আরজি করে ছাত্রী মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হল মঙ্গলবার সকাল থেকে। একদিকে কর্মবিরতি, অন্যদিকে রোগীর পরিবারের ব্যাপক হয়রানির দৃশ্য দেখল মহানগর। কলকাতার হাসপাতালগুলি ছাড়াও জেলার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এই দৃশ্য দেখা গিয়েছে। দিনের শেষে সব জায়গাতেই রোগীদের কাতর আর্তনাদ। এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতালে তাঁদের নিয়ে ছুটেছেন পরিবারের মানুষজন। সোমবার বিনা চিকিৎসায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ছাত্রী মৃত্যুর প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে মেডিক্যাল কলেজগুলির চত্বরে যে দৃশ্য তৈরি হচ্ছে, তাতে আবারও স্পষ্ট হয়েছে রাম-বাম আঁতাঁত। কার্যত হাতে হাত মিলিয়ে বিজেপি এবং বামেরা সুর চড়ানোর চেষ্টা করছে। কিছু বুদ্ধিজীবী সময় এবং সুযোগ বুঝে প্রচারের আলোয় আসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আরজি করের বিষয় নিয়ে সরকার এতখানি স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ যে নেতিবাচক আন্দোলন ও বিক্ষোভ খুব একটা দাগ কাটছে না মানুষের মনে।
আরও পড়ুন-প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেননি, তাঁকে ব্রিটিশ পুলিশ হত্যা করে
গ্রামের মানুষদের কাছে ভরসা রাজ্যের এই সরকারি হাসপাতাল। প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগী বিভিন্ন জেলা থেকে শহরের এই সরকারি হাসপাতালগুলোতে আসেন চিকিৎসা করাতে। বহু মুমূর্ষু রোগীও আসেন বহির্বিভাগে পরিষেবা নিতে। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে একদিন বহির্বিভাগ পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া মানে কয়েক হাজার প্রাণ নিয়ে কার্যত খেলা করা। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের কাজে ফেরার আর্জি জানিয়েছে৷ স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগম সাংবাদিক সম্মেলন করে একই অনুরোধ করেছেন। যদিও সেই আর্জিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আন্দোলনে নামতে চলেছেন সিনিয়র চিকিৎসকরাও৷ ফলে আজ সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত ওপিডি-সহ রাজ্যের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা-পরিষেবা কার্যত থমকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে৷ রোগীর পরিবারের বক্তব্য, হাসপাতালে কখনও ধর্মঘট কিংবা কাজ বন্ধ হতে পারে না। মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার ডাক্তারদের নেই। চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধ মানে মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আন্দোলন।
মঙ্গলবার বিকেলে অস্থিরতা আরও বাড়ে। ধর্মঘটীদের সঙ্গে সহমর্মিতা দেখাতে আরজি করের সামনে দেখা যায় বেশ কয়েক জন তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের। অপর্ণা সেন সেখানে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কটূক্তি ভেসে আসে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েকজন। তাঁদের উদ্দেশ্য করেও নানা অভিযোগ ভেসে আসে। এই অবস্থার মাঝেই রাতে সেমিনার হল ভাঙা হচ্ছে বলে বাম ছাত্র-যুবরা গুন্ডামি শুরু করে হাসপাতাল চত্বরে। ইমারজেন্সি গেট ভেঙে ঢুকে পড়ে। যদিও মিথ্যাচার করে নিজেরাই নিজেদের জালে জড়িয়ে পড়ে। আসলে বিজেপি ও সিপিএম রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গিয়ে এখন আরজি করের ঘটনাকে সামনে রেখে ভেসে থাকার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারদের যে সমস্ত দাবি ছিল সব দাবিই মুখ্যমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন। তারপরেও আন্দোলন চালিয়ে যে আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং রাম-বামের প্ররোচনা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও পড়ুন-আজ কন্যাশ্রী দিবস, এক দশক পেরোল মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প
অন্য দিকে, বিভিন্ন হাসপাতালে জরুরি বিভাগ সামলানোর দায়িত্বে রয়েছেন একজন মাত্র চিকিৎসক। রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। যথাযথ পরিষেবা পাচ্ছেন না সঙ্কটাপন্ন রোগীরাও। কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজেও বন্ধ রয়েছে বহির্বিভাগ। কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টারের গ্রিল আটকে রেখেছেন। ফলে চিকিৎসার জন্য এসেও ফিরে যেতে হচ্ছে হাজার হাজার রোগীকে। দেখা যাচ্ছে, সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও আউটডোর, ইমারজেন্সি অপারেশন থিয়েটার সব জায়গাতেই থমকে পরিষেবা। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং বালুরঘাটে সোমবার দুই রোগীর মৃত্যু ঘটে বিনা চিকিৎসায়। একদিকে, যখন চিকিৎসকরা বসে ‘নো সেফটি নো ওয়ার্ক’ স্লোগান তুলে প্রতিবাদ দেখাচ্ছেন, ঠিক সেই সময় মুমূর্ষু রোগীদের নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতাল ছাড়ছেন তাঁর পরিজনেরা। উদভ্রান্তের মতো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন কোথায় স্বজনের একটু চিকিৎসা হবে সেই আশায়। আরজি করে সোমবার বিকেল তিনটে নাগাদ এমার্জেন্সি বিভাগে এক রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যান। আবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের আউটডোরে খড়দহ থেকে আসা ৮০ বছরের এক বৃদ্ধর প্রেসক্রিপশন এবং টিকিট ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় আন্দোলনের জেরে। রোগীর পরিবার জানাচ্ছেন, চিকিৎসকদের আন্দোলন যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত তবে আন্দোলনের জেরে বাকি রোগীদের যে হয়রানি হচ্ছে তা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। চিকিৎসকদের এই আন্দোলনে পরিষেবা যেভাবে ব্যাহত হচ্ছে তাতে ক্ষুব্ধ রোগীর পরিবাররা। ন্যায় বিচার অবশ্যই প্রয়োজন কিন্তু তার জন্য বাকি প্রাণ প্রশ্নের মুখে পড়বে সেটা কখনওই কাম্য নয়।
ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, অন্য কোনও এজেন্সি তদন্ত করতে চাইলে রাজ্য সরকারের আপত্তি নেই। ফলে সিবিআই তদন্তের নির্দেশের পর রাজ্য সরকারের দায় কার্যত রইল না। তদন্ত নিয়ে এবার সব প্রশ্নের উত্তরই আন্দোলনকারীদের খুঁজতে হবে সিবিআইয়ের কাছে।