কেন এই বিচ্ছেদ

বৈবাহিক সম্পর্কের সুতো জীর্ণ হলে দাঁড়ি টানতেই হয়। জীবনসঙ্গীর মতো এত নিবিড় একটি সম্পর্কে উদাসীনতা একে অপরের মধ্যে অলঙ্ঘ্য দূরত্ব তৈরি করে। কিন্তু কেন হয় এমনটা? এর পিছনে রয়েছে সামাজিক এবং মানসিক দুটো কারণই। এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক অনিরুদ্ধ চৌধুরী এবং মনোবিদ শাল্মলী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করলেন সোহিনী মাশ্চরক

Must read

সাড়ে ছ’বছরের বৃষ্টিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছে উকিলকাকু।
—তোমার নাম কী মা?
—বৃষ্টি। উঁহু, শিঞ্জিনী রায়।
—বাহ্, কী মিষ্টি নাম। কোন ক্লাসে পড় তুমি?
—ক্লাস টু।
—বাহ্, তা তুমি কাকে বেশি ভালবাস? বাবাকে না মাকে?
বৃষ্টি চুপ।
—বলো মা, কাকে বেশি ভালবাস ?
—দু’জনকেই
—কিন্তু তোমার মা-বাবা যে এখন থেকে আলাদা আলাদা থাকবে। তুমি কার কাছে থাকতে চাও?
—দু’জনের কাছেই।
—কিন্তু লক্ষ্মী মেয়ে, তোমাকে যে দু’জনের একজনকে বেছে নিতে হবে। বাবা কিংবা মা। অসহায় বৃষ্টি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে উকিলকাকুর দিকে।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

বাবা ও মায়েদের বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে বৃষ্টিরা এমনই অসহায়। স্নেহ-ভালবাসার কি ভাগ হয়? কিন্তু এখানে যে কোনও উপায় নেই। ভাগের ভালবাসাতেই তুষ্ট থাকতে হবে তাঁকে। বি-চ্ছে-দ খুব কঠিন একটা শব্দ। জীবনসঙ্গীর মতো এত প্রগাঢ় নিবিড় একটি সম্পর্কে উদাসীনতা একে অপরের মধ্যে অলঙ্ঘ্য দূরত্ব নির্মাণ করে। সেলেব হন বা আমজনতা— বিবাহবিচ্ছেদ কারও জন্যই সুখকর নয়। মা-ঠাকুমাদের সেই বিয়ে নামের সাত জন্মের বন্ধনটি আজ অস্তমিত। জেনারেশন ওয়াইরা বড় হিসেবি। সম্পর্কের হিসেবটুকু না মিললে কম্প্রোমাইজের পথে হাঁটেন না তাঁরা। সম্পর্কের সুতো জীর্ণ হলে, প্রতিদিনের যাপনে দ্বন্দ্ব ও তিক্ততা সরিয়ে সম্পর্কের দাঁড়ি টানতে এতটুকু ভাবছেন না তাঁরা।
আসলে যে কোনও সম্পর্কের মূল ভিত্তি হল বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস হারালে সম্পর্কের বাঁধন আলগা হয়। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে কমছে ধৈর্য। আগে যা মনে নেওয়া যেত এখন সেটা মেনে নিতে অসুবিধে হয় এর পিছনে বহু আর্থ সামাজিক কারণও রয়েছে। বিশেষ করে মহিলাদের নিরিখে। আবার মানসিক দিকটাকেও অস্বীকার করবার উপায় নেই। সমাজ লোকলজ্জা, সন্তান ইত্যাদির চেয়েও এখন বড় হয়ে উঠেছে নিজের ভাল থাকা। নিজে ভাল না থাকলে অন্যকে ভাল রাখব কী করে এটা যেমন সত্যি আবার অন্যের মুখের হাসিতেও যে নিজের সার্থকতা লুকিয়ে থাকে এটা মানতে নারাজ জেনারেশন ওয়াই। ফলে জোড়াতালির সম্পর্ককে জিইয়ে রাখা নৈব নৈব চ। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ আর নয়।

আরও পড়ুন-ভোররাতে লাইনচ্যুত সবরমতী এক্সপ্রেস

আসলে যুগ বদলেছে তার সাথে বদলে গেছে মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি। সেই সঙ্গে কিছুকাংশে পুরুষেরও। নিজের কথা বলতে নারী এখন অকুতোভয়। কারণ তাঁরা আজ অনেকাংশেই স্বনির্ভর। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতেও সে সক্ষম। কেবলমাত্র সংসারকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় তাঁরা নিজেদের ভাললাগা, মন্দলাগাকে সহস্র মাইল দূরে সরিয়ে রেখে সংসারের চাকাকে মসৃণগতিতে এগিয়ে নিয়ে চলবে— এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই আর ঠিক সেই জন্যই তাঁর পছন্দের বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদ জানায় সোচ্চারে। প্রেমহীন, বোঝাপড়াহীন সম্পর্কের ছেঁড়া সুতোটাকে বয়ে বেড়াতে একটুও চান না। সেখান থেকেই তৈরি হয় পরস্পরের মধ্যে সংঘাত। তাই হয়তো বিচ্ছেদ শ্রেয়। তাহলে কি নারী স্বাধীনতা, তাঁদের স্বাধিকার, নারীর আর্থিক স্বাধীনতা বিচ্ছেদবৃদ্ধির অন্যতম কারণ? এই নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক অনিরুদ্ধ চৌধুরী বললেন, সমাজতত্ত্বের শব্দকোষ অনুযায়ী, বৈবাহিক সম্পর্ক বা বন্ধনের বিলুপ্তি বা অন্য কথায় সমাজ স্বীকৃতি দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তির এক চরম পথ বা প্রক্রিয়াই হল বিবাহবিচ্ছেদ। উনি এ-ও জানালেন, অধিকাংশ সমাজ বর্তমানে সহজে যাতে বিবাহবিচ্ছেদ লাভ করা যায় সেদিকেই এগিয়ে চলেছে। তবে বিবাহ-বিচ্ছেদ-সংক্রান্ত যে খবরগুলি সোশ্যাল মিডিয়া মারফত আমাদের সামনে আসছে তা সেলিব্রিটিদের হোক বা সাধারণ মানুষ তাঁর মতে সেটা microscopic minority কারণ পরিসংখ্যানের দিক থেকে ভারতবর্ষে একটি শ্রেণির মধ্যে ডিভোর্স বাড়লেও আরেকটি শ্রেণির মধ্যে বাড়ছে না। আগে বিয়ের বিষয়টা অনেক বেশি পবিত্রতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হত, ঠিক সেই কারণেই ভারতীয় মেয়েদের সামাজিকীকরণে ছোট থেকেই রপ্ত মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হত, প্রতিকূল পরিবেশে মানিয়ে চলার শিক্ষা দেওয়া হত এমনকী বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটিকে অক্ষুণ্ণ রাখার বীজমন্ত্র পুরে দেওয়া হত, তাই সেই পরিপ্রেক্ষিতে কোনও মেয়ে যদি শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে না নিতে পারত সেটা চরম লজ্জার বলেই পরিগণিত হত কিন্তু যত সময় এগিয়েছে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে, মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে তাই বর্তমানে মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে তাঁরাও আজ ছেলেদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাইরের জগতের কাজ সমান দক্ষতায় করছে। এর ফলে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন তাঁদের রয়েছে ফলে আর্থিক দিক থেকে পরনির্ভরতা কমে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে অর্থনৈতিক প্রয়োজন তাই অসুখী দাম্পত্যকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মানে খুঁজে পাচ্ছেন না অধিকাংশরাই।

আরও পড়ুন-বালিতে তৃণমূলের উদ্যোগে খেল দিবস পালন

এক ছাদের তলায় এক সংসারে থেকেও কিন্তু আধুনিক ইন্টারনেটের যুগে নিজের মুঠোফোনকে কেন্দ্র করে নিজস্ব এক জগৎ তৈরি করে বছরের পর বছর দুটো মানুষ কোনও মানসিক সংস্রব ছাড়া যাপন করছেন এও এক ধরনের বিচ্ছেদ। অনিরুদ্ধ চৌধুরী মনে করেন সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, দৈহিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণের ফলে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। তবে সমাজ দ্রুত পরিবর্তনশীল তাই সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেক কারণ বিবাহ বিচ্ছেদের মূলে আছে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় গুরুতর কারণ ছাড়া অহংবোধজনিত অনেক তুচ্ছ কারণ,ব্যক্তিত্বের সংঘাত, যৌন অসামঞ্জস্যপূর্ণতা, রুচির অমিল ও পরস্পরের মনোভাবের বৈপরীত্য, বোঝাপড়ার অভাব-এর জন্য সম্পর্কে ফাটল ধরে ও তা শেষ হয়। অনিরুদ্ধ চৌধুরীর মতে, আজকাল যেমন মেয়েরা স্বাধীন জীবন পাওয়ার জন্য পিছপা হচ্ছে না তেমন আগের থেকে ছেলেরা মেয়েদের প্রতি তথা সংসারের প্রতি বেশ সাপোর্টিভ, কিন্তু এই পরিসংখ্যান অনেকটাই কম, তাঁর মতে একটি সংসারে ছেলেটির তরফে যদি সহযোগিতা থাকে তাহলে মেয়েটির পক্ষেও সংসারের চাকা মসৃণভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

আরও পড়ুন-এবার বিহার আর ওড়িশা, ধর্ষণ করে খুন, বিজেপি রাজ্যে পরপর অপরাধ

এ তো গেল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু সমাজের চেয়ে একটা বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে মন। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মন, মানসিকতাও এবং তা শুধু স্বামী-স্ত্রী নয়, তাঁদের সন্তানের, সর্বোপরি দুটো পরিবারের। কারণ তো পারিবারিক বন্ধনও। এই নিয়ে মনোবিদ শাল্মলী চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ইগোর একটা বিশাল ভূমিকা রয়েছে এই ডিভোর্স বা বিচ্ছেদের মুলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে প্রায় সব বাড়িতেই স্বামী ও স্ত্রী দু’জনেই সু-রোজগেরে এবং আর্থিক দিক থেকে কেউ কারওর ওপর নির্ভরশীল নয়, আর ঠিক সেই কারণেই কেউ কাউকে মান্যতা দিচ্ছেন বা বলা ভাল কেউ কারওর কথা শুনতে নারাজ, কম্প্রোমাইজ, অ্যাডজাস্ট শব্দগুলো কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে তার ফলে সমস্যা বাড়ছে এবং শেষমেশ ডিভোর্সের দ্বারস্থ হচ্ছেন দম্পতিরা। আরও একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শাল্মলী বলেছেন তা হল, সম্পর্কে একে অপরের প্রতি কোনও কোনও ক্ষেত্রে হাই এক্সপেকটেশন থাকছে যা পরিপূর্ণ না হলেই উভয়পক্ষের মধ্যে বনিবনা হচ্ছে না। এইসব কারণের সাথে সাথে ডিভোর্সের জন্য তিনি ফ্যামিলি ইন্টারফেয়ারেন্সকেও দায়ী করছেন।
বিশেষ করে ছেলেটির বা মেয়েটির মা দু’জনের মধ্যে সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে সেটা না করে আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করে ফেলেন, শুধু তাই নয়, এখনকার দিনে ছেলেটি বা মেয়েটি দু’জনেই হয়তো বাবা-মার একটিমাত্র সন্তান যার জন্য পরিবারের ইন্টারফিয়ারেন্স খুব বেশি থাকে, পরিবারের তরফে ওভার প্রোটেক্টিভনেস, ওভার ইনভল্ভমেন্ট চলে আসে যার ফল হিসাবে বিচ্ছেদকেই একমাত্র উপায় হিসাবে মেনে নিতে হয়। কোনও দম্পতির যদি সন্তান থাকে সেক্ষেত্রে শাল্মলী জানিয়েছেন, সম্পর্কটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিছুটা হলেও একটু বেশি এফোর্ট দেওয়া এবং অ্যাডজাস্ট করা জরুরি সন্তানটির কথা ভেবে। তবে যদি কোনওভাবেই তা সম্ভব না হয়, পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যায়, সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তির অনুপ্রবেশ থাকে সেক্ষেত্রে নিদ্বিধায় সম্পর্কে ইতি টানা উচিত কারণ অসুস্থ সম্পর্কের ঘেরাটোপে একটি শিশু বড় হলে সেই শিশুটির মানসিক সুস্থতার ব্যাঘাত ঘটবে যা তার ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত ডেকে আনবে তা বলাই বাহুল্য। কারণ রোজ যদি একটি বাচ্চা মা-বাবার অশান্তি, ঝগড়ার সাক্ষী থাকে তাহলে তা শিশুমনকে চূড়ান্ত প্রভাবিত করে।

আরও পড়ুন-আরজি করের ঘটনায় অভিযুক্তদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল জনস্রোত

তবে শাল্মলী এও বলেন, আজকাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক ঠিক করার জন্য খুব বেশি এফোর্ট দিতে চায় না তার বদলের মুভ অন করার অপশনটি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক তাঁদের কাছে। ঠিক এই জন্যই বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট একটি নতুন মন্তব্য করেছে। সুপ্রিম কোর্টের তরফে জানানো হয়েছে যে সম্পর্ক তিক্ত, খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে, আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে অকারণ অপেক্ষা করা যুক্তিহীন। যে-সম্পর্ক বাঁচানো অসম্ভব সেখানে ডিভোর্সের মামলায় ছয় মাসের অপেক্ষা মূল্যহীন। শর্তসাপেক্ষে দু’পক্ষের সম্মতিতে বিয়ে ভেঙে দেওয়া যেতেই পারে।
তবে সবশেষে শাল্মলীর সাজেশন, কোনও সম্পর্ক ভাঙা খুব সহজ কিন্তু গড়তে অনেক সময়, এফোর্ট দিতে হয় তাই ভাঙার আগে একবার নয় বারবার ভাবুন— দু’পক্ষর তরফেই সমানভাবে চেষ্টা করুন, পারস্পরিক সমঝোতা, বিশ্বাস বজায় রেখে বৈবাহিক সম্পর্কটিকে এগিয়ে নিয়ে চলুন। তবে তিনি এটাও বলেছেন যদি মনে করেন সম্পর্কটা কিছুতেই টানতে পারছেন না তাহলে সম্পর্কের উন্নতি হতে পারে এটা ভেবে দয়া করে সন্তান আনবেন না— সেটা সমস্যা বাড়াবে বই কমাবে না। মনে রাখতে হবে ওই নতুন প্রাণ আপনাদের সমস্যার জন্য অনেক বেশি কষ্ট পেতে পারে যা এক্কেবারেই কাম্য নয়।
পরিশেষে এটাই বলার— নারী ও পুরুষ কিংবা স্বামী ও স্ত্রী প্রতিদ্বন্দ্বী নয়! দুটো ভিন্ন পরিবার থেকে ভিন্ন সংস্কারে বড় হয়ে আসা মানুষের এক ছাদের তলায় থাকা সহজ কথা নয় সেই ভিন্নতাকে গ্রহণ করা এবং পরস্পরের ব্যক্তিত্বের সেই ভিন্নতাকে সম্মান করাটাই বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত। একে ওপরের ভুল-ত্রুটিগুলোকে শুধরে নিয়ে সহযোগী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবেই হয়তো সুন্দর হবে সম্পর্ক।

Latest article