বাবা ছিলেন দারুণ পাঠক
আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার জন্ম বাবা-মায়ের বিয়ের চোদ্দো বছর পর। বাবার সঙ্গে ছিল আমার সবথেকে বেশি ভাব। তাঁকে ছাড়া আমার চলত না। গান করেন বাবা। আমি তাঁর পিঠে পিঠ দিয়ে পড়ি। বাবা সুর করে দেন আমার পড়ার বইয়ের কবিতায়। আমি মহানন্দে গেয়ে বেড়াই। বাবা হ্যারি বেলা ফন্টের কনসার্ট, গোলাম আলির গজলের ক্যাসেট কিনে দেন, আমি শুনি। রাতবিরেতেও কোনও গানে সুর করলে বাবা আমায় পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে ডেকে দেন, আমি উঠে বসি। বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল এইরকম। বাবা ছিলেন দারুণ পাঠক। যেকোনও রকমের বই পড়তে ভালবাসতেন। সে ছোটদের বই হোক বা বড়দের বই। বেশি পছন্দ করতেন জেমস হেডলি চেজ, আগাথা ক্রিস্টির বই। আমিও পড়তে ভালবাসি। এটা পেয়েছি বাবার কাছেই। মজাদার মানুষ ছিলেন। প্রাণখোলা।
আরও পড়ুন-বন দফতরের অভিনব উদ্যোগ জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানে, বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় গাছের উপর চারা রোপণ
ইস্টবেঙ্গল জিতলেই ইলিশ
বাবা ছিলেন ফুটবলের ভক্ত। ইস্টবেঙ্গলের অন্ধ সমর্থক। মাঠে নিয়মিত খেলা দেখতে যেতেন। দেখা হত শচীন দেববর্মনের সঙ্গে। তিনিও ছিলেন ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক। বাবাদের ধারণা হয়েছিল, শচীনকর্তা অপয়া। তিনি গ্যালারিতে বসলেই ইস্টবেঙ্গল হেরে যায়! সবাই মিলে একটা উপায় বের করেছিলেন। তাঁরা শচীনকর্তাকে বলেছিলেন খেলা চলাকালীন আপনি পিছন দিকে গ্যালারির নিচে দাঁড়িয়ে থাকবেন। ইস্টবেঙ্গলের জয় কামনা করে শচীনকর্তা তাঁদের কথা হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন। আমার মামারবাড়ির সবাই মোহনবাগান সমর্থক। যেদিন খেলা থাকত জমিয়ে খাওয়াদাওয়া হত। ইস্টবেঙ্গল জিতলেই বাবা ইলিশ কিনে সোজা চলে যেতেন মামারবাড়ি। মোহনবাগান জিতলে আমাদের বাড়িতে আসতেন মামারা। যেদিন খেলা থাকত, আমাদের বাড়িতে টিভি দেখার জন্য পাড়ার বহু মানুষ ভিড় জমাতেন। এমনও হয়েছে, বাড়িতে জায়গা না পেয়ে আমি এবং বাবা বাইরে কোথাও বসে থেকেছি। খেলার ধারাবিবরণী শুনেছি রেডিওয়। অনেকেই জানেন না, বাবা নিজে দারুণ ক্রিকেট খেলতেন। বাবার জন্য আমার খেলার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ফুটবল-ক্রিকেট দুটো খেলা নিয়েই আমাদের মধ্যে আলোচনা হত। আমার পছন্দের খেলোয়াড় ছিলেন কার্সন ঘাউড়ি এবং ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। আমি প্রেমে পড়ার পর বাবা আমার প্রেমিককে নিয়ে গান বেঁধেছিলেন। এমন বাবা ক’জন পায়? আমি ভাগ্য করে বাবা পেয়েছিলাম।
আরও পড়ুন-আইপিএলে আরটিএম নিয়মের বিপক্ষে অশ্বিন
সেই দুটো গান
আমি গান পেয়েছি বাবার কাছেই। প্রতি মুহূর্তে আমাকে উৎসাহিত দিতেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমার প্রথম গানের রেকর্ডিংয়ে বাবাকে পাইনি। যদিও সেই গান ছিল তাঁর নিজের সৃষ্টি। ঘটনাটা খুলে বলা যাক। বেরিয়েছিল একটা সংকলন। পুরনো কলকাতার গান নিয়ে। বাবার গাওয়ার কথা। ট্র্যাক রেকর্ডিংয়ের দিন বাবা একটু অসুস্থ। স্টুডিওটা দমদমে। আমি যাচ্ছিলাম বাবার সঙ্গে। গাড়িতে যেতে-যেতে বাবা বললেন, ‘আজ তো ট্র্যাক রেকর্ড, আমার শরীরটা খুব একটা ভাল নেই। দরকার হলে তুই গেয়ে দিবি। ডাবিংয়ের সময় আমি ঠিক গেয়ে দিতে পারব।’ খাতা খুলে দশটা গানের মধ্য থেকে দুটো গান আমাকে দেখিয়ে দিলেন। আমি গেয়ে শোনালাম। বললেন, ‘ঠিক আছে।’ ডাবিংয়ের আগেই হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। এতটুকু সময় না দিয়ে বাবা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। একদিন স্টুডিও থেকে আমায় ডেকে পাঠানো হল। ওঁরা ঠিক করেছেন, সেই দিনের ওই ট্র্যাক-রেকর্ড থেকেই কাজটা শেষ করবেন। আমাকে একটু দেখে দিতে হবে। আমি শুনলাম মন দিয়ে। দেখলাম, সবগুলো গানই ঠিক আছে। দুটো গান ছাড়া। ওই গান দুটো ওঁরা আমাকে গেয়ে দিতে বললেন। আমি গাইলাম। সংকলনটি বেরোল। কোন গান দুটো গেয়েছিলাম জানেন? যে দুটো গান সেই দিন গাড়িতে বাবা আমায় গাইতে বলেছিল, সেই দুটো। জানি না বাবা নিজের সম্পর্কে কিছু বুঝতে পেরেছিলেন কি না। তবে ওই ঘটনার কথা ভাবলে আজও আমি শিহরিত হয়ে উঠি।
সঙ্গীত শিল্পীদের চোখে ওঁর সুরে অনেক গান গেয়েছি
হৈমন্তী শুক্লা
অসাধারণ শিল্পী ছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। যে কোনও গান অসাধারণ দক্ষতায় গাইতে পারতেন। খেয়াল গাইতেন চমৎকার। রাগরাগিণী সম্পর্কে জ্ঞান ছিল মারাত্মক। শুনতেন অন্যদের কাজও। উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন। মান্না দে-র সুরে গেয়েছিলাম ‘কেন নয়নে আলো ছড়ালে’। গানটা মানবদার খুব পছন্দ হয়েছিল। মানুষটাও ছিলেন বড় ভাল। আমার পরম সৌভাগ্য, এইসব মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি, স্নেহ পেয়েছি। ভালবাসা পেয়েছি। আজ এঁদের মতো মানুষের বড় অভাব। গানের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। একদিন রেকর্ডিংয়ে ঠিকমতো গাইতে পারছেন না। সারাদিন চেষ্টা করলেন। কিন্তু হল না। পরে অন্য একটি দিনে সেই গান রেকর্ড করেছিলেন। ওঁর সুরে অনেক গান গেয়েছি। আমার জন্য কঠিন কঠিন গান তৈরি করতেন। খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। মানবদাদের মতো মানুষ চলে যাওয়ার পর মাথার উপরটা ফাঁকা হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন-মম ব্রতে তে হৃদয়ং দধামি…
উৎসাহ দিতেন খুব
অরুন্ধতী হোম চৌধুরী
আমার সৌভাগ্য আমি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের স্নেহ পেয়েছি। ওঁর সুরে গান করার সুযোগ পেয়েছি। ‘দক্ষযজ্ঞ’ ছবিতে। যেদিন প্রথম ওঁর বাড়িতে গেলাম, নিজেই দরজা খুললেন। আমাকে দেখে দারুণ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। ডাকলেন বউদিকে, ছোট্ট মানসীকে। এইরকম মজার, প্রাণবন্ত মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। উৎসাহ দিতেন খুব। ওঁর সুর ছিল ভিন্ন রকমের। ভাল গাইলে খুব খুশি হতেন। সবার সামনে প্রশংসা করতেন। দেখলে মনে হত খুব রাগী। কিন্তু একেবারেই তা ছিলেন না। তিনি দারুণ ফুর্তিবাজ। ছেলেমানুষের মতো। ওঁর গান শুনতেও খুব ভাল লাগত। একসঙ্গে বহু অনুষ্ঠান করেছি। ওঁর কাছে যা কিছু পেয়েছি, কোনওদিন ভোলার নয়। নজরুলগীতির প্রতি আমার ভালবাসা জন্মেছিল ওঁর গান শুনেই। অসাধারণ স্টাইলে গাইতেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।
বুঝতে পারি কী হারিয়েছি
শিবাজী চট্টোপাধ্যায়
সাঙ্গীতিক পরিবারে জন্ম মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের। ছোট থেকেই নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন নিবিড় চর্চার মধ্যে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। বড় মাপের শিল্পী ছিলেন। সেইসঙ্গে ছিলেন বড় মনের মানুষ। সবার সঙ্গে সহজেই মিশতে পারতেন। আমাদের মতো জুনিয়রদের সঙ্গেও মিশে যেতেন। মানবদার সঙ্গে আমি বহু অনুষ্ঠানে গেছি। এমন অনেক অনুষ্ঠানে গেছি, যেখানে আমার গান ছিল না। শুধুমাত্র ওঁকে শোনার জন্য গেছি। একটা সময়ের পর আধুনিক গানের জগৎ থেকে চলে গিয়েছিলেন নজরুলের গানের দিকে। যথেষ্ট শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। রসবোধ ছিল সাংঘাতিক। খুঁতখুঁতে ছিলেন গানের ব্যাপারে। এমন অনেক দিন গেছে, একটা গান সারাদিন ধরে রেকর্ডিং করেছেন। অসাধারণ কীর্তন গাইতেন। সুরকার হিসেবেও ছিলেন বড় মাপের। পেয়েছিলেন সাফল্য। দারুণ দারুণ সব গান উপহার দিয়েছেন। মানবদা আজ নেই। যখন বেঁচে ছিলেন তখন এতটা অনুভব করিনি। এখন বুঝতে পারি কী হারিয়েছি।
আরও পড়ুন-‘ধর্ষকের কোনও জাত হয় না’ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
আমার প্রিয় সঙ্গীত শিল্পী
নচিকেতা চক্রবর্তী
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় আমার খুব প্রিয় সঙ্গীত শিল্পী। বরেণ্য শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নয়ের দশকে আমি একটি গান তৈরি করেছিলাম। গানটা হল ‘হারিয়ে যাওয়া সেই গানের কলি’। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গানটা আমাকে গাইতে হয়। ওই গানের মধ্যে দিয়ে আমি শ্রদ্ধা জানিয়েছি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কেও। গানে বিভিন্ন শিল্পীর জনপ্রিয় গানের দু’-এক কলি আমি গেয়ে শোনাই। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘বনে নয় মনে মোর পাখি আজ গান গায়’ গানের ছোট্ট অংশ পরিবেশন করি। শ্রোতাদের উচ্ছ্বাস দেখে বুঝতে পারি গানটা আজও মানুষের কত প্রিয়। নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের মনেও ঢেউ তোলে। বহু জনপ্রিয় গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। বড় মাপের শিল্পী ছিলেন। পাশাপাশি ছিলেন বড় মাপের সুরকার। এঁদের মতো শিল্পী বাংলা গানকে আলাদা উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন।