মেরুকরণের রাজনীতিতে শান দিচ্ছে ওরা

কখনও প্রাপ্য আটকে, কখনও রাজ্য ভাগ করার ধুয়ো তুলে গেরুয়া পার্টি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার পথে হাঁটছে। সেই অনৈতিক পথের নীতিহীন যাত্রীদের চরিত্র বুঝে নিতে হবে আমাদের। বিভাজনের রাজনীতিকে কোনও ভাবে জয়ী হতে দেওয়া যাবে না। তাহলেই যে দগ্ধ হবে ভারতাত্মা। লিখছেন শমিত ঘোষ

Must read

প্রথমে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে একের পর এক নেতার বয়ান। ঘরে বাইরে প্রবল চাপের মুখে অবশেষে বিধানসভায় রাজ্যভাগের বিরুদ্ধে প্রস্তাবে সায় দিয়ে, নিজেদের অবস্থান লিপিবদ্ধ করে রাখা। আপাতত এটাই বঙ্গ বিজেপির অবস্থান। যদিও এরপরেও বিভিন্ন স্তরের বিজেপি নেতারা যে রাজ্যভাগ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করবেন না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আসলে, বিধানসভা এবং বাইরে জনসভা বা মিডিয়ায় ‘বাইট’ দেওয়ার মধ্যে একটা পার্থক্য থাকে। বিধানসভার যে কোনও বক্তব্য সরকারি ভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে থেকে যায়। সেই মোতাবেক, বিজেপির অবস্থান বঙ্গভঙ্গের পক্ষে নয় বলে তাদের অবস্থানকে লিপিবদ্ধ তো করলেন শুভেন্দু অধিকারীরা। কিন্তু, বিধানসভার বাইরে কখনও প্রকাশ্য জনসভায় আবার কখনও টিভি মিডিয়ায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিজেপির সাংসদ বিধায়করা যে ফের বঙ্গভঙ্গের দাবি তুলবেন না, একথা হলফ করে কেউ বলতে পারছে না। কারণ, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ৩৫ আসনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে নামা বিজেপি গত বারের চেয়েও ৬টি আসন হারিয়ে রাজনৈতিকভাবে প্রবল চাপে। কয়েক দিন আগেই হওয়া উপনির্বাচনেও নিজেদের জেতা ৩টি আসনের ৩টিই খোয়াতে হয়েছে তৃণমূলের কাছে।

আরও পড়ুন-মম ব্রতে তে হৃদয়ং দধামি…

এহেন পরিস্থিতিতে, বঙ্গবিজেপি নেতৃত্ব কয়েকটি ‘ন্যারেটিভ’কে বাজারে এনে কোনওক্রমে টিকে থাকতে চাইছেন। তার মধ্যে অন্যতম ধর্মীয় মেরুকরণ এবং বাংলা ভাগ! লক্ষণীয় বিষয় হল, বিজেপির মধ্য থেকে বাংলা ভাগের তিনটি প্রস্তাব এসেছে। এবং এই প্রস্তাবগুলো কোনও পাড়ার বিজেপি নেতা-নেত্রীরা করেননি। করেছেন বিজেপির সাংসদ বা বিধায়ক এমনকী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও। স্বয়ং বিজেপির রাজ্য সভাপতি গোটা উত্তরবঙ্গকে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। দ্বিতীয় প্রস্তাব এসেছে তাদের রাজ্যসভার সাংসদ অনন্ত মহারাজের তরফ থেকে। অনন্ত মহারাজ-সহ বহু বিজেপি নেতাই দীর্ঘদিন ধরেই পৃথক কোচবিহার রাজ্যের দাবি তুলে আসছেন। আশ্চর্যজনকভাবে এহেন একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী ব্যক্তিকেই বিজেপি রাজ্যসভায় পাঠিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা আসলে বাংলা ভাগের দাবি তোলা ব্যক্তিদের প্রশ্রয়দাতা। এবং সর্বশেষ বাংলা ভাগের প্রস্তাব লোকসভায় দাঁড়িয়ে তুলেছেন ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। একসময়ের বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদকেই বাংলা থেকে পৃথক করে, মালদা-মুর্শিদাবাদ এবং ঝাড়খণ্ড বিহারের কয়েকটি জেলা নিয়ে একটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি! যে-প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে একের পর এক বয়ান দিয়েছেন মুর্শিদাবাদের বিজেপি বিধায়ক! একবার চোখ বন্ধ করে পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রটা ভাবুন। এবার মানচিত্র থেকে মালদা এবং মুর্শিদাবাদকে আলাদা করে পশ্চিমবঙ্গকে কল্পনা করুন। এই প্রস্তাব যদি কখনও বাস্তবে রূপান্তরিত হয়, তাহলে বাংলা পুরো বিভাজিত হয়ে যাবে। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের মাঝে থাকবে আরেকটি রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল! অর্থাৎ নিজের রাজ্যেরই একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে মাঝে অন্য রাজ্যের ওপর দিয়ে যেতে হবে বাংলার নাগরিকদের! কতটা শঠ এবং ষড়যন্ত্রকারী মানসিকতা থাকলে এরকম চিন্তাভাবনা করা যায়। তাও কে করছেন? না নিশিকান্ত দুবে! ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার সাংসদ কী করে অন্য একটি রাজ্য বিভাজন নিয়ে সংসদে প্রস্তাব দিতে পারেন? কোন এক্তিয়ারে? ঘরে-বাইরে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে বঙ্গীয় বিজেপি নেতারা এখন বারবার বলছেন, যে তাঁরা বাংলা ভাগ চান না। তাহলে, নিশিকান্ত দুবের এই প্রস্তাবের বিপক্ষে বাংলার বিজেপি সাংসদ আওয়াজ তুললেন না কেন? কেন প্রকাশ্যে বলতে পারলেন না, যে একজন প্রতিবেশী রাজ্যের সাংসদ হিসেবে তাঁর কোনও এক্তিয়ার নেই অন্য রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নাক গলানোর! এমনকী নিশিকান্তের সুরেই যখন সুর মেলালেন মুর্শিদাবাদের বিজেপি বিধায়ক তাঁকে কেন শোকজ করলেন না শুভেন্দু অধিকারীরা?

আরও পড়ুন-কথা রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী, নিয়োগপত্র পেলেন দুর্ঘটনায় মৃত কর্মীর ছেলে

আসলে, শুভেন্দু অধিকারীরা একটা লোকঠকানো খেলা খেলছেন। একদিকে, বিজেপি নেতারা ক্রমাগত রাজ্য ভাগের জন্য উলকানিমূলক মন্তব্য করে যাচ্ছেন। আরেক দিকে তাঁরা বিধানসভায় দাঁড়িয়ে রাজ্য ভাগের বিরুদ্ধের প্রস্তাবে সম্মত হচ্ছেন। এই যে নিশিকান্ত দুবে মালদা মুর্শিদাবাদকে নিয়ে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের দাবি তুলছেন, তার সপক্ষে তাদের যুক্তিটা কী? না, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের জনসংখ্যা বৃদ্ধি। বিজেপি নেতারা প্রায়শই বলেন অনুপ্রবেশকারীতে নাকি ভরে যাচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলি। তা এই অনুপ্রবেশ রোখার দায়িত্ব কার? বিএসএফের। বিএসএফ কাদের নিয়ন্ত্রাধীন? ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কে? অমিত শাহ। তাহলে যদি ধরে নিই, নিশিকান্তদের দাবিই সঠিক, তবে এই অনুপ্রবেশের জন্য দায়ী কে? কার ব্যর্থতা? নিশিকান্ত দুবে কি অমিত শাহের ইস্তফা চেয়ে চিঠি লিখবেন? স্বীকার করবেন, যে মন্ত্রী হিসেবে অমিত শাহ চরম ব্যর্থ! আসলে এসব দাবির পিছনে আছে পুরোনো মেরুকরণের অস্ত্র। মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ শুধু নয়, গোটা বাংলারই সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরুদের মধ্যে বিভাজন ঘটানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বিজেপি। কয়েকদিন আগেই বিজেপির অভ্যন্তরীণ সভায়, শুভেন্দু অধিকারীর ‘যো হামারি সাথ, হাম উনকে সাথ’ মন্তব্য স্মর্তব্য। শুভেন্দু অধিকারীরা দিবাস্বপ্ন দেখছেন, তাঁদের এই উসকানিমূলক মন্তব্যে বাংলার বাঙালির একতা ভেঙে যাবে। এবং সকল সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ একতরফা তাদের ভোট দেবেন। কিন্তু, তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন রাজনীতির পাটিগণিত এইভাবে হয় না। বাংলার সকল মানুষের মাথায় ছাতার মতো আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে রাজনীতির অঙ্কে এমন সরলীকরণ আসলে মুর্খামির পরিচয়! শুভেন্দু অধিকারীরা মেরুকরণের রাজনীতির হাওয়া তুলে বাংলা দখলের যে অপচেষ্টা করছে তা বিগত কয়েকটি নির্বাচনে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। বাংলার হিন্দু-মুসলিমের একতা ভাঙার জন্য একের পর এক মিথ্যে কথা জনসভা থেকেও অমিত শাহ নরেন্দ্র মোদিদের বলতে হয়েছে। কখনও ওঁরা বলেছেন, বাংলার দুর্গাপুজো হয় না! কখনও বলেছেন, বাংলায় নাকি সরস্বতী পুজো হয় না! বাংলার মানুষ এসব ‘প্রলাপ’ শুনেছে! আর দু-হাত উজাড় করে আশীর্বাদ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে, সেই পুরোনো অস্ত্রেই ফের একবার শান দিয়ে বৈতরণী পার হতে চাইছেন শুভেন্দু অধিকারী-সুকান্ত মজুমদাররা। এবার সেই মেরুকরণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাভাগের চক্রান্ত। বিজেপি যে কতটা বাংলা ও বাঙালি-বিদ্বেষী তার প্রমাণ আগেও দেখা গেছে। রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশ মনে করে বিজেপি এখনও বাঙালির মননই বুঝে উঠতে পারেনি। তাই, বারবার তাঁরা এ-রাজ্যে ব্যর্থ হচ্ছে। এবং এই ব্যর্থতা থেকেই তাদের এই প্রতিহিংসামুলক আচরণ। কখনও বাংলার পাপ্য টাকা আটকে, কখনও বাংলাকে ভাগ করে বিজেপি নিজেদের বাংলা বিরোধী মনোভাবকে আরও স্পষ্ট করে ফেলছে।

আরও পড়ুন-পালাবদলের গয়নাগাটি

এহেন পরিস্থিতিতে, বাংলার বিজেপি নেতারা যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করে বিজেপির প্রকৃত লক্ষ্যকে আড়াল করার চেষ্টা করুন, নিশিকান্ত দুবের মতো চরম বাংলা-বিদ্বেষী নেতারা তো বিজেপির বাংলা-বিরোধী মুখটাকে আরও স্পষ্ট করে দিচ্ছে!

Latest article