অথবা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবেশককে বলুন তিনিই আপনার পছন্দের পদটি পাতে তুলে দেবে। এইক্ষেত্রে অপছন্দের খাবারটি এড়িয়ে যান স্বচ্ছন্দে আর পছন্দের খাবারটি খান যত খুশি। এখন আর বিয়ের অ্যারেঞ্জমেন্ট হোক বা বিয়ে। ভেনু আর মেনুর লোকবল না থাকলে চিন্তা নেই, রয়েছে বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা।

Latest article