এটা শুধু দুই মায়ের গল্প নয়। তার বাইরে সারা পৃথিবীর সব মায়েদের গল্প। আর গল্পই বা বলি কেন? পৃথিবীর সব মায়ের অন্তরের কথা। যা কোনও গণ্ডি বা কাঁটাতারের বেড়া মানে না। মায়ের ভালবাসা বা সন্তানের জন্য শুভকামনা কবেই বা কোন বাধা মেনেছে? মায়েদের জন্য কোনও দেশ নেই। ভালবাসা তাদের প্রথম ও শেষ সম্পদ।
আরও পড়ুন-মহিলাদের সুরক্ষা নিয়ে ১৫ দফার নির্দেশিকা জারি
আজ তারই সূত্র ধরে দুই মায়ের কথা বলব। সদ্য সদ্য প্যারিস অলিম্পিক্স শেষ হল। ভারতের জন্য এই মহা আয়োজন সবদিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গতবারের অলিম্পিক্স-এ বর্শা ছোঁড়া পর্বে আমাদের দেশের সোনার ছেলে প্রথম হয়ে সোনা পেয়েছিলেন। সব ভারতবাসীর চােখে সোনার ছেলে হয়ে উঠেছিলেন। নীরজ আমাদের নয়নের মণি। বিগত কয়েকবছর তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন। মাঝে সামান্য আঘাতপ্রাপ্ত হলেও নিজেকে তৈরি করেছেন। এবার আমরা আশাবাদী ছিলাম। আবার সোনা। আবার নীরজ। চূড়ান্ত খেলার আগে যে খেলায় নীরজের বর্শা ছোঁড়া দেখলাম— দারুণ। একটা ছোঁড়াতেই ফাইনালে চলে গেলেন। ছন্দ হারাননি নীরজ। ৮৯ মিটারের বেশি ছুঁড়েছেন। নীরজের কাছে যা সর্বকালীন রেকর্ড। দু’দিন পর ফাইনাল। খেলা পড়ল দুপুর রাত্রে। ভারতীয় সময় প্রায় রাত্রি ১২টা। নীরজের জন্য রাত জাগছে ভারতবাসী। সবাই দমবন্ধ করে টিভির সামনে বসে আছি। এ রাত সোনার রাত হতে চলেছে। খেলা শুরু। উত্তেজনা শুরু। একটু পরেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ট্র্যাকে বসে পড়লেন নীরজ। শুধু নীরজ নন, সমগ্র ভারতবাসীর চােখে জল। নীরজ কাঁদছেন। আমরা কাঁদছি। নীরজ সোনা নয়, রুপো পেলেন। ৯০ মিটারের কাছাকাছি দূরত্বে তিনি তাঁর বর্শাটি গেঁথে দিলেন। অবশ্যই স্বপ্নের ছোঁড়ায়! কিন্তু হায়! সেখানেই গল্পের শেষ হল না। পাকিস্তানের খেলোয়াড় আরশাদের শরীরে যেন সেদিন ফেরেস্তারা ভর করেছে। অলিম্পিক্সে সমস্ত রেকর্ড ভেঙেচুরে ৯২ মিটার পার করে গিয়ে গেঁথে গেল তাঁর বর্শাফলক। সোনা আরশাদের। সোনা পাকিস্তানের। ট্র্যাকের মধ্যে হতাশ নীরজ বসে আছেন। কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র। উঠে পড়ে তিনি আরশাদকে জড়িয়ে ধরলেন। দু’জনের গায়ে দু’দেশের জাতীয় পতাকা। দু’জনের চোখে জল। সূর্যের নীচে এই মহা ক্রীড়াঙ্গনে তখন অন্য এক কাব্য রচিত হচ্ছে। যাতে রয়েছে জীবনের ছোঁয়া। যাতে রয়েছে চিরন্তন ভালবাসার আবেগ। যাতে রয়েছে বন্ধুত্বের অমলিন পবিত্র স্পর্শ। আরশাদ-নীরজ যেন ভারত-পাকিস্তানে বন্ধুত্বের এক নতুন কবিতা রচনা করছেন। এই প্রথম অলিম্পিক্সের মতো মহা ক্রীড়াঙ্গনে ভারত-পাকিস্তান একই স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে সোনা ও রুপোর মেডেল পরপর গলায় পরছে, এ দৃশ্য অতীতে কোনওদিন দেখা যায়নি। সেই জন্য বলছিলাম প্যারিস অলিম্পিক্স দুই দেশের কাছে বহু অধরা সমস্যার সমাধান দিয়েছে। এই বর্ণনা আপনাদের সামনে সাধারণভাবে তুলে ধরেছি। ঘটনাবলির সমাপন এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তা হল না। হতে দিলেন না। আরশাদ এবং নীরজের মা তা হতে দিলেন না। পাকিস্তানের খানেওয়াল থেকে আরশাদের মা বললেন, ‘‘নীরজও আমার ছেলের মতো। আরশাদের বন্ধু, ভাই। আমি অবশ্যই ওর জন্য দোয়া করেছিলাম। খেলায় হার-জিত থাকবেই। আমি চাই, ভবিষ্যতে নীরজ আরও অনেক মেডেল জিতুক।’’ ওয়াঘা সীমান্ত পেরিয়ে বাতাসের ডানাতে ভর দিয়ে এমন কথা আসার সময়ই নীরজের মা সরোজদেবী বলে দিয়েছেন, ‘‘আমি নীরজের রুপোয় অখুশি নই। আরশাদ সোনা জিতেছে, সেও আমার ছেলে। ওর জন্যও গর্ব হচ্ছে।’’ দুই দেশ বরাবর খেলার মাঠেও তীব্র প্রতিযোগী। প্রতি ইঞ্চি জমিতে কড়া টক্কর। ক্রিকেট, ফুটবল, হকি বা অ্যাথলেটিক্স যেখানেই হোক না কেন? কিন্তু রত্নগর্ভা মায়ের ভালবাসা সব কিছুকে ভুলিয়ে শান্তি আর ভালবাসার বাতাস বইয়ে দিয়েছে। মায়েদের কোনও কাজে প্রশ্ন করার মতো মুর্খামি আর কিছু হতে পারে না। তবুও মাঝে মাঝে ভাবতে ইচ্ছা করে কোথা থেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শিক্ষাগুলো তাঁরা আহরণ করেন। সেই আহরণ সারাজীবন সন্তানের মধ্যে চালিত করেন। মাগো, আমরা তোমাদের কুসন্তান। তোমাদের শিক্ষা নিতে পারিনি। হিংসাতে মত্ত থাকি। কিন্তু আশা-নিরাশার দোলাচলে আজও বিশ্বাস করি তোমার জিতবে। তোমাদের এই অযোগ্য সন্তানরা জিতবে। তোমরা আমাদের সোনা। সেই আলোর ছটায় উদ্ভাসিত হয়েছে ভারত-পাকিস্তান। সমস্ত সীমান্তের কাঁটাতার আর বাধাবন্ধন কোথায় হাওয়া হয়েছে। একটাই পরিচয়, আমরা মায়ের সন্তান।
আরও পড়ুন-সেবি কর্তার সঙ্গে আদানি যোগের ‘টাইমলাইন’ প্রকাশ্যে আনলেন মহুয়া মৈত্র
নীরজ এবং আরশাদের সম্পর্ক বেশ কিছু বছর আগেই। ২০১৬ সাল থেকে। আরশাদ উঠে এসেছেন একটা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। দু’জনে বন্ধু হয়েছেন খেলার মাঠেই। সহমর্মী হয়ে উঠেছেন। মাত্র ৬ মাস আগে আরশাদ একটা নতুন বর্শা কেনার জন্য হন্যে হয়ে নানা জায়গায় ঘুরেছেন। নীরজ সামাজিক মাধ্যমে আবেদন করেছেন যাতে আরশাদ একটা নতুন বর্শা পান। পেয়েছেন। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সূর্যের নীচে মহাক্রীড়াঙ্গনে— প্যারিসে। নীরজ ঠিকই বলেছেন। ২০১৬ সাল থেকে একসঙ্গে খেলেছেন। বারবার আরশাদ তাঁর পিছনে থেকেছেন। এবার টপকে গেলেন। নীরজ বন্ধুকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আরশাদও বলেছেন, ‘‘নীরজ আমার ভাই।’’
না, কথাগুলো বলার জন্য কেউ বলেননি। লোক দেখানোর জন্য বলেননি। প্রচার পাওয়ার জন্য কেবল বলেননি। হৃদয় থেকে বলেছেন। দেশের মানুষের হয়ে বলেছেন। এখানে পদক গৌণ হয়ে গেছে। পদক ছাডি়য়ে সম্প্রীতির সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। দুই খেলোয়াড় এবং তাঁদের মা সব বাধা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। নীরজ ও আরশাদের মা ঘরের গণ্ডিতে নেই। দুই দেশের ১৭০ কোটি মানুষের মা হয়ে উঠেছেন। একটাই প্রার্থনা, মা তোমরা আমাদের যোগ্য করে নাও। মা, তুঝে সালাম।