বিবাহবিচ্ছেদ আইন

বিবাহবিচ্ছেদ সুখের নয় কিন্তু এক সঙ্গে থাকা সম্ভব নয় জেনেও থাকাটা আরও বড় ট্র্যাজেডি। ভারতের শীর্ষ আদালত সম্প্রতি জানিয়েছে, ‘বিশেষ পরিস্থিতি’তে বিশেষ অধিকার প্রয়োগ করে বিবাহবিচ্ছেদের পক্ষে দ্রুত সায় দিতে পারে আদালত। কী বলছে এদেশের বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইন। এই নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী সায়ন সচিন বসুর সঙ্গে কথা বললেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

প্রশ্ন : আমাদের দেশের বিবাহবিচ্ছেদ আইনে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদ পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে আইনি ব্যবস্থা এত জটিল কেন?
ভারতের আইনি ব্যবস্থা বিশেষ করে বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইন নাগরিকদের বিভিন্ন চাহিদা এবং সুরক্ষার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এই ভারসাম্যই কখনও কখনও একটি জটিল এবং কষ্টকর প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়, যা নেভিগেট করা কঠিন হতে পারে। প্রক্রিয়ার জটিলতার মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগীয় ব্যাকলগ, ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণ, সচেতনতার অভাব, সামাজিক মনোভাব ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও সহজ করে বলতে গেলে বিবাহবিচ্ছেদ আইনের অপব্যবহার রোধ করার জন্য আইনি ব্যবস্থায় সুরক্ষা ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে, প্রমাণের বোঝা পিটিশনকারীর উপর থাকে, তাদের নিষ্ঠুরতা বা ব্যভিচারের মতো দাবিগুলি প্রমাণ করতে হয়। অযৌক্তিক বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন রোধ করার জন্য এই পদ্ধতিগুলি রয়েছে৷ পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য অপেক্ষার সময়কালের প্রয়োজনীয়তা দম্পতিদের পুনর্বিবেচনা করার এবং সম্ভাব্য পুনর্মিলন করার জন্য সময় প্রদানের উদ্দেশ্যে, যা একটি সুরক্ষা এবং একটি জটিল কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে।

আরও পড়ুন-আজ প্রতিবাদ ব্লকে ব্লকে

কীসের কিসের ভিত্তিতে একজন স্ত্রী অথবা একজন স্বামী বিবাহবিচ্ছেদের মামলা করতে পারেন?
হিন্দু বিবাহ আইন অনুযায়ী ১৯৫৫-এর ১৩ ধারার অধীনে ব্যভিচার, নিষ্ঠুরতা, পরিত্যাগ, ধর্ম পরিবর্তন, কুষ্ঠরোগ, সংক্রামক রোগ, ত্যাগ, মানসিক অস্থিরতা বা মৃত্যুর অনুমানের ভিত্তিতে বিবাহবিচ্ছেদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যেতে পারে। আবার বিশেষ আইন অনুযায়ী ১৯৫৪-এর অধীনে বিবাহবিচ্ছেদ এবং বিচ্ছেদের ভিত্তিগুলিও হিন্দু বিবাহ আইন ১৯৯৫-এর অধীনেই প্রদত্ত ভিত্তিগুলোর অনুরূপ।
মুসলিম বিবাহ আইন অনুযায়ী ১৯৩৯-এর অধীনে প্রদত্তভিত্তির ভিত্তিতে আদালতে বিবাহবিচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করা যায় এছাড়াও বিচারবহির্ভূত প্রক্রিয়াতে অর্থাৎ সোড়িয়া আইনের প্রথাগত ও ধর্মীয় রীতিনীতির মাধ্যমে পারস্পারিক অথবা স্বামী-স্ত্রীর যেকোনও একজনের ইচ্ছায় বিয়ে ভেঙে দেওয়া যায়।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে কোনও মেয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে, কিন্তু পরবর্তী ক্ষেত্রে তার স্বামী হয়তো তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে রাজি হয় কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ি রাজি থাকে না। এক্ষেত্রে কী করণীয়?
বউটি যদি এত কিছু পরেও স্বামীর সঙ্গে ঘর করতে চান তাহলে তাঁকে আগে জানতে হবে যে তাঁর বিয়েটা হিন্দু আইন মেনে নাকি বিশেষ আইন মেনে হয়েছে। এরপরেও যদি তাঁর স্বামী তাঁর কাছে ফিরতে চান তাহলে বউটি ‘রেস্টিটিউশন অফ কনজুগাল রাইটস’ এই মামলাটি করতে পারেন। এই মামলার মূল বক্তব্য হবে যে স্বামী বিনা কারণে তাঁর কাছ থেকে আপনাকে আলাদা থাকতে বাধ্য করেছেন এবং তাঁর সাথে সাথে আপনাদের বৈবাহিক সম্পর্ক ও বিচ্ছিন্ন করেছেন। এমত অবস্থায় স্বামী যাতে তাঁর স্ত্রী প্রতি স্বামীর কর্তব্য পালন করেন তার জন্যই এই মামলা দায়ের করা হয়।
বিবাহবিচ্ছেদ চাইলেই কি বিবাহবিচ্ছেদের মামলার রুজু করা যায়?
না চাইলেই বিবাহবিচ্ছেদের মামলা দায়ের করা যায় না। বিবাহবিচ্ছেদ করতে গেলে উপযুক্ত কারণ দেখাতেই হবে।
আমাদের দেশে আইনের অনেকটাই মেয়েদের পক্ষে থাকে। আর অনেক মেয়েই তার সুযোগ নেয়। এক্ষেত্রে পুরুষরা কি সুবিচার পাচ্ছেন? পুরুষদের ক্ষেত্রে আইনটা কী?
মাননীয় কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি শুভেন্দু সামন্ত বলেছেন যে, “আইপিসির ধারা ৪৯৮এ আইনসভার দ্বারা সমাজ থেকে যৌতুকপ্রথা দূর করার জন্য প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে উক্ত বিধানের অপব্যবহার করে নতুন আইনি সন্ত্রাস উন্মোচিত হচ্ছে।”
যদি স্বামী এবং তাঁর পরিবার বিশ্বাস করেন যে স্ত্রী তাঁদের বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা ফৌজদারি মামলা শুরু করেছেন এবং তাঁদের কাছে সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে, সেক্ষেত্রে তাঁরা মাননীয় হাইকোর্ট বা মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের কাছে গিয়ে আপিল করতে পারেন।

আরও পড়ুন-ভাঙন খেলা

বিবাহবিচ্ছেদের মামলার ক্ষেত্রে যদি কোনও একপক্ষ রাজি না থাকে তাহলে কী করণীয়?
এক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিবাহবিচ্ছেদ দায়ের করতে পারেন। মামলা দায়ের হওয়ার পর আদালত উভয় পক্ষের যুক্তি শুনবে। যে মামলা করেছে অর্থাৎ বাদীপক্ষ বিবাদীপক্ষের বিরুদ্ধে কী কী চার্জ এনে বিবাহবিচ্ছেদ চাইছেন সেটার সত্যতা পরীক্ষা করে তারপরেই রায় দেবেন। এক্ষেত্রে সেই রায় যদি বিবাদী পক্ষের পছন্দ না হয় সেক্ষেত্রে রায়ের বিরুদ্ধেও আপিল করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সমস্ত প্রক্রিয়াটি শেষ হতে অনেকটা সময় বেশি নেয়।
বিবাহবিচ্ছেদের পর একটি মেয়ে কি শ্বশুরবাড়িতে থাকা তাঁর সমস্ত জিনিসপত্র ফেরত পেতে পারেন?
বিবাহবিচ্ছেদের পর শ্বশুরবাড়িতে বউটির যে সমস্ত জিনিসপত্র আছে সেগুলো সব ফেরত পাওয়া তাঁর আইনত অধিকার। যদি মিউচুয়াল ডিভোর্স হয় তাহলে অবশ্যই জিনিসপত্র ফেরত চাইতে পারেন তিনি। বিয়েতে সে যে সমস্ত জিনিস উপহার পেয়েছেন সেগুলো আত্মীয়র কাছ থেকেই হোক অথবা শ্বশুরবাড়ির কাছ থেকেই হোক, সেগুলো সবকিছুই ফেরত যোগ্য। অর্থাৎ আইন অনুযায়ী বউটি সবকিছুই পেয়ে যাবেন। যদি মৌখিক কথায় সেইগুলো ফেরত না পান, সেক্ষেত্রে ৪০৬ ধারায় স্থানীয় থানায় অভিযোগ জানাতেই পারে।
কোন কোন ক্ষেত্রে একজন পুরুষ তাঁর স্ত্রীকে খরচ দিতে বাধ্য এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বাধ্য নন?
যখন বিবাহবিচ্ছেদের পর খোরপোশ দেওয়ার ব্যাপারটা আসে তখন আদালত স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ের উপার্জন এবং জীবনযাত্রার মান তুলনা করে। এক্ষেত্রে যদি স্ত্রী তাঁর নিজের জীবনধারা এবং সামাজিক অবস্থান খুব ভালভাবে বজায় রাখতে সক্ষম হয় অর্থাৎ স্ত্রী যদি নিজেই যথেষ্ট উপার্জন করে থাকে তবে সেক্ষেত্রে সেই স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে কোনও খোরপোশ পাবেন না। আবার যে স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন বা তিনি কোনও অসদাচরণে জড়িত থাকেন তাহলে এক্ষেত্রে আদালত স্ত্রীর চাওয়া ভরণপোষণের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে।
যে-সমস্ত মেয়ে পুরোপুরি স্বামীর ওপর নির্ভরশীল তাঁরা খোরপোশের দাবি করতে পারেন।
এক্ষেত্রে খোরপোশ দু’রকমের হয়। একটা অন্তর্বর্তী খোরপোশ এবং একটি স্থায়ী খোরপোশ। সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে কোর্টে মামলা চলাকালীন যে খোরপোশ দেওয়া হয় তাকে অন্তর্বর্তী খোরপোশ বলে এবং বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অর্থাৎ মামলা শেষ হলে যে টাকা দেওয়া হয় তাকে স্থায়ী খোরপোশ বলে। এই স্থায়ী খোরপোশ কখনও এককালীন দেওয়া হয় আবার কখনও কখনও কিস্তিতে দেওয়া হয়। তবে কীভাবে টাকাটা দেওয়া হবে সেটা সম্পূর্ণরূপে আদালত স্থির করে। সাধারণত স্বামীর আয়ের এক-তৃতীয়াংশ বা এক- পঞ্চমাংশ টাকা পান স্ত্রী। এবং মাসিক কিস্তির ক্ষেত্রে স্বামীর বেতনের এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত টাকা খোরপোশ পেতে পারেন স্ত্রী।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

এই খোরপোশের মধ্যে কি সন্তানের খরচও ধরা থাকে?
না, এর মধ্যে সন্তানের খরচ ধরা থাকে না। বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তান মায়ের কাছে থাকলে তার খরচ আলাদাভাবে তার বাবাকে দিতে হয়। সন্তানের মা যদি আবার বিয়ে করে সেক্ষেত্রে খোরপোশ বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু সন্তানের খরচ তারপরেও সন্তানের বাবাকে দিতে হয়।
কোনও পুরুষ কি খোরপোশ পেতে পারে?
১৯৫৫ সালের হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী উভয়েই খোরপোশ দাবি করতে পারেন। কোনও স্বামী বিশেষভাবে সক্ষম হলে অথবা আয় করতে অসমর্থ হলে তিনিও খোরপোশ পেতে পারেন।
মিউচুয়াল ডিভোর্সের ক্ষেত্রে কি খোরপোশ পাওয়া যায়?
মিউচুয়াল ডিভোর্স অর্থাৎ পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য দু’জনেই একটি নিষ্পত্তি দলিলে বিবাহবিচ্ছেদের শর্তাবলি নির্ধারণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। যেমন শিশুর হেফাজত, শিশু সহায়তা, রিয়েল এস্টেট, আর্থিক সম্পদ-সহ বৈবাহিক সম্পত্তির বণ্টন, ঋণ এবং দায় বরাদ্দ, ভরণপোষণ বা রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ প্রদান এবং অন্যান্য পারিবারিক বিষয়। এই ধরনের চুক্তি মধ্যস্থতার মাধ্যমে গঠিত হয় এবং আদালতের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়।
কোনও ছেলে-মেয়ে বড় হলে সেক্ষেত্রে তাদের কাস্টডির নিয়ম কী?
আদালত মূল্যায়ন করবে যে শিশুর শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতার জন্য বাবা বা মা, কোন হেফাজত স্থিতিশীল। সন্তান বড় হলে তারাই বলে, সেক্ষেত্রে আদালত সন্তানের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়। আদালত পিতা-মাতা ও সন্তানের মধ্যের সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে, সন্তানের সঙ্গে তাঁদের বন্ধন তার মানসিক চাহিদা মেটানোর, যত্ন নেওয়ার সামর্থ্য, বাড়িতে স্থিতিশীল পরিবেশ পায়, তা দেখে। যদি ভাই-বোন থাকে, সেক্ষেত্রে তাদের একই জায়গায় রাখার চেষ্টা করে, যাতে তাদের মধ্যে বন্ধন অটুট থাকে। এছাড়াও শিশুর সঙ্গে পরিবারের সদস্য, দাদু-দিদার কত গভীর সম্পর্ক সেই বিষয়টাও বিবেচনা করে।
নাবালক বা ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে কাকে কাস্টডি দেওয়া হয়? আদালত কীসের ভিত্তিতে সেটা ঠিক করে?
হিন্দু আইন এবং অন্যান্য আইন উভয়ের বিধান অনুসারে পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুদের হেফাজত সাধারণত মাকে দেওয়া হয়। যদি না মা সন্তান লালন-পালনের জন্য অযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়।

Latest article