জাপানের একটা খাবারের দোকান। বেশ নামডাক আছে সেটির। গিন্জা এলাকার অভিজাত ‘সুশি’ রেস্তোরাঁ কিউবেই। সেখানে আসতেন নাকামুরায়া নো বোস। নামটা জাপানি হলেও আসলে তিনি ভারতীয়। ইংরেজের তাড়া খেয়ে জাপানে আশ্রয় নেওয়া এক অসীম সাহসী, চরমপন্থী বাঙালি বিপ্লবী। ভারতের ইতিহাসে তাঁর নাম রাসবিহারী বসু (১৮৮৬-১৯৪৫)। রাসবিহারী শুধু এক দুঃসাহসী ভারতীয় বিপ্লবীই নন, প্রথা ভেঙে অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্ন দেখা মেধাবী, প্রত্যয়ী, বেপরোয়া, ত্যাগস্বীকারে সদাপ্রস্তুত এক বাঙালির চির-অনুসরণীয় মুখ।
আরও পড়ুন-জেসিনের গোলে ইস্টবেঙ্গল জয়ী
উত্তর ভারতে বন দফতরের সরকারি চাকরি করতেন। তখনই মাতলেন বোমা বানানো নিয়ে। সন ১৯১২। ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেই উপলক্ষে অনুষ্ঠান। যোগ দিতে ভারতে এসেছেন বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ। তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে গেলেন রাসবিহারী। শুরু পলাতক জীবন।
জাপান যাওয়ার আগে টাকার জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত যখন তাঁর জন্য সর্বত্র চিরুনি তল্লাশি করছে ব্রিটিশ সরকার, প্রতিটি পদক্ষেপে বিপদের করাল ছায়া, সর্বত্র অর্থলোভী বিশ্বাসঘাতক এবং বিদেশি শাসকের চরের আনাগোনা— তখন রাসবিহারী কোথায় নিরাপদে আত্মগোপন করবেন, তা এক চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। রাসবিহারী লিখেছেন, ‘নবদ্বীপ একটি তীর্থস্থান। অথচ সাধারণতঃ সেখানে তত বেশী লোক যাওয়া আসা করে না। কিছু দিন সেখানে থাকাই ঠিক হইল। তাছাড়া সেই সময় আমাদেরই একজন লোক সেখানে ছিল, তাহার মতে নবদ্বীপ খুব নিরাপদ স্থান। এই সমস্ত ঠিক করিয়া… তখন একজন ভট্টাচার্য্য ব্রাহ্মণের মতন ছিলাম। পৈতে তো ছিলই, তার উপর একটি টিকিও ছিল… পশুপতি যেমন নির্ভীক তেমনি বুদ্ধিমান। তাহাকে সঙ্গে করিয়া বরাবর ট্রেনে নবদ্বীপ গিয়া হাজির। ঠাকুর (ত্রৈলোক্য মহারাজ) সেখানে ছিল। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিয়া একটি বাড়ী ভাড়া করিবার জন্য খুঁজিতে বাহির হইলাম। নবদ্বীপের একপ্রান্তে এক বৈরাগীর এক বাড়ী ছিল। ২টি ঘর। সেটি ভাড়া করিলাম। সেখানে প্রায় একমাসের উপর ছিলাম।” নবদ্বীপের ব্রজানন্দ গোস্বামী রোডে অবস্থিত শ্রীমদনমোহন মন্দির কর্তৃপক্ষ দাবি করেন যে, তাঁদের মন্দিরেই রাসবিহারী আত্মগোপন করেছিলেন। মন্দিরে ঢুকেই ডান হাতের প্রথম তালাবন্ধ কালো দরজার প্রাচীন ঘরটিতেই থাকতেন রাসবিহারী, তাঁরা বলেন। এমনকী তিনি যে টেবিল-চেয়ার ব্যবহার করতেন, যে টেমির আলোয় লিখতেন, সে সবও তাঁরা সংরক্ষিত রেখেছেন সেই ঘরে।
আরও পড়ুন-‘স্কুল শিক্ষক ও সহপাঠীরা দায়ী’, আত্মহত্যার আগে সুইসাইড নোটে লিখল নাবালক
দেশের বুকে ফাঁসি অবশ্যম্ভাবী হওয়ার কারণেই এই অগ্নীশ্বরকে বিদেশে চলে যাওয়া নিশ্চিত করতে হয়েছিল। শুধু যে নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে, তা নয়। তাঁর পরবর্তী জীবনপ্রবাহ সে-কথা প্রমাণ করেছে। চলে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল অবিচ্ছিন্নভাবে বিপ্লবী কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়া এবং সংগঠনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য।
রবীন্দ্রনাথ সেই সময় জাপান ভ্রমণের চেষ্টা করছিলেন। খবরের কাগজে সেই সংবাদ চোখে পড়ল। রাসবিহারী তাঁর অসমাপ্ত জীবনীতে জানিয়েছেন, ১৯১৫ সালের ১২ মে খিদিরপুরের বারো নম্বর জেটি থেকে জাপানগামী জাহাজে তিনি জাপান যাত্রার জন্য আরোহণ করেন। শচীন সান্যাল, এবং গিরিজা দত্ত ছিলেন এই মহান অন্তর্ধানের শেষ মুহূর্তের সাক্ষী। শচীন সান্যাল লিখেছেন অন্তিম মুহূর্তে তাঁর সহকর্মীদের প্রতি বার্তা ছিল, “দলকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং তাকে প্রতিপালন করবে। নূতন নূতন কর্মী সংগ্রহ করবে। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সাথে খুব সতর্কভাবে যোগাযোগ রক্ষা করবে।” ইনি যদি শরৎবাবুর পথের দাবী উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র না হন, তবে আর কে?
রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় প্রিয়নাথ ঠাকুরের পরিচয়ের আড়ালে কলকাতা থেকে সানুকিমারু জাহাজে রাসবিহারী ভেসে চললেন জাপানের পথে। কোবে বন্দরে কাস্টমস-এর জাপানি কর্মী সানন্দে তাঁর হাতে তুলে দিলেন রবীন্দ্রনাথের নামে আসা কয়েকটি চিঠি। ‘রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়’ পরিচয় দিতেই কোনও তল্লাশি ছাড়াই রাসবিহারী প্রবেশাধিকার পেয়ে গেলেন জাপানে।
রাসবিহারী বুঝেছিলেন, ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে গেলে ভারতীয়দের হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্রের দরকার। যোগাযোগ গড়ে তুললেন চিনের বিপ্লবী নেতা সান ইয়াৎ সেন এবং জাপানের প্রথম সারির প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে। জাপান থেকে ভারতে অস্ত্র পাঠানোর সময়, তাঁর সহযোগী সিঙ্গাপুরে গ্রেফতার হলেন। ভেস্তে গেল পরিকল্পনা।
আরও পড়ুন-সন্তানের দেখাশোনার জন্য এবার ৭৩০ দিন ছুটি পাবে পুরুষেরাও! নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের
রাসবিহারী ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে জাপানে জনমত তৈরির কাজে নেমে পড়লেন। জাপানের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা এবং জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠান গেন্ইয়োশার দাপুটে মুখ তোয়ামা মিৎসুরুর সঙ্গে পরিচয় হল। তাঁকে গ্রেফতার করে প্রত্যর্পণের জন্য ইংরেজ সরকার মিত্র দেশ জাপানের উপর ক্রমাগত চাপ বাড়াতে শুরু করল। তোয়ামা গোপনে পরিকল্পনা করে রাসবিহারীকে লোকচক্ষুর অন্তরালে পাঠিয়ে দেন।
প্রত্যর্পণের আগের রাতে পুলিশের ঘিরে রাখা একটি বাড়িতে বিদায়ী নৈশভোজের অনুষ্ঠানের ছলে রাসবিহারী আর তাঁর সহযোগী হেরম্বলাল গুপ্তকে শিন্জুকুর নাকামুরায়া রেস্তোরাঁর মালিক সোমা আইজোর বাড়িতে চালান করে দেন তোয়ামা। যে পুলিশ কর্মীদের চোখে ধুলো দিয়ে রাসবিহারী আর হেরম্বলালকে লুকিয়ে ফেলেছিলেন তোয়ামা, তাঁরা চাকরি হারাবার ভয়ে তাঁর দ্বারস্থ হলেন। তোয়ামা তাঁদের বললেন, তাঁদের চাকরি চলে গেলেও উপকৃত হবে তিরিশ কোটি ভারতীয় এবং দৃঢ় হবে জাপান-ভারত সম্পর্ক।
রবীন্দ্রনাথের জাপানভ্রমণের সময় তাঁর সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছিল রাসবিহারীর। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে স্নেহই করতেন। চিনের সঙ্গে জাপান যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, জওহরলাল নেহরুর সহানুভূতি চিনের অনুকূলে এবং জাপানের বিপক্ষে যায়। জাপানের ঔপনিবেশিক ‘মতলব’ সন্দেহ করে ওই সময় ভারতে যে জাপান-বিরোধী হাওয়া বইতে থাকে, তা জাপানের সহায়তায় ভারতের স্বাধীনতার পরিকল্পনায় প্রতিকূল প্রভাব ফেলছে দেখে রাসবিহারী রবীন্দ্রনাথকে নিজের খরচে জাপানে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু রাসবিহারী, প্রকারান্তরে চিনের উপর জাপানের আগ্রাসী নীতি সমর্থন করছেন বুঝে, রবীন্দ্রনাথ পিছিয়ে আসেন। জাপান সরকারের ইচ্ছেকে মূল্য দিয়ে জাপানেই সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ আর আজ়াদ হিন্দ ফৌজের ভার তুলে দিয়ে হাল্কা হন অসুস্থ রাসবিহারী।
ভারতের মুক্তি নিজে দেখে যেতে পারেননি। ১৯৪৫-এ জাপানেই প্রয়াত হন তিনি।