হাতে ৮৪০ ঘণ্টা সময়। ৩৫ দিন। ৪০ কোটি ভারতীয়কে দুটো দেশে ভাগ করে পাঠাতে হবে। তৈরি হল যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সীমানা নির্ধারণকারী কমিশন। দায়িত্ব দেওয়া হল সিরিল জন র্যাডক্লিফকে। তৈরি হল ‘বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশন’ এবং ‘পাঞ্জাব বাউন্ডারি কমিশন’।
আরও পড়ুন-ইস্তফা দেওয়া পদে ফেরানো হল ঘাটালের সাংসদ দেবকে
মাউন্টব্যাটেনের ভারতে সার্জিক্যাল অপারেশন/ মাউন্টব্যাটেনের ব্যাটন র্যাডক্লিফের হাতে
রানি ভিক্টোরিয়ার লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ভাইসরয় হিসেবে ভারতে আসেন ১৯৪৭ সালে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বীপ তখনও ধিকধিক করে জ্বলছে। ভারতের অলিন্দে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যুগ। আসমুদ্রহিমাচল তখন অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখছে কিন্তু মুসলিম লিগ দ্বিজাতি তত্ত্বের আদর্শকে আঁকড়ে ধরে ভারতীয় মুসলিমদের আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু এই সমস্যাকে এড়াতে ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন ছুটলেন ভারতের তখনকার রাজনীতিবিদদের কাছে। মহম্মদ আলি জিন্নার সঙ্গে দেখা হতেই মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনায় এল অন্য ভাবনা। ভারতের প্রথম সার্জিক্যাল অপারেশনের আগে জিন্না মাউন্টব্যাটেনকে মনে করিয়ে দিলেন অপারেশনের আগে অ্যানাস্থেসিয়া প্রয়োজন। এই অ্যানাস্থেসিয়ার কাজেই ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা হল, চ্যান্সলি বারের দক্ষ আইনজীবী র্যাডক্লিফকে। ব্রিটেনে তাঁর আইনি সাফল্য এবং খ্যাতি ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু ভারতের ব্যাপারে আগ্রহ বা অভিজ্ঞতা কোনওটাই ছিল না র্যাডক্লিফের। তাই বিবিসির একটি তথ্যচিত্রে মজা করেই তাঁর সম্বন্ধে বলা হয়েছে— “Radcliffe, a man who had never been east of Paris, was given the chairmanship of the two boundary committees set up with the passing of the Indian Independence Act.”
আরও পড়ুন-৪৭ লক্ষ টাকায় পুরসভার উদ্যোগে আলোয় সাজছে দুর্গাপুরের নগরবন
দেশ ভাগের ব্লু প্রিন্টে র্যাডক্লিক লাইন
র্যাডক্লিফ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের তথ্যমন্ত্রকের ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে কাজ করতেন। ৪০ কোটি ভারতবাসীর স্বপ্ন ভাগের এই দায়িত্বে র্যাডক্লিফের নাম সুপারিশ করেন লর্ড লিস্টোওয়েল। তবে একা র্যাডক্লিফ কাজ পারবেন কি না তা নিয়ে মাউন্টব্যাটেনের ভাবনা কম ছিল না। জিন্না মাউন্টব্যাটেনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন একজন চেয়ারম্যান হলে তিনি সঠিকভাবে দুই সীমান্তের লাভ-ক্ষতির ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। মাত্র ৮৪০ ঘণ্টায় ৪০ কোটি ভারতীয়কে দুটি শিবিরে ভাগ করার কাজ ছিল বেশ কঠিন। সঠিক মানচিত্র ভিনদেশি আইনজীবী র্যাডক্লিফের ছিল না। বহু পুরাতন ঐতিহ্যশালী মানচিত্রের সামনে বসে লাইন টানতে শুরু করলে যে মানবিক বিপর্যয় হতে পারে সে-বিষয় ন্যূনতম কোনও ধারণা ছিল না। একটা রেখা অখণ্ড ভারতের স্বপ্নকে যে ধূলিসাৎ করতে পারে সেদিন কেউ সেটা বুঝতে পারেনি।
ব্রিটিশ জেদ ও অধ্যবসায়ে আইনজীবী র্যাডক্লিফ তাঁর এই কাজকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলেন। তাঁর কাছে ৫ সপ্তাহ সময় ছিল বেশ কম। ১৯৪৭ সালের ১২ জুন মাউন্টব্যাটেন জহরলাল নেহরুকে জানান, “The work of the Boundary Commissions is meant to be done fairly rapidly. If we complicate the issue at this stage, the work will be prolonged and final decision will be delayed. I imagine that if and when two States have been formed, those States will mutually consider modifications and variations of their frontiers so that a satisfactory arrangement may be arrived at.” তাড়াহুড়ো করে সীমান্তরেখা টেনে দিয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে যে সমাধানের স্বপ্ন নেহরু দেখেছিলেন তা ভারত-পাকিস্তানের ইতিহাসে আর হয়ে ওঠেনি।
নেহরু ভাবতেন সীমান্ত নিয়ে গড়িমসি করতে করতে ব্রিটিশরা যেন আবার ঘাড়ে চেপে না বসে। তাঁর যুক্তি ছিল, সীমান্ত কমিশন যত তাড়াতাড়ি তার রিপোর্ট দেবে তত তাড়াতাড়ি ব্রিটিশ থেকে ভারতীয়দের কাছে তার ক্ষমতা চলে আসবে। প্রায় ৫০ বছর কেটে গেলেও সীমান্ত নিয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়া আর হয়ে ওঠেনি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে।
আরও পড়ুন-বন দফতরের অভিনব উদ্যোগ জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানে, বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় গাছের উপর চারা রোপণ
মানচিত্রের আগে এল স্বাধীনতা
অনভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে র্যাডক্লিফ তৈরি করলেন তাঁর নিজস্ব রিপোর্ট। সময়টা ছিল ১৯৪৭ সালের ১২ অগাস্ট। তিনি ঘোষণার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু মাউন্টব্যাটেন তা আবার পিছিয়ে দিলেন। ১৪ অগাস্ট পাকিস্তানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হল এবং ১৫ অগাস্ট ভারতের হাতে। কিন্তু তখনও দু’দেশের মানুষ জানে না কোথায় তাদের সীমানা শেষ আর কোথায় তাদের সীমানা শুরু। স্বাধীনতার উল্লাসে তখন তারা মাতোয়ারা। দিন দুয়েক পরে ১৭ অগাস্ট প্রকাশিত হল র্যাডক্লিফ কমিশনের রিপোর্টার গ্যাজেটেড কপি। সেদিন থেকেই ভারতের স্বপ্নভঙ্গের মুহূর্ত শুরু হল। চোখের সামনে ফুটে উঠল ভারত ভাগের আসল ভয়াবহতার ছবি। আস্তে আস্তে সারা ভারতবর্ষে শুরু হয়ে গেল সীমানার কাটাছেঁড়া।
সরকারের সেই গ্যাজেট পাঠিয়ে দেওয়া হল বিভিন্ন জেলা, থানা, গ্রাম— সর্বত্র। রিপোর্ট পেয়েই সাধারণ মানুষের হাহাকার বাড়তে লাগল। সাধের ঘরবাড়ি, সহায়-সম্বল, জমিজমার উপর দিয়ে র্যাডক্লিফ লাইনের স্টিম রোলার চালানো হল। কারওর শখের পুঁইমাচান, কারওর ঠাকুরদালান, কারওর উঠোনের তুলসীমন্দির— সবার ঠিকানা বদলে দিল একটা লাইন। শুরু হল হিংসার নতুন পাঠক্রম। দুই শিবিরেই সীমানার দু’পাশে লাখে লাখে মানুষ প্রাণ হারাল ধর্মীয় হিংসার কারণে। র্যাডক্লিফ ভারতের বাস্তবতা বুঝতেন না। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি তাড়াহুড়োর মধ্যে তাঁর তৈরি সীমান্ত এত মৃত্যু বয়ে আনতে পারে। একই সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসংখ্যার সঠিক বণ্টন ও বিন্যাসের ধারণা না থাকায় এত বিপুল সংখ্যক মানুষ যে ভিটেছাড়া হতে পারেন, তা কল্পনাও করতে পারেননি সীমান্ত কমিশনের প্রাণপুরুষ র্যাডক্লিফ সাহেব।
আরও পড়ুন-হামাসকে শেষ করতে গাজার স্কুলে হামলা ইজরায়েলের! মৃত কমপক্ষে ১০০
দু’পারের যন্ত্রণার শিবির
১৪ আর ১৫ অগাস্ট স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা হওয়ার আনন্দে অচেতন হয়ে থাকা ভারতবাসীর যন্ত্রণা বাড়তে থাকে ক্রমেই। শুরু হয় আসা-যাওয়ার খেলা। জায়গা, জমি, বসতবাড়ি এবং স্বপ্ন বন্ধক রেখে হিন্দু এবং শিখরা পাড়ি জমাতে থাকেন ভারতে আর মুসলিমরা পাকিস্তানে। পাঞ্জাব, বাংলা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, কাশ্মীর-সহ র্যাডক্লিফ সাহেবের টানা দু’পাশের রেখার এলাকাতে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। সেদিনের ব্রিটিশ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারত জুড়ে প্রায় ৬০০টি শরণার্থী শিবির গড়ে ওঠে উদ্বাস্তুদের জন্যে। কেউ কেউ বলেন বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা হাজারের বেশি। এই শিবিরগুলোতে মানুষ আশ্রয় নেয় এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার সময় কিংবা নতুন দেশে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার সময়। সেই সময় অত্যাচারের কথকথা যেন ভারতের ইতিহাসে কাব্য হয়ে ওঠে।
সি রাজা গোপালাচারীর ১৫ অগাস্ট
১৯৪৭ সালের ৪ জুলাই ব্রিটিশ হাউস অফ কমন্সে ভারতীয় স্বাধীনতা বিল পেশ করা হয়। এই বিলে ভারত ভাগ ও পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব ছিল। বিলটি ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই গৃহীত হয় এবং ১৪ অগাস্ট দেশ ভাগের পর ১৪-১৫ অগাস্ট মধ্যরাতে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীনতার উদযাপনে অংশ নেননি। কেননা ভারত যখন স্বাধীনতা পায়, তখন মহাত্মা গান্ধী বাংলার নোয়াখালিতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা বন্ধের জন্যে অনশনে ছিলেন।
১৫ অগাস্ট দিনটাকে বেছে নেওয়ার পিছনে অবশ্য নানা যুক্তি ও ব্যাখ্যা রয়েছে।
সি রাজা গোপালচারীর পরামর্শে মাউন্টব্যাটেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য ১৫ অগাস্ট দিনটিকে বেছে নিয়েছিলেন। রাজা গোপালাচারী লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে বলেছিলেন যে তিনি ১৯৪৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত যদি অপেক্ষা করেন, তাহলে তখন তাঁর কাছে স্থানান্তর করার কোনও শক্তি থাকবে না। এমন পরিস্থিতিতেই মাউন্টব্যাটেন ১৫ অগাস্ট দিনটিকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে বেছে নেওয়ার পক্ষে ছিলেন।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমানা নির্ধারণের কাজটি এমন একজন ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার সিরিল র্যাডক্লিফকে দেওয়া হয়েছিল, যিনি আসলে ভারতে বা এশিয়ার অন্য কোথাও যাননি এবং ভারতের জনসংখ্যার সাথে পরিচিত ছিলেন না। সেই সময়ে কেউ এর প্রতিবাদ করেননি। তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে র্যাডক্লিফ একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব হবেন। তবুও, মাউন্টব্যাটেন তাঁর বন্ধু জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রেখেছিলেন। বিতর্কিত এবং পরিস্থিতিগত প্রমাণ থেকে জানা যায় যে মাউন্টব্যাটেন সম্ভবত নেহরুকে চূড়ান্ত সীমানা ঘোষণা করার আগে দেখিয়েছিলেন, যার ফলে একটি সেচ খাল বরাবর ভারতের অনুকূলে পাঞ্জাবের লাইনটি সামান্য বদলেছিলেন।
আরও পড়ুন-জহরের প্রশ্নে অস্বস্তিতে রেলমন্ত্রী
ধর্ম-বর্ম সম সহনশীল
যদিও র্যাডক্লিফের কমিশন মূলত ধর্মীয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণে আগ্রহী ছিল, অন্যান্য বিষয়গুলো কখনও কখনও গুরুত্ব পেয়েছে। কলকাতা থেকে ভারতের গঙ্গা পর্যন্ত জলপথ রাখার জন্য বাংলার মুর্শিদাবাদের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা ভারতকে দেওয়া হয়েছিল। এর প্রতিকারের জন্য, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ খুলনা জেলাকে আজকের বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তদুপরি, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ অংশকে সংযুক্ত করতে এবং দেশের বাকি অংশের সাথে উত্তর-পূর্ব ভারতকে সংযুক্ত করার জন্য বাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার একটি করিডর আজকের বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতকে দেওয়া হয়েছিল। পাঞ্জাবে, গুরুদাসপুরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাটি বেশিরভাগই ভারতকে দেওয়া হয়েছিল, যা শীঘ্রই ভারতের জন্য সুবিধাজনক প্রমাণিত হয়েছিল কারণ জম্মু ও কাশ্মীরের তৎকালীন রাজ্যের একটি সরাসরি রুট সেখান দিয়ে চলে গিয়েছিল, যার ফলে ভারতের পক্ষে এটি ১৯৪৮ সালে সংযুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল।
অবশ্যই, র্যাডক্লিফ লাইন নামে পরিচিত সীমানা সম্পর্কে কেউই পুরোপুরি খুশি ছিলেন না। পাকিস্তানকে প্রায় সবসময় লাঠির সংক্ষিপ্ত প্রান্ত দেওয়া হত, সীমান্তের বেশ কয়েকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা কৌশলগত উদ্দেশ্যে ভারতকে দেওয়া হয়েছিল। ভারত এবং হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলি সাধারণত ভালভাবে চলে আসে, কিন্তু খুলনা জেলাটি পূর্ব পাকিস্তানে শেষ হয় এবং ভারতের সাথে সীমান্তে সিন্ধুর কিছু হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে ভারতে যোগদানের বিকল্প দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে, শিখরা ভারতে তাদের পৈতৃক জন্মভূমি পাঞ্জাবের যতটুকু অংশ ধরে রাখতে দীর্ঘ ও কঠিন লড়াই করেছিল। পাকিস্তানের কাছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ শিখ সাম্রাজ্যের পূর্ববর্তী রাজধানী লাহোর হারানো ছিল শিখ সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষভাবে একটি কঠিন আঘাত, যদিও এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পর্কে যুক্তি রয়েছে।
শেষ পর্যন্ত ভারত ভাগের কোনও সহজ উপায় ছিল না। যে কোনও লাইন কিছুটা স্বেচ্ছাচারী হত এবং বাংলা ও পাঞ্জাবের অধিবাসীদের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করত। বিভাজনের তাড়াহুড়োকে (র্যাডক্লিফের সীমানা আঁকতে এক মাসেরও বেশি সময় ছিল) প্রায়শই সমালোচনা করা হয়।
আরও পড়ুন-কুস্তিতে ব্রোঞ্জ পেলেন অমন
নতুন স্বপ্নের স্বাধীনতা
দেশ ভাগের প্রস্তুতির সময় এক সাংবাদিক মাউন্টব্যাটেনকে প্রশ্ন করেছিলেন দেশ ভাগ হলে এই হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে কি না! আত্মবিশ্বাসী এবং অদূরদর্শী মাউন্টব্যাটেন তখন বলেছিলেন— এমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম আর যদি তা হয়েও থাকে তা দু-দেশের সরকার বোঝাপড়ার মাধম্যে সমাধান করে নিতে পারবে। কিন্তু এই বোঝাপড়ার সুবাতাস ভারতবর্ষে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বোঝাপড়া তো হয়নি বরং বেড়েছে সমঝোতার বোঝা। ভিনদেশি আইনজীবী সিরিল র্যাডক্লিফ ভারতের সেদিনের মানচিত্রকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলেন তাঁর কলমের খোঁচায়। তাঁর কলমের নিব সখ্যর পাঠক্রম আনতে পারেনি। বরং নিজের চোখে দেখেছিলেন তাঁর টানা রেখার বীভৎসতা। দেশে ফেরার আগে একান্ত এক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে র্যাডক্লিফ জানিয়ে গেলেন— অন্তত ৮ কোটি মানুষ আমাকে দেখবে ক্ষোভ নিয়ে তাই আর কোনওদিনই ভারত বা পাকিস্তানে ফেরা হবে না। দেশে ফিরে অবশ্য তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে পেলেন ‘নাইটহুড’। র্যাডক্লিফ থেকে হয়ে উঠলেন স্যার র্যাডক্লিফ। ভারতের মানচিত্রের বুকে তৈরি করে গেলেন দগদগে ক্ষত। আজও তার পোড়াগন্ধ তুলসীতলায়, মাজারে, ঠাকুরদালানে, গুরুদ্বারে। সাগর পেরিয়ে র্যাডক্লিফ সাহেব এলেন— দেখলেন— জয় করলেন। লাইন টানলেন। দেশ দু-টুকরো হল। জন্ম হল দুটি স্বাধীন দেশের। জন্ম হল অহিনকুল শত্রুতার। সাতচল্লিশ একটা দগদগে ক্ষতের জন্ম দিয়ে গেল। দেশভাগ নাটক, নভেল, সিনেমার প্লট হয়ে উঠল, কাব্য লিখলেন কবিরা। কিন্তু যাঁদের সব গেল, তাঁদের গেলই। রাতারাতি কোটি কোটি মানুষ হারাল ভিটে-মাটি। প্রদীপ দেওয়া তুলসীতলা বেদখল হল এক মুহূর্তে। নামাজপড়া উঠোনে বন্ধ হল আজানের অপেক্ষা।